You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.28 | চরমপত্র - সংগ্রামের নোটবুক

২৮ জুলাই ১৯৭১

সেনাপতি ইয়াহিয়া আবার নতুন চাল চালছে। ২৮শে জুনের বেতার বক্তৃতা মাঠে মারা। যাওয়ার পর আরেকটা চানছিং করছেন। যদি কোনােমতে শেষ রক্ষা হয়। কেননা মুক্তিবাহিনীর বিক্ষুগুলার আঙ্কা মাইর যেভাবে বাইড়া চলছে তাতে নয়া কিসিমের। একটা কিছু না করলে খুবই তাড়াতাড়ি খেইল শেষ হওনের আশংকা রইছে। এর মাইদ্দেই বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকার অবস্থা এতােটাই কুফা হইছে যে, জেনারেল টিক্কার মতাে লােক করাচী-পিন্ডিতে যাওনের সাহস পায় নাইক্যা। কেন জানি না হানাদার বাহিনীর মাইদ্দে আইজ-কাইল একটা কথা খুবই চালু হইছে, যে কোনাে টাইমে বড় বড় সেনাপতিগুলা পগার পার হইতে পারে। এতে চাপাবাজী করণের পর চাইর মাস ধইর্যা ফাইট কইরাও যখন কোনাে কূলকিনারা হইলাে না- বেসামরিক শাসনব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্য, স্কুল, কলেজ, চালু হইলাে না আর খােদ ঢাকা টাউনের মাইদ্দেই গেরিলাগাে নমুনা Action শুরু হইছে, তহন হানাদার বাহিনীর জোয়ানগুলা খুবই দুশ্চিন্তার মাইদ্দে পড়ছে। কেইসটা কি? ক্যাদোর মাইদ্দে পইড়া গতরটারে যতই। লাড়াচাড়া করতাছে, ততই গাইড়া যাইতাছে। ভিয়েতনামেও আমেরিকাগাে এই রকম একটা অবস্থা হইছে। তয় কি বাংলাদেশ আর ভিয়েতনামের বিমারটা একই কিসিমের নাকি?
সাতক্ষীরা, মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া-রাজশাহী, চাপাইনবাবগঞ্জ, রংপুরদিনাজপুর, সিলেট-চিটাগাং আর নােয়াখালী, কুমিল্লায় মুক্তি বাহিনীর যে রকম বেশুমার কারবার শুরু হইছে, তাতে কইর‌্যা জঙ্গী সরকারের কাছে অবস্থা খুবই খতরনাক মনে হইতাছে। সেনাপতি ইয়াহিয়া যতদিন পর্যন্ত মনে করছিলেন যে, টিক্কা-নিয়াজী ফরমান। আলীর দল দশ লাখ লােক মাইর্যা বাংলাদেশ Control করতে পারবাে। ততদিন পর্যন্ত Internal Affair মানে কিনা বাড়ির মাইদ্দে নিজেগাে ব্যাপার বইল্যা চিল্লাইতাছিল।
কিন্তুক জেনারেল আব্দুল হামিদ খান আর ভাই-এডমিরাল হাছন সাবের ট্যুরের পর বুঝছেন যে, বাংলাদেশের অবস্থা অহন External Affair, যে কেউ এর মাইদ্দে মাথা হান্দাইতে পারে। হেইখানে অইজকাইল তুফান পাল্টা-মাইর শুরু হইয়া গেছে। ইয়াহিয়া সা’ব তাই অনেক চিন্তা করণের পর জাতিসংঘের প্রতিনিধি প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খানরে দিয়া একটা চানছিং করেছেন। হেরে বুঝাইছেন, আপনার নিজেরও তাে বাংলাদেশে অনেক টাকার ব্যবসা রইছে। হেইগুলা বাঁচাইবার জন্যি আপনে একটুক Help করলেই কামডা করতে পারি। বাংলাদেশ আর ইন্ডিয়াতে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক বহাইলেই কেল্লা ফতে। বাইর থাইক্যা হলেই ভাববাে এইডা তাে খুবই সােন্দর প্রস্তাব। আসলে কিন্তু আমরা যেইডা করণের লাইগ্যা খুবই কোশেশ করতাছি, সেইডাই হইবাে।’
ছদর ইয়াহিয়া সা’ব বাংলাদেশ সমস্যাডারে পাশ কাড়াইয়া ইন্ডিয়া আর পাকিস্তানের মাইদ্দে ক্যাচাল বইল্যা প্রমাণ করণের লাইগ্যা পয়লা শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর লগে মিডিংএর কথা কইলাে। হের পর মামুর ডর দেখাইয়া যুদ্ধের ধমকী দিলাে। এই দুইডার একটাতেও কাম হইলাে না দেইখ্যা প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খানরে ধইর্যা ইন্ডিয়া আর বাংলাদেশে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক বহানের প্রস্তাব দিলাে। আবার কায়দা কইর‌্যা কইলাে, আমরা এই রকম প্রস্তাব মানুম না- তবে যহন জাতিসংঘ কইতাছে তখন মানলাম আর কি? মনে লয় দুনিয়ায় আর কারাে মাথায় ঘিলু নাই? হল ঘিলু ইসলামাবাদে জড়াে হইছে।
জাতিসংঘের লোেক আইলেই এক ঢিলে দুই পাখি মরবাে। এক লম্বর মওলবী সা’রা কইতে পারবাে বাংলাদেশের সমস্যা কিছুই নয়- এইডা হইতাছে ইন্ডিয়া আর পাকিস্তানের ব্যাপার। আর জাতিসংঘের লােক হাজির থাকলে মুক্তি বাহিনীর বিক্ষুগুলার মাইরের চোট খানিক কমতে পারে। কেননা যে হারে মাইর শুরু হইছে তাতে মছুয়াগুলার অবস্থা মাত্র চাইর মাসের মাইদ্দেই হালুয়া হইছে।
ক্যামন বুঝতাছেন? যদ্দিন গেরিলাগাে পাল্টা মাইর শুরু হয় নাই, আর হানাদার সােলজাররা দুনিয়ার ইতিহাসে বৃহত্তম গণহত্যা চালাইলাে- নারী ধর্ষণ করলাে- শহরবন্দর-গ্রাম পুড়াইলাে- ৮০ লাখ লােকরে দেশ ছাড়া করলাে ততদিন পর্যন্ত কিন্তুক জাতিসংঘ পর্যবেক্ষকদের কোনােই দরকার হয় নাইক্যা। তখন বাংলাদেশের ব্যাপার Internal Affair আছিল। আর যখনই ওস্তাদের মাইর শেষ রাইত শুরু হইচে তখনই ইয়াহিয়া সা’বের কি চিল্লাচিল্লি- আমার লগে মামু আছে, আমি ইন্ডিয়ার লগে ফাইট করমু, জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক আইনে কোনেই আপত্তি নাইক্যা কতকিছু। ক্যান্ অহন Internal Affair-এর কি হইল? কইছিলাম না ! এক মাঘে শীত যাইবাে না- আমাগােও টাইম আইবাে।
ভাঙ্গছে, ভাঙ্গছে জাতিসংঘের ঘুম ভাঙ্গছে। আমাগাে টাইম আহনের লগে লগে। জাতিসংঘের ঘুম ভাঙ্গছে। কিন্তু উথান্ট সা’ব, বাংলাদেশে অহন বিক্ষুগুলার যে মাইর শুরু হইছে, হেইডার মুখে কিন্তুক হানাদার সৈন্যগাে লগে লগে আনার পর্যবেক্ষক দলবল সব শুদ্ধা অক্করে ফাতা-ফাতা হইলে দোষ দিতে পারবেন না। দেখছেন না? ভিয়েতনামের গেরিলাগগা হাতে মাইর খাওনের পর শ্যাম চাচা মানে কিনা আমেরিকানরা বাংলাদেশের ক্যাদেদোর মাইদ্দে হান্দনের আগে সতীনের লগে বাচিত করণের চেষ্টা করতাছে। হেগাে মনেও ডর ঢুকছে।
আফসােস! যারা বর্তমান শতকে গেরিলা যুদ্ধের প্রবর্তন করেছে, সুদীর্ঘ আটাশ বছর ধরে গেরিলা যুদ্ধের মাঝ দিয়ে নিজেদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমিকে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের সাহায্যপুষ্ট ফ্যাসিস্ট সরকারের হাত থেকে উদ্ধার করেছে আর ভিয়েতনাম, এ্যাঙ্গোলা কম্বােডিয়ার মুক্তিযুদ্ধকে সক্রিয়ভাবে সাহায্যও অনুপ্রাণিত করেছে- তারাই আজ সাম্রাজ্যবাদের লেজুড় পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে সমর্থন করে বাংলাদেশের গেরিলা যুদ্ধকে উৎখাত করবার কথা চিন্তা করছেন। কিন্তু তারাই তাে বিশ্বের নিপীড়িত, শােষিত আর অত্যাচারিত জনতাকে এ শিক্ষাই দিয়েছেন যে বন্দুকের নলের মধ্যেই রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস আর শশাষিত জনতাকে বিপ্লবের মাঝ দিয়ে সে ক্ষমতাকে কজা করতে হবে। একটা দেশের আপামর জনসাধারণের সক্রিয় সমর্থনপুষ্ট মুক্তির সংগ্রাম কখনও ব্যর্থ হয়নি- হতে পারে না। শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক নীতির ক্ষেত্রে একটু সুবিধা হবে এ চিন্তা করে কোটি কোটি মানুষের শ্রদ্ধাভাজন এই মহান দেশ সাড়ে সাত কোটি নিঃশেষিত বাঙালিকে কেন আজ আরও রক্তদানের জন্য প্রলুব্ধ করছেন? বাঙালিরা কি এখনাে পর্যন্ত স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যথেষ্ট রক্তদান করেনি? এত ত্যাগ, এত আত্মােৎসর্গের মাঝ দিয়ে বাঙ্গালিরা কি এখনাে অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়নি? তবে আরাে রক্ত দেয়ার জন্য বাঙ্গালিরা প্রস্তুত। কিন্তু স্বাধীনতাকে তারা বিসর্জন দেবেন না।
মুক্তি বাহিনীর গেরিলাদের আকস্মিক আর প্রচণ্ড হামলার মুখে আজ যখন ফ্যাসিস্ট ইয়াহিয়ার সৈন্যবাহিনী বিপর্যস্ত তখন বৃহৎ শক্তিবর্গ হতভম্ব হয়ে পড়েছে। আর সেনাপতি ইয়াহিয়া মরণ শয়ন থেকে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকদের আহ্বান করছেন।
হেইজন্য কইছিলাম ছদর ইয়াহিয়া আবার নতুন চাল চালছেন। হেতনে আবার একটা চানছিং করছেন। যদি কোনােমতে শ্যাষ রক্ষা হয়। কিন্তুক বহুত লেইট কইর‌্যা পেলাইছেন। এ্যার মাইদ্দে বিচ্ছুগুলা লাড়াই-এর সব কিসিমের মাইর শিইখ্যা লাখে লাখে ময়দানে নামতে শুরু করছে।

সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল