২৮ আগস্ট ১৯৭১
ইসলামাবাদে ভয়ংকর দুঃসংবাদ যেয়ে পৌঁছেছে। আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের জঙ্গী সরকার এখন চারিদিকে সরিষার ফুল দেখতে শুরু করছে। আল্লাহর রাইত পােহাইলেই খালি খারাপ খবর আইস্যা হাজির হইতাছে। বহু তেল পানি খরচ কইর্যা বিদেশী জাহাজ ভাড়া কইর্যা জঙ্গী সরকার করাচীর থনে চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দরে লাড়াই-এর মালপত্র পাডাইবার যে ব্যবস্থা করছিলেন, এলায় হেইডার বারােটা বাজছে। মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা এইসব মাল বােঝাই জাহাজগুলারে চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দরে ডাবিশ করছে। টিক্কা-নিয়াজীর দল এই কুফা খবরডারে চাপিস করণের লাইগ্যা বহুত ট্রিকস করছিল। কিন্তু ঢাকায় যেসব সাদা চামড়ার খবরের কাগজের রিপাের্টার বইস্যা রইছে, হেরাই খবরটারে আরাে মজবুত কইর্যা পাড়ানাের গতিকেই আন্তর্জাতিক জাহাজ কোম্পানিগুলা ‘ও মাই গড’ কইয়া চিল্লাইয়া উঠছে। হেতােনরা আর পশ্চিম পাকিস্তান ও বাংলাদেশে জাহাজ পাডাইবাে না বইল্যা ঠিক করছে। অথচ জঙ্গী সরকার এইসব বিদেশী জাহাজ ভাড়া করণের লাইগ্যা কত কষ্ট কইর্যা সাইক্লোন আর দুর্ভিক্ষের নামে আমেরিকার থনে পাঁচাত্তর লাখ ডলার হাতাইছিল। আর বাংলাদেশে হানাদার সােলজারগাে বুঝাইছিল যে। তােমাগাে Supply ঠিক মতনই যাইবাে। কিন্তুক মুক্তি বাহিনীর বিষ্টুগুলা ইয়াহিযাটিক্কার সমস্ত হিসাব গড়বড় কইর্যা দিছে। এলায় উপায় কি! যদি মুছুয়াগুলা টের পায় যে হেগাে Supply-এর অবস্থা অক্করে ছেরাবেরা হইয়া গেছে আর বাংলাদেশের গেরামের মানুষ যেমতে কইর্যা চৈতমাসে দল বাইন্দা পলাে, ল্যাজা, কুঁচা দিয়া বিলের মাইদ্দে মাছ ধরে, মুক্তি বাহিনীর বিক্ষুগুলা ক্যাদো আর প্যাকের মাইদ্দে হেইরকম একটা কারবার এর মাইদ্দেই শুরু করছে তা হইলে উপায় কি?
লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ কাগজের ক্লেয়ার হরিংওয়ার্থ তাঁর রিপাের্টে বলেছেন, পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা যাতে করে মুক্তি বাহিনীর সাফল্যজনক হামলাগুলাে জানতে না পারে সেজন্য জঙ্গী সরকার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু এইসব বিচ্ছুগুলা চট্টগ্রাম ও চালনার কারবার ছাড়াও এর মাইদ্দেই ১৫৭টা বড় রকমের ব্রিজ ও এক হাজারের উপর ছােট ব্রিজ এবং কালভার্ট গুড়া কইরা ফালাইছে। পয়লা দিকে একটা সােন্দর competition চলছিল। বিক্ষুগুলা ব্রিজ আর কালভার্ট ভাঙ্গে, হানাদার সােলজাররা হেইগুলা মেরামত করে। কিন্তুক ব্রিজ কালভার্ট ভাঙ্গনের সংখ্যা এই রকম বাইড়া গেল যে মছুয়াগুলা আর মেরামত কইর্যা সারতে পারলাে না। এর মাইদ্দে নিউইয়র্ক টাইমসের ম্যালকম ব্রাউন ঢাকার থনে তার রিপাের্টে কইছুইন, প্রতি রাইতে গেরিলাদের বােমা, গুলি আর ধ্বংসাত্মক কাজ একটা নিয়মিত কারবারে দাঁড়াইছে। ঢাকা টাউনে গেরিলারা দিব্বি প্রচারপত্র বিলি করতাছে- এমনকি দেয়ালের মধ্যে পােস্টার পর্যন্ত পড়তাছে। তাই ঢাকা টাউন অক্করে জনশূন্য হইয়া পড়তাছে। গেরিলাদের হামলায় হােটেল Intercontinental-এর নিচের তিনটা তলার অবস্থা যাচ্ছেতাই হয়ে গেছে। বিদেশীরা ঢাকায় বাইর হওন এক রকম বন্ধ করছে।
এইদিকে সেনাপতি ইয়াহিয়া খান এক জব্বর কাম করছে। ব্যাড়ায় লাহােরে ডাক্তারগাে এক সেমিনারে চমৎকার একটা বাণী পাঠিয়েছেন। হেতােনে কইছুইন, বহু মূল্যবান জীবন রক্ষার জন্য রক্ত প্রয়ােজন। আপনারা রক্ত সংগ্রহ করুন। ক্যামন বুঝতাছেন? এইসব মূল্যবান জীবন কোনগুলা? হেই যে কইছিলাম বিক্ষুগুলার গাবুর বাড়ির চোটে বাংলাদেশে এক ডিভিশনের মতাে হানাদার সােলজার ইয়া আল্লাহ্, ইয়া আল্লাহ’ কইয়া কাতরাইতাছে- এই মূল্যবান জীবন হইতাছে হেইগুলা। এলায় বুঝছেন। গ্যনজাম কি পরিমাণ শুরু হইছে।
এর মাইদ্দে ইসলামাবাদে আবার একটা কুফা সংবাদ যাইয়া হাজির হইছে। ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক, লন্ডন, হংকং, দিল্লী, কলকাত্তায় দলে দলে বাঙালি কূটনীতিবিদরা স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের লগে যােগ দেওনের গতিকে জঙ্গী সরকার আর কোনাে রকম বাঙালিগাে বিশ্বাস করতে পারছে না। এসােসিয়েটেড প্রেস আর আমেরিকার এক খবরে বলা হয়েছে, জঙ্গী সরকার হেগাে এয়ার ফোর্সের হগল বাঙালি অফিসারগাে আর ডিউটি দিবাে না বইল্যা ঠিক করছেন। এতে কইর্যা পশ্চিম পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের মাইদ্দে একটা ক্যাডাবেরাস অবস্থার সৃষ্টি হইছে। কোনাে পেলেনের পাইলট আছে তাে নেভিগেটর নাইক্যা আবার কোনাে পেলেনের নেভিগেটর আছে তাে পাইলট নাইক্যা। এয়ার ভাইস মার্শাল রহিম খানের এখন চান্দি গরম হইয়া গেছে। কেননা হেগাে এয়ার ফোর্সের প্রতি একশ’ জনের ৩৫ জনই হইতাছে বঙ্গভাষী।
আঃ হাঃ একটু পশ্চিম পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের History কইতাছি, এর মাইদ্দেই অক্করে অস্থির হইয় পড়লেন। তয় কইতাছি হােনেন, ১৯৬৫ সালে যখন এই মছুয়াগুলার ইন্ডিয়ার লগে যুদ্ধ করণের যে চিরকিৎ হইছিল হেই সময় হেগাে যত অফিসার মরছিল, এইবার বাংলাদেশের ক্যাদোর মাইদ্দে তার থাইক্যাও অনেক বেশি অফিসার পড়ল তুলছে। এই সব অফিসারের নম্বর ছয়শাের উপরে উড়ছে। | দুই চারডা নাম হুনলেই বুঝতে পারবেন কি ধরনের মালগাে বিচ্ছুরা খাতির জমা করছে। সীমান্ত প্রদেশের গবর্ণর লেঃ জেনারেল অজরের পােলা ক্যাপ্টেন সারােয়ার, কুমিল্লায় মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের রিজভি সাবের জামাই ক্যাপ্টেন কমর আব্বাস, ময়মনসিংহে নৌবাহিনীর কমােডাের কামাল খানের ভাই মেজর আজিম কামাল খান, টাঙ্গাইলে লেঃ জেনারেল রেজার জামাই ক্যাপ্টেন হাশেম খান, সিলেটে আজরাইল ফেরেশতারে ‘ইয়েচ ছ্যার কইয়া অক্করে গায়েব হইয়া গ্যাছেগা। এইসব খবর ইসলামাবাদে যাইয়া পৌছানাের লগে লগে হেইখানে খালি আওয়াজ উঠছে, হ্যায় ইয়াহিয়া, ইয়ে তুমনে কেয়া কিয়া?’
মওলবী সা’বে কিছু কওনের আগেই আর একটা খারাপ খবর ওয়শিংটন থাইক্যা আইস্যা হাজির হইছে। আমেরিকার আইনে রইছে কোনাে দেশ ট্যাকা ধার লইয়া কিস্তি শােধ দ্যাওনের টাইমের পর ছয়মাস গেলােগা, হেই দ্যাশেরে আমেরিকা আর নতুন ধার দিতে পারে না। এম.এম. আহম্মক আস্তে কইর্যা ছদর ইয়াহিয়ারে কইছে, আমেরিকার থনে এইরকম ধারের পরিমাণ এলায় ৪০০ কোটি ডলারে দাড়াইছে। হেইর লাইগ্যা কইছিলাম- ইসলামাবাদে অহন একটার পর একটা দুঃসংবাদ যাইয়া পৌছাইতাছে। আর জঙ্গী সরকার চারদিকে সরিষার ফুল দেখতে পাইতাছেন। ক্যামন বুঝতাছেন!
সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল