১ জুলাই ১৯৭১
এগুলা কি কারবার হইতাছে? আইজ আটানব্বই দিন ধইর্যা বাংলাদেশে তুফান Fight করতাছি, তবুও এ লড়াই-এর একটা হিল্লে হলাে না? আমি ইয়াহিয়া খান একবারও কইতে পারলাম না যে, সমস্ত বাংলাদেশ অক্করে জয় কইর্যা ফেলাইছি। কেবল একটা কথাই বার বার কইর্যা চিল্লাইতাছি, Situation Normal-অবস্থা সম্পূর্ণ আয়ত্বের মধ্যে এসে গেছে। কিন্তু আমি তাে Report পাইতাছি হেইখানে অহন কি করবারটা চলতাছে? পিআইএ-এর মধ্যেই ছয়শ’ একানব্বইডা অফিসারের লাশ ঢওয়াইছে। আর (জাহানগাে তাে আল্লারওয়াস্তে লিল্লাহ কইরা দিছি। কত কষ্ট কইরা পাকিস্তানে এইসব ঋণা চাপিস করতাছি। এদিকে পাকিস্তান স্টেট ব্যাংকটারে তাে গাং করছি, একশ’ টাকা পাচশ’ টাকার নােট বেআইনী করছি, নতুন ট্যাক্স বহাইছি, ডাক মাশুল বাড়াইছি, চেক ভাঙ্গাইলে- ড্রাফট বানাইলে পহা লইতাছি, তবু তবুও কোনাে কিনারা করতে পারতাছি।
সেনাপতি ইয়াহিয়ার অহন মনডা খুবই খারাপ। খালি ফিসৃফিস্ করে বলছেন, এই কাল্প এলায় হাইরা যা, অনেকক্ষণ তাে হইছে।)
কি কইলেন? কেইডা ঠিক মতন বুঝতে পারলেন না? তয় কইত্যাছি হুনেন। একবার বরিশাল গিয়েছিলাম। শীতকাল। আলেকান্দায় পাড়ার ছেলেরা সব নাটক করছে। নিজেরাই লিখে একটা ঐতিহাসিক নাটক অভিনয়ের ব্যবস্থা করেছে। সময় কাটাবার জন্য একটা ব্যাপার মুড়ি দিয়ে হাজির হলাম। একটা দৃশ্যে দেখলাম অক্করে তুফান কারবার। দর্শকদের কেউই আর সিটে বসে নেই। সব্বাই চিৎকার করতে শুরু করেছে। দৃশ্যটাতে সুন্দর হ্যাংলা চেহারার নায়ক বিরাট স্বাস্থ্যবান প্রতি-নায়কের সঙ্গে মল্লযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। নাটকে লেখা আছে কিছুক্ষণ লড়াই-এর পর নায়ক তার প্রতিদ্বন্দ্বীর বুকের উপর চেপে বসে বিজয় উল্লাস করছে। কিন্তু নাটক অভিনয়ের সময়। এক কুফা অবস্থার সৃষ্টি হলাে। সুদর্শন নায়ক নিচে চিৎ হয়ে পড়ে আছে আর ফিস ফিস করে বলছে, এই কালু এলায় হাইর্য যা। অনেকক্ষণ তাে হইছে। আর মােটাসােটা লােকটা নায়কের বুকের উপর বইস্যা জোরে জোরে চিল্লাইতছে ‘পারলে ফালাও- কেমন বেডাখান দেখুম।
বাংলাদেশের কেদো আর প্যাকের মধ্যে এখন এরকম একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। মুক্তিফৌজের কেকা মাইরের চোটে হানাদার ফৌজ চিত্তর হইয়া ফিস্ ফিস্ কইর্যা কইতাছে, এলায় হাইরা যা, অনেকক্ষণ তাে হইছে। কিন্তুক ইসলামাবাদের জঙ্গী। সরকারের জানা উচিত এটা নাটকের অভিনয় নয়- এটা হচ্ছে বাস্তব সত্য। ১৯৫১ সনে। যেখানে আধা ডিভিশন সৈন্য রাইখ্যা কাম হইছিল, ১৯৭১ সনে সেখানে পাঁচ ডিভিশনেও কোনাে কাম হইতাছে না। কেমন বুঝতাছেন- মাসে কতদিন যাইতাছে? কোবানীর চোটে অহন কান্দলে কি অইবাে? চিয়াংকাইশেকের তাে ফরমােজায় জায়গা হইছিল, কিন্তু আপনাগাে লাইগ্যা তাে বঙ্গোপসাগর ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাইতাছি না।
একদিনের রিপাের্ট দিতাছি। রংপুরে তিন জায়গা থনে মুক্তিফৌজ গেরিলাগাে কোবানীর চোটে হানাদার সৈন্য ভাগছে। হেগাে Moral খুব Strong কিনা? সে কি দৌড়? ঢাকার ইসলামপুরে ভীড়ের মধ্যে 2 (A) টাউন সার্ভিসের বাস আটকে গেলে যেমূতে কইর্যা বাসের কন্ডাক্টর বাস থুইয়া দৌড়ে সদর ঘাট যাইয়া হাজির হইয়া কয়, ‘আইয়্যা পড়ছি’- ঠিক একইভাবে এই হানাদার সৈন্যরা এক দৌড়ে রংপুরের টাউনের কামাল কানায় হাজির হইছে। কিন্তুক যা গেছিল হেই নাম্বার ফেরৎ আইতে পারে নাই। বাকিগুলা পড়ল তুলছে।
রংপুরের অমরখানাতেও একই অবস্থা হয়েছে। আর রংপুর থনে মাত্র তিরিশ মাইল উত্তরে হাতিবান্ধা আর বড়খাতাতে আহা-রে কি মাইর! মাইরের চোটে ভাগনের সময় গুলি- মেসিনগান, ট্রাংক, স্যুটকেস- এমন কি নীলাে আর সাবিহার ফটো পর্যন্ত লওনের টাইম পায় নাইক্যা। | কথা নেই বার্তা নেই মুক্তিফৌজের গেরিলারা ঠাকুর গাঁ-এর পূব দিকে হানাদার সৈন্যদের একটা ফাঁড়ি অক্করে ডাবি কইর্যা ফ্যালাইছে।
সিলেটের জাফলং আর সােনাপুরায় হানাদার বাহিনী একবারে তক্তা হয়ে গেছে। যশাের সেক্টরের কথা আর কওন যায় না। মুক্ত এলাকায় হামলা করণের লাইগ্যা হেগাে চিরকিৎ হইছিল। মাত্র বারাে ঘণ্টার লড়াই। তারপর হেরা আর ভাগােনেরও টাইম পাইলাে না। হগলেই রইয়্যা গ্যালাে। হেগাে আর দৌড়াইয়া ভাগােনের কষ্ট করতে হয় নাই।
কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় হানাদার সৈন্যরা তিনটা মােটর বােটে মউতের খোঁজে বেরিয়েছিল। হ-অ-অ মউতের’ লগে হেগাে মমালাকাত হইছে। অহন তিনডা মোেটর বােটের মাইদ্দে জয় বাংলার ফ্ল্যাগ উড়তাছে।
এতাে কইর্যা না করলাম। যাই না। হেই রাস্তায় যাই না। হাতি যেমন বরই গাছ তলায় যায় না- তােমরাও হেই রকম হেই রাস্তায় যাইয়াে না। নাঃ আমার কথা হুলাে না। অহন মাইরের চোটে চোখে সর্ষে ফুল দেখতে শুরু করছে। কুমিল্লা, রাজশাহী, বগুড়া আর ফরিদপুরের কথা হুনলে বাকিগুলা ডরাইবাে। তাই আজ আর বেশি খবর দিমু না। মাইর খাওনের আগেই যদি ভাগে?
সেই জন্য বলেছিলাম, সেনাপতি ইয়াহিয়া অহন চেইত্যা গেছেন আর চিল্লাইয়া কইতাছেন, ‘এগুলা কি কারবার হইতাছে? আইজ আটানব্বই দিন ধইর্যা বাংলাদেশে তুফান Fight করতাছি, তবুও এ লড়াই-এর একটা হিল্লে হলাে না?
সেনাপতি ইয়াহিয়া অহন চিৎ হইয়া ফিস্ ফিস্ কইর্যা কইতাছেন, ‘এই কালু এলায় হাইর্যা যা, অনেকক্ষণ তাে হইছে। এলায় হাইর্যা যা’।
সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল