You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09 | চরমপত্র - সংগ্রামের নোটবুক

সেপ্টেম্বর ১৯৭১

কাপে কাপ।’ বাংলাদেশে এখন কাপে-কাপ’ ব্যাপার শুরু হয়েছে। আইজ কেন জানি। না মরা পাকিস্তানের পয়লা জামানা মানে কিনা আটচল্লিশ সালের কথা মনে পড়তাছে। আমার এক খুবই জানি-দোস্ত হেই সময় জেলে গেছিল। দ্রলােক চুরি, চামারি, জোচ্চরি, রাহাজানি, ডাকাতি, বাটপারি কিছুই করে নাইক্যা। কিন্তুক মরা পাকিস্তানের। জব্বর জব্বর আইন-কানুন আছিলাে। তার একটা হইতাছে হেই জিনিষ- মানে কিনা হুলিয়ার দরকার নাই- বিচারের দরকার নাই। যে কেনাে থানার দারােগা যে কোনাে টাইমে যে কোনাে লােকরে এমতেই আটকাইতে পারে। এই রকম একটা গ্যাড়া-কলের মাইদ্দে আমার জানি-দোস্ত আটকা পড়ছিল। কারণ হেতানে পত্নীতলা থানার দারােগার। শালীরে হাংগা করতে চায় নাই। ব্যাস, স্পিশিল আইনে আমার দোস্ত আটকা পড়লাে। এই আইনে যা ইচ্ছা তাই করণ যাইতাে। মাস ছয়েক পরে যহন বেড়ায় জেল থনে বাইরাইলাে, তখন হেরে চেনাই মুস্কিল। হেরে জিগাইলাম, কেইসটা কী? দোস্তে কইলাে, ছয় মাসের পাঁচ মাসেই জেল হাসপাতালে আছিলাম। যহন কেইস আন্তাজ করলাম তহন খুবই লেইট হইয়া গেছে। বুচ্ছােস, পাকিস্তান হওনের পর হিন্দু ডাক্তার সব ভাগােয়া হওনের গতিকে ঢাকার থনে ডাক্তারগাে লিস্টি বানাইবার একটা ছিক্রেট Order আইছিলাে। কিন্তুক এই লিষ্ট যারা বানাইলাে তারা একবারও চিন্তা কইরা দেখলাে না যে, গরু-ছাগলের আবার আলাদা ডাক্তার আছে। তাই হেই লিস্টির মাইদ্দে মানুসের ডাক্তারের লগে গরু-ছাগলের ডাক্তারদেরও নাম একেকার হইয়া গেল। আমি কইলাম, তাতে তাের কী? আমার দোস্ত হাঁউমাউ কইর‌্যা কাইন্দা কইলাে, “দোস্ত, এই জেল। হাসপাতালে যে ডাক্তরের পাল্লায় পড়ছিলাম, হেই বেডায় আসলে গরুর ডাক্তার আছিলাে- হেতােনে আমারে গরুর ওষুধ খাওয়াইয়া আমার এই অবস্থা করছে। এলায়। বুঝছাে।
আমি কইলাম তয় হুইন্যা ল; আমাগাে এইদিকে আর একটা কারবার হইছিল । তা’ হইলেই বুঝবি মাদারীর খেইল কারে কয়। দোস্ত আমার চিল্লাইয়া উঠলাে, কইয়া ফেলাও, কইয়া ফেলাও। আমি শুরু করলাম, বচ্ছর কয়েক আগেকার কথা। হেই দিন ঘুরতে ঘুরতে করাচীতে গেছিলাম- দেহি কী বটতলার মাইদ্দে মহা হৈ চৈ। আমাগাে সেরকটু মােহাম্মদ তার গরু চুরির মামলায় উকিল ছাড়াই কোর্টে যাইয়া হাকিম সাবরে কইলাে, হুজুর আমার লগে মাত্র পাঁচসিহা পহা আছে, এইডা দিয়া তাে আর উকিল পামু না। হের লাইগ্যা আমার কোনাে উকিল নাইক্যা। হাকিম তার চশমাড়া কপালের উপর তুইল্যা কইলাে, যাও যাও মিয়া বটতলায় এমতেই অনেক উকিল ঘুরতাছে, হেইগুলার একটারে পাঁচসিহা দিয়া লইয়া আহাে।
এই কথা না হুইন্যা সেরকটু মােহাম্মদ বটতলায় আইয়া বাইছ্যা বাইছ্যা এক মােডা-গাটা উকিলরে ধইর্যা কেইসা খুইল্যা কওনের লগে লগে উকিল সা’ব মহা খাপচুরিয়া হইয়া উডলাে। এর মাইদ্দে আরও উকিল, মােক্তার, মক্কেল আইয়া জুটলাে। হগুগলে মিইল্যা এই হাকিম সাবের কোর্ট বয়কট করবাে কী করবাে না এইরকম গেঞ্জাম শুরু কইরা দিলাে। এমন এক টাইমে উকিল চিল্লাইয়া কইলাে, এই মিয়া যাও যাও, হাকিম সা’বরে যাইয়া কও, পাকিস্তান হওনের আগে এই বটতলায় বহু পাঁচ সিকার উকিল আছিলাে- হেইগুলা বেবাক আইজ-কাইল হাকিম হইয়া গেছেগা।’ এলায় ক্যামন বুঝতাছেন?
এর মাইদ্দে কখন যে আমাগাে বাচ্চু মিয়া আইস্যা এইসব কথাবার্তা হুনতাছে তা টেরই পাই নাইক্যা। আমার কথা শেষ হওনের লগে লগে বাছু কইলাে, “আঃ হাঃ তয় তাে আমার কথা হুনলে ভিী খাইবি। আমি কইলাম, আবে রাখ রাখ যেরকম চকিবাজী দেখতাছি, তাতে এইডা কী ফাকিস্তানে পড়লাম নাকি?’ বাছু কইলাে, কীসের মাইদ্দে পড়ছাে আমার হুনলেই টের পাইবি। আমি আর আমার জানিদোস্ত এক লগে চিল্লাইয়া উডলাম, কইয়া ফালা, কইয়া ফালা। আর মােচড়া-মুড়ি করিস না। হােন, মুসলিম লীগ জামানার কথা। হেইদিন করাচীতে এক জব্বর ডিনার আছিলাে। হেইখানে মিনিস্টার খাজা শাহাবুদ্দীন আর ফজলুর রহমান সা’ব ভি হাজির। টেবিলের উপর রূপার চামুচ না দেইখ্যা রহমান সাবের একটা রূপার চামুচ গেড়া মারণের খুবই সখ হইলাে। যখন দেখলাে হগ্গলে কাটা চামুচ থুইয়া হাত দিয়াই মুরগির রান খাইতে খুবই ব্যস্ত, তখন আস্তে কইরা একটা রূপার চামুচ পাকিস্তানের ন্যাশনাল ড্রেস আচকানের পকেটের মাইদ্দে হান্দাইয়া দিলাে। কিন্তু আমাগাে খাজা সাহেব যে একদিকে তাকাইলে আর একদিকে দেখে- মানে কিনা হেই জিনিষ, এইডা ফজলুর রহমান সা’ব অক্করে ভুইল্যাই গেছিলাে। তাই পট কইর‌্যা কারবার কইর‌্যা ফেলাইলাে। এলায় খাজা সাহেব তহন অক্করে পাগলা হইয়া উঠলাে- ফজলু যদি দিব্যি রূপার চামুচ মাইর্যা এই ডিনার টেবিল থনে ভদ্রলােকের মতাে বাইরাইয়া যাইতে পারে, তয় আমি পারুম না কেন? না হইলে মুসলিম লীগের পলিটিকস্ শেখাটাই আমার মাঠে মারা যাইবাে। তাই যখন হগলের খাওয়া শেষ হইলাে, তখন খাজা সা’বে কইলাে, হাজেরানে মজলিস,- বেরেদারানে ইসলাম, আমি আপনাগাে একটা মেজিক দেখামু।’ শেরােয়ানী আচকান আর চুষপাজামা পরা গাবুর সাইজের বেডাগুলা অক্করে লাফাইয়া উড়লাে। খাজা সা’বে একটা বেয়ারারে কইলাে, “দেখাে, একটা রূপার চামুচ ভালাে কইরা ধুইয়া আননা। হের পর। হগ্গলরে চামুচড়া দুই তিন বার কইরা দেখাইয়া দিব্বি চামুচডারে আচকানের পকেটে থুইয়া কইলাে, ‘বেয়ারা টেবিলকা উস্ কোনাম যাে ফজলুর রহমান সাহাব বৈঠা হ্যায়, উনকো পকেটছে ইয়ে রূপাকা চাচে নিকালাে।’ বেয়ারা রহমান সাবের কাছে যওনের আগেই রহমান সা’ব চিল্লাইয়া উঠলাে, “দিতাছি, দিতাছি! আমার পকেটেই রইছে। এলায় বুঝছাে কো কিসিমের লুটপাট কমিটির পাল্লায় পড়ছােস?
চব্বিশ বছর চব্বিশ বছর ধইর্যা এই লুটপাট হওনের পর শেখ মুজিব ইলেকশনের পয়লা চালেই করাচী-লাহাের-পিন্ডির সরাবন তহুরা খাওয়াইন্যা বেডাগুলারে ধান্দা লাগাইয়া দিলাে। সােনারের টুক টাক, কামারের এক গুতা’। কেইটা খেয়াল কইরা দেইখেইন। ইয়াহিয়া সা’ব তার মেলেটারি খাড়া কইর‌্যা ইলেকশন করাইলেন। সমস্ত দুনিয়ারে চিৎকার করে বললেন যে, নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়েছে। রেজাল্ট জামাতে ইসলামী-শূন্য, কনভেনশন মুসলিম লীগ- গােল্লা, নেজামে ইসলাম- জিরাে, কাইয়ুম লীগ- একটাও না, কাউন্সিল মুসলিম লীগ- ছেরাবেরা, দুই ন্যাপ-খামুশ। ইয়াহিয়া সাবের সমস্ত হিসাব গড়বড় হয়ে গেল। এলায় উপায়? বাঙালিরা সংখ্যায় বেশি দেইখ্যা এই রকম একচেটিয়াভাবে ভােট দিলে তাে আর গণতন্ত্র। হয় না! তাহইলে Internal Affair কইয়া আঙ্কা বাঙালিগাে মার্ডার করলেই তাে হয়! পরে একটা বাহানা ঠিক করা যাইবাে। যেমন চিন্তা হেইরকম কারবার। কেকায় পড়লে তাে’ শ্যাম চাচা আর নতুন মামু আছেই। কিন্তুক মছুয়াগুলা হেই কোতেই পড়ছে। বাংলাদেশের ৫৫,১২৬ বর্গমাইল এলাকার কেদো আর প্যাকের মাইদ্দে লাখ খানেক হেই জিনিষ আটকা পড়ছে। এগগা এখন কীভাবে বিচ্ছুগুলা মেরামত করতাছে, তা আল্লাহ্তা’লা ছাড়া কেউই কইতে পারে না।
এই হপ্তার রিপাের্টই হইতাছে পিডানীর চোটে কুড়িগ্রাম ছাড়াও গাইবান্ধা টাউনের হেই মুড়া থাইক্যা ফুলছড়ি পর্যন্ত এলাকা অক্করে ছাফা। ব্রহ্মপুত্র নদ বরাবর জামালপুর, টাঙ্গাইল আর পূর্ব বগুড়ায় বিরাট এলাকা থনে মছুয়ারা লাপাত্তা হইছে। আর সিলেটের উত্তরাঞ্চলের মুক্ত এলাকায় তাে আবার নতুন কইর‌্যা হাট-বাজার চলতাছে।
হ-অ-অ-অ হুনছেন নি বিচ্গুলার নয়া কারবার? আঃ হাঃ পানির মাইদ্দে মাইন লাগাইছে। হেইডার পয়লা কারবার সামালিয়ার একটা জাহাজ এমএস, লাইটানিং-এর উপর পড়ছে। এতাে কইরা না করলাম- যাইস্ না, যাই না। বাংলাদেশে যহন বিচ্ছুগুলার ট্রেনিং কারবার চলতাছে, তখন মাতব্বরী দেখাইতে যাই না। নাহ্, পাকিস্তানী মেলেটারির ‘বিলাফে’র মাইদ্দে পইড়া এই জাহাজডা চালনা বন্দরে মাল লইয়া গেছিলাে। ব্যাস, বিদ্রুগুলার কারবার হইয়া গেল। ওয়্যারলেসের মাইদ্দে ইংরাজিতে আওয়াজ ভাইস্যা আইলাে বাঁচাও বাঁচাও- ঘ ঘন্ কইরা পানি জাহাজের মাইদ্দে ঢুকতাছে। কিন্তু কে কারে বাঁচায়? এর মাইদ্দে আবার পেরতেক সপ্তাহেই হাজারে হাজার ট্রেনিং লইয়াও বিছু ময়াদনে নামছে। মছুয়াগুলা কয়দিক সামলাইবাে।
আমাগাে ছক্কু মিয়া হেইদিন দেখে কী, কুর্মিটোলা থাইক্যা অনেক কষ্টে চাইর ষ্টেশন পর্যন্ত যে ট্রেন চালু করছে, হেইডার ইঞ্জিনের সামনে তিনডা ফল্স বগী লাগাইছে। কারণ! বিক্ষুগুলার মাইন। এইদিকে আবার মছুয়াগুলা বিচ্চুগাে ডরে ফস বগীর মতাে রাজাকার সামনে রাইখ্যা নিজেরা পিছনে থাইক্যা পাইট করতাছে। আহারে! রাজাকার মারতে কী আরাম রে। এইগুলারেই কয় কামানের খােরাক। টিক্কা-নিয়াজী নতুন মামুর বুদ্ধিতে নতুন টিরিক্স করতাছে। কিন্তু হেগাে মরণের যখন ডাক দিছে, তখন টিরিকস কইর‌্যা আর কোনই ফায়দা হইবাে না। খালি আজরাইল ফেরেশতা ওভারটাইম ডিউটি কইরা অহন হেলপার চাইতাছে। হেইর লাইগ্যা কইছিলাম। কাপে-কাপ’ বাংলাদেশে কেদো আর প্যাকের মাইদ্দে অহন কাপে-কাপ’ কারবার চলতাছে।

সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল