২৩ জুন ১৯৭১
আজ থেকে সতেরাে বছর আগেকার কথা। আমি তখন ঢাকার দৈনিক ইত্তেফাকের রিপাের্টার। পূর্ব বাংলায় প্রথম সাধারণ নির্বাচন। তাই চারদিক একেবারে সরগরম। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারকে অক্করে কেচকি মাইরা চিৎ করণের লাইগ্যা মরহুম শেরে বাংলা ফজলুল হক, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী আর মরহুম হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী মিলে একটা যুক্তফ্রন্ট গঠন করলেন। প্রথম দিকে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ এই যুক্তফ্রন্টকে বিশেষ আমলই দিলেন না। কেননা তখনও তারা গােয়েন্দা বিভাগের রিপাের্টের উপর ভিত্তি করে আরামসে কুয়াতে হালুয়া খাইতাছেন। হঠাৎ করে রিপোের্ট এল Position কেমন জানি এ-ক-টু-ক খারাপের দিকে কান্নি মারতাছে। অমনি নির্দেশ হলাে যুক্তফ্রন্ট নেতাদের জন্য যেসব গাইল ঠিক করা হইছে, হেগুলার কয়েকটা ছাপিয়ে দিন। পরদিন ‘আয় মেরে জান, পেয়ারে দামান, নূরে চামান, আসমানকে চাঁদ, আখোকে তারা মওলানা আকরাম খাঁর দৈনিক আজাদে ছাপা হলাে, মওলানা ভাসানী কম্যুনিস্ট, সােহরাওয়ার্দী ভারতের দালাল আর শেরে বংলা ফজলুল হক উজিরে আজম হলে পাকিস্তান বিক্রি করে ফেলবে।
এমনি একটা সময়ে সাংবাদিক হিসেবে শেরে বাংলার সঙ্গে ফরিদপুর সফরে গেলাম। বিরাট জনসভা। হক সাহেব বক্তৃতা দিতে উঠেই বললেন, ‘চোরার পুত্ চোরারা, চোরার পুত্ মুসলিম লীগে কইছে আমি নাহি পেরধান মন্ত্রী অইলে পাকিস্তান বেইচ্যা ফেলামু। আরে চোরার পুত্ চোরারা, কিছু রাখছাে যে বেইচ্যা দুইডা পয়সা পামু। পাটের দাম নামাইছাে তিন ট্যাহায়। দুনিয়ার মাইনষে কেনবে? এতাে লােকরে খাওয়াবাে কেডায়?”
আশ্চর্য, রাজনীতির কি অপার মহিমা! মাত্র সতেরাে বছর পরে ইসলামাবাদের জঙ্গী সরকার আজ পাকিস্তানকে বন্ধক রেখে দুটো পয়সার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দরজায় ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তুক যে মুহূর্তে আন্তর্জাতিক বিশ্ব টের পেয়েছে যে জঙ্গী সরকার অহন বাংলাদেশের কেদোর মধ্যে আটকা পড়ছে, আর এই গভর্ণমেন্টের অবস্থা ছক্কু মিয়ার মতাে হইছে, মানে কিনা টাকা শােধ দেওনের ক্ষমতা নাইক্যা, সেই মুহূর্তে হেগাে দিয়া বাসন মাজাইতেছে।
কি কইলেন, বাসন মাজনের কারবারটা ঠিক মতন আন্তাজ করতে পারলেন না? তয় কইতাছি হােনেন। আমাগাে ঢাকার রমনার মাইধ্যে একটা হােটেল আছিল। খুবই চালু। খাওন দিয়া সারণ যায় না আর কি? দুপুর থনে হন্ধ্যা পর্যন্ত অক্করে হাটের লাহাল। এইর মাইদ্দে একদিন এই হােডেলডার বাসন মাজুইন্যা লােগগুলাে Strike কইরা বইলাে। ম্যানেজার সা’ব গলাডার মইধ্যে এটা খ্যাকরানি দিয়া মহাজনরে কইলাে, হাজি সাব, আই দোকানদারী চলবাে কেমূতে?’
হাজী সা’বে মাথার টুপিডা ঠিক কইর্যা বহইয়া জবাব দিল।‘হেই বুদ্ধি যদি তােমার দেমাগে থাকতাে, তয় এদ্দিন ম্যানেজার থাকতানা, মালিক হইয়া যাইতাগা।
হাজী সা’বে এর হােডেলে সাবেদ আলী বইল্যা একটা লােক রাখছিল। হের কামডাই আছিল, খাওনের পর যে বেড়ায় দাম না দিয়া কাডনের চেষ্টা করতাে, হেরে ধইর্যা ফেলা। তখন কেউ হাতের ঘড়ি, গায়ের কোট বন্ধক থুইয়্যা বাড়ির থনে টাকা আনতে যাইতাে। হাজী সা’বে সাবেদ আলীর কানে কানে কি যেনাে কইলাে। হেই দিন বেলা সাড়ে এগারােটার মাইদ্দেই সাবেদ আলী তিন ব্যাডারে এক লগে লইয়্যা আইলাে। হাজী সা’ব হেগাে উপরে কোন-অ-অ চোটপাট করলাে না, খালি ম্যানেজাররে কইলাে, ‘ওই মিয়া ম্যানেজার, এলায় এই তিনডারে বহাইয়া দাও, বুঝছাে?”
“কি কইলেন? কই বহাইমু? হাজী সাহেব ধমক দিয়ে উঠলেন, ‘ধূর মিয়া হেই কামে বহাও।’ এলায় বুঝতেই পারতাছেন হের পর কি কারবারটা অইলাে। তিন বোরে সােন্দর লাইন কইর্যা পাকঘরের পাশে কলতলায় বাসন ধুইতে বহাইয়া দিলাে। হােডেলডা খুবই চালু। তাহলে বুঝতে পারতাছেন। হেরা বাসন ধুইতছে এক দিক দিয়া আর ঝুটা বাসন আইতাছে আর একদিক দিয়া। বাসনের আর শেষ নাইক্যা। তিন ব্যাডা অক্করে ল্যাড় ল্যাড়া হইয়া শেষে চিল্লাইতে শুরু করলাে, “আওর ইসরাহ্ কি কাম নেই করুংগা (আর এ ধরনের কাম করুম না)। মাফ কর দেও বাবা।
ইসলামাবাদের জঙ্গী সরকারের এখন এই অবস্থা হয়েছে। প্রথম খুবই চোটপাট ‘বঙ্গাল মুলুক্কা কারবার সব Internal Affair হ্যায়। তাই পঁয়ত্রিশ জন বিদেশী সাংবাদিককে ২৬শে মার্চ একেবারে একবস্ত্রে বের করে দিলাে আর আন্তর্জাতিক রেডক্রসের মাল বােঝাই বিমানটাকে করাচী বিমানবন্দর থেকে ফেরৎ পাঠিয়ে দিলাে। কিন্তু তিন মাসের মধ্যেই যখন বাংলাদেশের লড়াই শেষ হলাে না, আর দিন দিন। মুক্তিফৌজের গেরিলা Action জোরদার হয়ে উঠেছে, তখন সেনাপতি ইয়াহিয়ার সরকার বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মাল-পানি পাবার জন্য অক্করে ঘাউয়া হয়ে উঠেছে। পশ্চিমা দেশগুলাে এখন ইয়াহিয়া-হামিদ-টিক্কারে দিয়া বাসন মাজাইতাছেন। পহেলা কইলাে, দুই দল সাংবাদিকরে বাংলাদেশ ঘুরতে দিতে অইবাে- ‘রাজি। বিশ্ব ব্যাংক প্রতিনিধি দল ঢাকা, চিটাগাং, খুলনা Tour করবাে-রাজি। জাতিসংঘের লােকজন অফিস করবাে- ‘রাজি। আওয়ামী লীগ, মুক্তিফৌজ হগুগলরে ভাইসাব কইয়্যা ডাইক্যা। রেডিওতে বক্তৃতা দাও- কবুল।’; ঢাহার থনে কারফিউ উড়াইতে অইবাে- রাজি। বৃটিশ পার্লামেন্টোরি ডেলিগেশন আইবাে- রাজি। বিদেশী সাংবাদিকরা ইচ্ছামতাে সফর করবাে- ‘রাজি। বাঙালি শরণার্থীদের ফেরৎ আননের লাইগ্যা Reception counter খুলতে অইবাে- ‘অহনই রাজি। বাংলাদেশের সমস্যা, বিশ্ব সমস্যা-হ-অ রাজি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিতে হবে- ‘হেডাও রাজি। না, না, না, থুকুমুক্তিফৌজের মাইর আর একটুক কড়া অইলেই এর জবাবটাও কইতে পারমু।
ভাই সাবরা এলায় কিছু মাল-পানি ঝাড়ুন। আর যে পারি না। দড়া অহন খালি খিছবার লাগছে। কিন্তুক বাসন ধােওনের আর শেষ নাই। এতাে কিছু করণের পরেও Aid-Pakistan Consortium-এর মিটিংটা পিছাইয়া দিলাে। এলায় করবাম কি?
তাই বলেছিলাম, ইয়াহিয়া, হামিদ, টিক্কা অহন সাবেদ আলীর হাতে ধরা খাইছে। বাসন মাজতে মাজতে তিনডা ব্যাডায় অক্করে ল্যাড় ল্যাড়া হইয়্যা চিল্লাইতাছে, “আওর ইসরাহ্ কি কাম নেই করুংগা। মাফ কর দেও বাবা।
সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল