সেপ্টেম্বর ১৯৭১
‘এরি ও ছইরুদ্দীর বাপ- গাড়ি হুই করছে’। কী কইলেন? বুঝতে পারেন নাইক্যা? আমাগাে নােয়াখালীর কথা মনে কইর্যা এতেই একটা আওয়াজ দিছিলাম আর কী? হেই ননায়াখালীতে আইজ-কাইল আচমবিত্ কারবার শুরু হইছে। পিড়ানী কারে কয়? নােয়াখালীর হেই মুড়া একটুক ফুচি মারলেই বুঝতে পারবেন। আহারে, রাস্তা-ঘাটের নাম নিশানা নাই- এইরকম এলাকায় মছুয়া আর রাজাকারগুলারে পাইয়া বিক্ষুগুলা মাইরা সুখ করতাছে রে! সব একেবারে চুপ-চাপ কারবার। এর মাইদ্দেও চর বাট্টার মওলানা ঢেপু মিয়া চরের থনে ভাইগ্যা আইস্যা মাইজদি কোর্টে মদিনা হােটেলে বইস্যা পরাটা গােস্ত খাইয়া মছুয়াগুলার দালালী করণের চেষ্টা করতাছে। ব্যাস, বেডার নাম লিস্টির মাইদ্দে উইঠ্যা গেল। মরণে ডাক দিলে মাইনষের এইরকম ভীমরুতিই ধরে। মাইজদী কোর্টের দক্ষিণে বেড়ি বাঁধের উপর মওলানা টেপু মিয়ার লাস পাওয়া গেল।
পিডানী জিনিষটার অপরিসীম মহিমা রয়েছে। যুক্তিতর্ক আর গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ব্যর্থ হলে পিডানীই হচ্ছে একমাত্র ওষুধ। কলি খইলে ঘুষি, থাপ্পর, লাথি-এইগুলাই হইতাছে মােক্ষম দাওয়াই। তাই বাংলাদেশের খাল-খন্দক, নদী-নালা, ঝােপ-জঙ্গল আর কেদোপ্যাকের মাইদ্দে যখন বিক্ষুগুলার গাবুর কেল্কা আর আকা মাইর শুরু হইছে, তখন আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খান সা’ব খবর লইয়া দেহে কী?মছুয়াগুলার একটা পুরা ডিভিশনই গায়েব। আরও এক ডিভিশনের মতাে ব্যান্ডেজ বাইন্দা কাতরাইতাছে। মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা এইজন্য খুবই দুঃখ প্রকাশ করছে। পয়লা দিকে পােলাপানের আন্দাগােন্ধা গুলি করণেই হানাদারগাে জখমীর সংখ্যাটা একটু বেশি হইছে। অহন। বিচ্ছুগুলার পুরা ট্রেনিং হওনের গতিকে হাতের নিশানা অক্করে পইট কারবার। জুইত মতাে পাইলেই একেবারে ঝামেলা Gone। মানে কিনা বচ্ছর পঁচিশ-তিরিশ আগে যে গেন্দা পােলাড়া লাহাের-পিন্ডিতে ওঁয়া ওঁয়া কইরা এই দুনিয়াতে আইছিলাে, কুমিল্লার চান্দিনায় বেড়ায় ঘঁ-অত কইরা আখেরী দমডা ছাড়লাে। এইরকম দম ছাড়নের নম্বর খুবই বাইড়া যাওনের গতিকে পাকিস্তানে আইজ-কাইল ঘরে ঘরে কান্দনের হিড়িক পইড়া গেছে। ভিয়েতনাম আর আলজেরিয়াতেও ফরাসিগাে এইরকমই কেডাবেরা অবস্থা হইছিল। অনেক কষ্টে মার্কিনীগাে ভিয়েতনামের কেদোর মাইদ্দে নামাইয়া আর আলজেরিয়ারে এমতেই ছাইড়া দিয়া ফরাসিরা দেশে ফেরত আইস্যা হাঁপাইতাছে। কিন্তুক বাংলাদেশের যেরকম অবস্থা দেখতাছি, তাতে এইসব মছুয়াগাে একটাও আর দেশে ফিরতে পারবাে কিনা সন্দেহ। পয়লা দিকে ইয়াহিয়া সা’বের কি চোটপাট- বেড়ায় নাকি বাংলাদেশে মচ্ছড়’ মারতাছে। অহন কেমন লাগে? বিক্ষুগুলা যে কইতাছে, ‘হেরা চেউটী মারতাছে, মানে কিনা পিপড়া মারতাছে।’
হ-অ-অ-অ। এইদিকে করাচী রেডিয়াে হেইদিন অক্করে ঘং ঘং কইরা কাইন্দা উঠছে। খালি কইতাছে আ গিয়া, আ গিয়া বঙ্গাল মুলুকমে ছয়লাব আ গিয়া। ও-অ ছয়লাব অর্থ তাে আবার কওন লাগবাে। ছয়লাব মানে বন্যা- হেই বন্যার পানি অহন। ঘল ঘল কইর্যা কুমিল্লা, ঢাকা, রাজশাহী, পাবনা আর কুষ্টিয়ার মাইদ্দে ঢুকতাছে। ফরিদপুরেও দরিয়ার পানি বাড়ছে। এর লগে লগে ব্রহ্মপুত্র-যমুনার পানিও বিপদ সীমা পার হয়েছে। এর অর্থ বুঝতে পারতাছেন? অর্থ হইতাছে পানির মাইদ্দে নতুন কিসিমের খেইল। আহারে, এই পানিতে না-জানি আবার কতাে মছুয়া চুবানীর চোটে পড়ল তােলে। কে জানে! বাংলাদেশে এর মাইদ্দেই আট হাজার বর্গমাইল এলাকা পানির নিচে গেছে। গা। এইটুকু তাে’ পদ্মা নদীর চোটেই হইছে। অহন আবার ব্রহ্মপুত্র চেস্তাছে। কেমন বুঝছেন, খেইলটা কেমন জিওট বাঁধছে। হেইদিন হইছে কি, যমুনা নদী দিয়া এক জাহাজ হানাদার সােলজার উজানীর মুহে যাইতেছিল। খালি কেডা যেনাে কইলাে ‘জাহাজমে দুশমন লােগ চুপাকে হ্যায় মালুম হােতা হ্যায়।’ ব্যস্ ম্যাজিক কারবার শুরু হইলাে। ষ্টিমারের ডেকের উপর মহা গেঞ্জাম লাইগ্যা গেল। মছুয়াগুলার দৌড়াদৌড়ির ঠেলায় আলি কারবার হইয়া গেল। খামুখা দেড়শ জন হানাদার সৈন্যের সলিল সমাধি হইলাে। এই খবর না পাইয়া সেনাপতি নিয়াজী একটা হেলিকপ্টারে কইর্যা কেইডা দেখতে গেছিল। ফিইরা আইসা কইলাে, বঙ্গাল মুলুক মেইয়ে সব দরিয়া হ্যায় না। সমুন্দর হ্যায়? ইয়ে তাে খালি পানি আর পানি। Field Intelegence-এর অফিসার জওয়াব দিলাে, স্যার ছয়লাব আওর ভি হােগা। ইয়ে সাল মালুম হােতা হ্যায় খােদ ঢাকা কা রাস্তামে কিতি চলেগা।
এই রিপাের্ট ইসলামাবাদে যাওনের লগে লগে হেইকানে তেলেসমাতি কারবার শুরু হইছে। চারদিকে খালি আওয়াজ হইতাছে, আবু কেয়া করু! আব্ কেয়া করু! এইডারেই কয় শাল। আইতে শাল যাইতে শাল, হের নাম বরিশাল। এর মাইদ্দে আবার মস্কো থাইক্যা নাকি ইয়াহিয়া সা’বরে একটু ঘষা মাইরা দিছে। খামুকা ইন্ডিয়ার লগে যুদ্ধ করণের খায়েশের লাইগ্যা ফাল পাড়তে না করছে। ব্যাস্ খান সা’বে তার ফরিন সেক্রেটারিরে টিন ভর্তি তেল দিয়া তেহরান আর মস্কো রওয়ানা কইর্যা দিছে। বেড়ায় তেহরানে যাইয়া খুবই গােপনে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরদেশী জাহেদীর লগে গুতাগু করছুইন। কিন্তু লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ কাগজের রিপাের্টার ক্লেয়ার হলিংওয়ার্থ এই গােপন আলােচনার ব্যাপারটা ফাঁস করে বলেছেন, ‘সেনাপতি ইয়াহিয়া আমেরিকা আর চীনের সাথে পরামর্শ কইরা বাংলাদেশের লগে আপােষ করতে চাইতাছেন। এইডারেই মােছ নামানাে কয় বুঝছেন। মুক্তি বাহিনীর গেরিলাগাে মাইরের চোটে বাংলাদেশের হানাদার সােলজরগাে অবস্থা ফাতাহ্ ফাতাহ্ হওনের গতিকেই ইরানের শাহেন শা’রে দিয়া একটা জোড়াতালি কারবাররের জন্য টেরাই করতাছেন। কিন্তু খান সা’বে অনেক লেইট কইর্যা ফেলাইছেন। মােছ নামানেনা কেন, মােচ কামাইলে কিছু হইবাে না। হাজারে হাজারে বিক্ষু অহন ট্রেনিং Complete কইর্যা বাংলাদেশের পানি, কেদো আর প্যাকের মাইদ্দে মছুয়াগুলারে ধাওয়াইয়া বেড়াইতাছেন। মছুয়া কোবাইতে আরাম রে, মচুয়া কোবাইতে কী আরাম! হেইর লাইগ্যা কইছিলাম, পিডানীর অপরিসীম মহিমা রয়েছে। বিচ্ছুগুলার পিড়ানী। হবায় শুরু হইছে- এর মাইদ্দেই ইয়াহিয়া সা’ব আপােষের দেন-দরবার শুরু করছুইন। বিচ্ছুগুলার ডােজ আর একটুক কড়া হইলেই কিন্তু বেডায় আসল ব্যাপারটা কবুল কইয়া ভাগােয়াট হইবাে। না হইলে গাবুর, কেকা আর আঙ্কা মাইরে হগুগল ‘চেউটী’ পটল তুলবাে। কলি খাইলে ঘুষি, থাপ্পর খাইলে লাথি-এইগুলাই হইতাছে ইয়াহিয়া-টিক্কানিয়াজীর মােক্ষম দাওয়াই। বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল অওগ্যা কথাই কইছুন ‘সেনাপতি ইয়াহিয়ার জবাব রণক্ষেত্রেই দেওয়া হবে। এই জবাবের চোটে নয়া History তৈরী হইতাছে। খুনকা বদলা খু-সব কথার শেষ কথা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল