সেপ্টেম্বর ১৯৭১
‘খা বরখা, চুল্লিকা খা, বান্দাকা নাম হরিবল হাক্। কী হইলাে কী হইলাে? বুঝতে পারলেন না? তয় আর একবার কইতাছি। এরপরে কিন্তু আর কমুনা। খেয়াল কইর্যা হুইনেইন। থাক বরখা, চুল্লিকা খাক, বান্দাকা নাম হরিবল হাক্। ব্যাডা একখান! হেতােনে জীবনে তিনডা কাম করছুইন-এক নম্বর সত্তর বছর বয়স হইলে কি হইবাে, আইজ পর্যন্ত কোনােদিন নামাজ পড়েন নাইক্যা। আর তিন নম্বর, চব্বিশ বচ্ছর ধইর্যা মছুয়াগাে দালালী কইর্যা দালাল মহারাজ টাইটেল পাইছেন। এহেনাে হরিবল হাক যখন চুষ-পাজামা মাহমুদ আলীরে বগলদাবা কইরা ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক, অটোয়া, লন্ডন, ট্যুর করণের লগে লগে আন্দাজ করতে পারলেন যে, সাদা চামড়ার পাবলিকগুলা পর্যন্ত সেনাপতি ইয়াহিয়ার জঙ্গী সরকারের উপর তুফান চেইত্যা গেছে। তখন তাড়াতাড়ি আব্বাজানরে টেলিফোন কইর্যা কইলাে, আমেরিকান সিনেটর এডােয়ার্ড কেনেডীরে বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় ট্যুর করতে দিলে, আমাগাে অবস্থা অক্করে ছেরাবেরা কইর্যা ফেলাইবাে। এই ভদ্রলােক বাংলাদেশ সফর করনের আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমাগাে হােতাইয়া ফেলাইছে। এরপর বাংলাদেশের আইস্যা আসল অবস্থা দেখলে না। জানি কি করে? যেভাবেই হােক কেনেডী সাবের ট্যুর কেনচেল করতে হইবাে।
ব্যাস, তেলেসমাতি কারবার হইয়া গেল। তামাম দুনিয়া আরেক দফা তাজ্জব বইন্যা গেল। এসােসিয়েটে প্রেস অব পাকিস্তান লজ্জা শরমের মাথা খাইয়া একটা নিউজ দিলাে ‘কেনেডী সাব বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকার ট্যুর কেনচেল করছেন। এলায় কেমন বুঝতাছেন? দ্রলােক সাত সমুদ্র তেরে নদী পার হইয়া ঢাকায় আহনের লাইগ্যা কলিকাত্তায় আইস্যা হাজির হইলেন। লগে লগে টের পাইলেন, হের দুইজন সঙ্গীরে জঙগী সরকার ভিসা দেয় নাইক্যা। তারপরেও কেনেডী সাব একাই দখলীকৃত এলাকা সফর করবেন বইল্যা ঠিক করলেন। কিন্তুক! ছম্ মম্ ইন্দুর মারা কল’ হইয়া গেল। ইয়াহিয়া সা’ব হেতেনের ভিসা কেনচেল কইর্যা এসােসিয়েটেড প্রেস অব পাকিস্তানরে কইলাে, ‘ভিসা কেনচেলের খবরডা চাপিস করাে- খালি কইয়া দাও এডােয়ার্ড কেনেডী নিজেই আইলাে না। কি সােন্দর হেগাে Propaganda লাইনের ব্যাপার-স্যাপার।
এই খবর না পাইয়া আমাগে বকশি বাজারের ছক্কু মিয়া এক জব্বর কাম কইরা বইলাে। হেতােনে আঙ্কা একটা হ্যাণ্ডবিল পাইছিল। হেইডার মাইদ্দে লেখা কি? ‘শহরবাসী ঢাকা ছাড়াে। ছক্কু মিয়া অনেক Think কইরা দেখলাে- আইজ-কাইল বিচ্ছুগুলা রাইতের বেলায় খােদ ঢাকা টাউনের মাইদ্দেই যে রকম টেষ্টিং কারবার হিসাবে ফুটফাট করতাছে, কবে না জানি আসল কারবারটাই শুরু হইয়া যায়? তাই খুব জলদি যখন ঢাকা ছাড়নই লাগবাে, তখন টাউনডা ঘুইর্যা দেখনের লাইগ্যা ছক্কু মিয়ার খুবই শখ হইলাে। পয়লা গেল শহীদ মিনারে। সমান। হেইডারে কামানের গােলা মাইরা সমান কইর্যা ডাহিনা মুড়া দিয়া লিইখ্যা থুইছে মসজিদ’। কিন্তু কেউই হেইখানে নামাজ পড়ে না। ছক্কু মিয়া নিজে নিজেই ফু কইর্যা হাইস্যা দিলাে। হেতেনে ভাবলাে এই ঢাকা টাউনের মাইদ্দেই তাে সাড়ে আটশাে মসজিদ রইছে তবুও যখন ইসলামের নামে চিল্লাইয়া হেরা এইখানে বেশুমার মানুষ মার্ডার করলাে, তখন হেগাে ইসলাম কি পদের এইডা আর কওন লাগবাে না!
এরপর আমাগাে ছক্কু মিয়া University এলাকায় যেয়ে হাজির হইলাে। দ্যাহে কী? বিরাট বটগাছটা মছুয়াগুলা অক্করে গায়েব কইরা ফেলাইছে। এই বটগাছের তলায় পােলাপানরা মিডিং করতাে বইল্যা ব্যাডারা বটগাছডাই হাওয়া করছে। আল্লাহ্-বিল্লাহ্ কইয়া ছক্কু আস্তে কইর্যা University-র কেলাসের মধ্যে ফুচি মারলাে। সব ধলি। কেলাসের পর কেলাস খালি। তেরােজন প্রফেসর মার্ডার হওনের পরও বাকিগুলা খালি কেলাসের মধ্যে বইস্যা আছে। কী মজা, কী মজা? বজ্জাত হােসেন হেগাে নয়া ভাইসচ্যান্সেলর হইছে। আকা ছকু মিয়া থথ কইর্যা কাইপ্যা উডলাে- দ্যাহে কি একটা কোরবানীর খাসী লাক্স সাবান দিয়া গােসল কইর্যা পলিটিক্যাল সাইন্সের কেলাসে একাই বইস্যা আছে। অনেক কষ্টে জানতে পারলাে এই খাসী হইতাছে ইসলামী ছাত্র সংঘের ভাইস প্রেসিডেন্ট। ঢাকা ইউনির্ভাসিটির ছাত্র সংখ্যা হইতাছে ৭৪০৭ জন। এর মাইদ্দে কেলাসে হাজির হইছেন একজন। লগে লগে রেডিও গায়েবী আওয়াজ আর ঢাকার খবরের কাগজের মহলে আনন্দের হিল্লোল পড়ে গেল। এসেছে, এসেছে, ছাত্র এসেছে। আজাদ, সংগ্রাম, পূর্বদেশ, দৈনিক পাকিস্তানে হেডিং বাইরাইলাে ছাত্রদের মধ্যে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সৃস্টি। কিন্তু কেউই খবরের কাগজ কিনলাে না। তহন ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক খালি কইলাে, ‘ঠিক হ্যায়, হামলােগ হর পরচা আড়াই হাজার করকে খরিদেঙ্গে। কেমন আন্দাজ করতাছেন হেগাে কারবার-সারবার? ছক্কু মিয়া দুই হাতের তাউলা দিয়া চক্ষু দুইডারে ভালাে কইর্যা কলাইয়া নিজের গতরেই একটা চিমটি কাড়লাে- ‘এগুলা হচাহাঁচি দেখতাছি তাে? নাকি মিছা দেখতাছি? ঠিক আছে। তা হইলে ঢাকা ছাড়নের আগে একটা ম্যাটিনী শাে বায়ােস্কোপ দেইখ্যা লই। সিনেমা হলের সামনে যইয়া দ্যাহে কী একটার মইদ্দে চলতাছে ‘ঘােড়কি মাে’-অর একটার মাইদ্দে ‘জুতা কী হাফসােল।আর একডাতে চলতাছে মহব্বকি পাছড়া-পাছড়ি। এইগুলা নাকি লাহােরী ইসলামী তাহজীব আর তমদুন মার্কা পিকচার । আকা ছকু চিল্লাইয়া উঠলাে, বুঝছি, বুঝছি- এরপর বিগুলার নতুন বায়ােস্কেপ আইতাছে- হেইডার নাম হইতাছে ‘বাপ কা বাপ।।
হ-অ-অ-অ এইদিকার কারবার দেখছেন নি? আপনাগাে লগে একটু ছকুর কথা কইতাছি আর এর মাইদ্দেই-থা কমু না। আরে আরে, কইতাছি, কইতাছি লুঙ্গি ধইরা টানাটানি কইরেইন না। নর সুন্দর মানে কিনা নাপিতে যেমতে কইর্যা গেরামের হাটে তার গ্রাহকেদের দশ ইঞ্চি ইটের উপর বহাইয়া কোলের মাইদ্দে মাথাডারে লইয়া ক্ষুর দিয়া চাইচা ফেলায়-সিলেট, রংপুর, ময়মনসিংহ, রাজশাহী আর কুষ্টিয়াতে মুক্তি বাহিনীর বিক্ষুগুলা হেইরকম একটা কারবার কইর্যা ফেলাইছে। সিলেটের সুরমা, রংপুরের তিস্তা, ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র, রাজশাহীতে পদ্মা, আর কুষ্টিয়ার গড়াই নদীতে। আরে চুবানীরে চুবানী। বিক্ষুগুলার তুফান বাড়ির চোটে ভােমা ভােমা সাইজের সােলজারগুলা হেইদিন আন্দাগােন্দা দৌড়াতে দৌড়াইতে রংপুর জেলার জলঢাকায় যাইয়া হাজির। এক বুড়া বেটারে দেইখ্যা মছুয়াগুলা হাঁফাইতে হাঁফাইতে কইলাে কি? এই বুঢ়ঢ়া ঢাকা কেধার হ্যায়? হু হু হু তােমরা লা ঢাকায় যাবার যাচ্ছেনতাহলেতাে জলােক কাটি দেন, ইডাই ঢাকা হয়ে যাবি? মুই কচ্ছনু জলঢাকার জল’ কাইট্য দিলেইতাে’ ঢাকা হয়। এলায় তােমরা বুঝতাছেন?”
এই রকম একটা কুফা অবস্থায় যা থাকে ডুঙ্গির কপালে’ কইয়া সেনাপতি ইয়াহিয়ার জঙ্গী সরকার সিনেটর এডােয়ার্ড কেনেডীর ভিসা কেনচেল কইরা অহন গাপটি মাইরা বইস্যা আছে। হেইর লাইগ্যা কইছিলাম, “থাক্ বরখা, চুল্লিকা থাক, বান্দাকা নাম হরিবল হাক’।
সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল