You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.10 | চরমপত্র - সংগ্রামের নোটবুক

১০ জুলাই ১৯৭১

আইজ একটা ছােট্ট গল্পের কথা মনে পড়ে গেল। আমাগাে মহল্লার মাইদ্দে ছলিমুদ্দিন বইল্যা একজন মানুষ আছিলাে। বেডায় গাং-এর হেই পার বিয়া করছিল। একদিন হাউড়ীর কাছে হুনলাে হের একজন বড় শালী আছে। বারাে বচ্ছর আগে হেই শালীর বিয়া হইছিল। কিন্তুক বিয়ার পর থনে হেরে আর মায়ের কাছে আইতে দেয় নাইক্যা।
এই কথা হুইন্যা ছলিমুদ্দিন শালীর বাড়ি রওনা হইলাে। বড় শালীর বাড়িতে তার খুবই খাতির। ছলিমুদ্দিনও বুবু কইতে অজ্ঞান। পরদিন জুম্মার নামাজ বাদ ছলিমুদ্দিন কইলাে, ‘বুবু তােমার পােলাডারে লইয়া আমি একটু হাটে যামু।’ বুবু কইলাে, এই কামড়া কইরাে না- হেরে সামলাইতে পারবা না।’ ছলিমুদ্দিন মহাগরম; ‘এইটুক্ একটা পোেলারে সামাল দিতে না পারলে আমার নাম ছলিমুদ্দিন না জহিরউদ্দিন?’
বিরাট হাট। ছলিমুদ্দিন পােলার হাত ধইর্যা খুবই হিসাব কইর‌্যা চলতাছে। হঠাৎ বড় বড় কই মাছ দেইখ্যা কেনার সখ হইলাে। নিচু হইয়া অনেক দরাদরির পর মাছ। লইয়্যা দ্যহে কি পােলায় নাইক্যা। ছলিমুদ্দিন চাইর দিক অন্ধকার দেখলাে। এলায় উপায়? বুবুর কাছে জবাব দিমু কি? ভালাে কইর‌্যা ঠাহর কইর‌্যা দ্যাহে কি; ছলিমুদ্দিন। পােলাড়ার নামডা পর্যন্ত জানে না। তাই পােলাডার নাম ধইর্যাও চিল্লাতেইও পারতাছে না । অনেক খোঁজাখুঁজি আর চিন্তা করণের পর ছলিমুদ্দিনের মাথয় একটা জব্বর প্ল্যান। আইলাে। গরু হাটের পাশে একটা বাঁশের মাচাং-এর উপর খাড়াইয়া ছলিমুদ্দিন চিল্লাইতে শুরু করলাে, আমি কার খালুরে? হুনছেন নি, আমি কার খালুরে?’ কেমন বুঝতাছেন ছলিমুদ্দিনের কারবারটা। বড় শালীর পােলা হারাইয়া চিল্লাইতাছে, আমি কার খালুরে?”
সেনাপতি ইয়াহিয়া অহন ছলিমুদ্দিন হইছে। বাংলাদেশের গাড়ার মাইদ্দে ঠ্যাং। আটকানাের পর অহন পিকিং-ওয়াশিংটনরে ডাইক্যা কইতাছে, আরে হুনছেন নি? আমি কার প্রেসিডেন্টরে? আমি কার প্রেসিডেন্টরে?’
এদিকে করাচীতে রােশেন আলী ভীমজী অহন ভিমরি খাইয়া হুইত্যা আছেন। কি কইলেন? ভীমজী সা’বরে চিনলেন না? তয় কই হােনেন। রােশেন আলী ভীমজী হইতাছেন ইস্টার্ন ফেডারেল ইস্যুরেন্স কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেকটর। এই কোম্পানির রেজিস্টার্ড অফিস চিটাগাং-এ হইলে কি হইবাে- হেড অফিস করাচী। চব্বিশ বছর। ধইর্যা বাঙালিগাে প্রিমিয়ামের হগল পহা হেতাইনে করাচীতে পাচার কইর‌্যা তুলার ব্যবসাতে খাড়াইতাছে। এর মাইদ্দে আবার ভীমজী সা’বে মেলেটারির জেনারেলগাে দোস্ত বানাইছিল- যদি কিছু মাল-পানি পাওন যায়?
সবুর, সবুর ডরাইয়েন না- অখনই Explain করতাছি। ভীমজী সা’বে জেনারেল গগা শরাবন তুহুরা খাওয়াইয়া একটা চিঠির কোণার মাইদ্দে হেগাে দিয়া ইয়েচ’ লিখ্যা লইলাে। হেরপর সােলজারগাে গ্রুপ ইস্যুরেন্সের নাম কইর‌্যা বচ্ছর ঘুরলেই মাল-পানির ব্যবস্থা করলেন। কোম্পানির ডিরেকটররা সব আলহামদু লিল্লাহ কইলেন। দিনকাল ভালােই কাটতাছিল। কিন্তুক সন ১৯৭১ মার্চ পঁচিশ তারিখে সেনাপতি ইয়াহিয়া সা’বে মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মাইদ্দে বাঙালিগাে ঠাণ্ডা করণের জন্যি বাংলাদেশে সােলজার নামাইলাে। ব্যাইস্। হাতি অক্করে দৌড়াইয়া আইস্যা ক্যাদোর মাইদ্দে হান্দাইলাে। সারগােদা, রিসালপুর, কোহাট, কোয়েটা, লাহোের আর রাওয়ালপিণ্ডির অফিসার্স মেসে যেসব পােলাগুলাে স্যুট পিনৃদ্যা বিলিয়ার্ড খেলতাছিল, তারা হাওয়াই জাহাজে আইস্যা।
মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, রংপুর, দিনাজপুর, সিলেট, চট্টগ্রাম আর টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহে কাফনের কাপড় পিন্দলাে আর জঙ্গী সরকারের ফাইটিং ফোর্সগুলাে না থাউক কমু না। অহন ভীমজী সাবের কথা আবার কই। হেতাইনে Top ছিক্রেট লেখা আর গালা দিয়া সিলমােহর করা একটা চিঠি পাইছে। বিসমিল্লাহ বইল্যা চিঠি খােলনের লগে লগে একটা আওয়াজ হইলাে, ভীমজী সাবে ভিমরি খাইছে। | ছক্কু মিয়া কইলাে, ‘আবে এই-ই কালু, খকা অন্দর কেয়া লিখুখি রে? কালু মিয়া গলা খ্যাকরাণী দিয়া থু ফালাইলাে, আংরেজি মে লিখুখি।’
বেশি না দশ হাজার। মাত্র দশ হাজার হানাদার ফৌজের মউত আর ঘাউয়া জখমী গাে লাইগ্যা ইয়াহিয়া সা’বে ইস্যুরেন্সের টাকা চাইছে। লাশ পিছু দুই হাজার টাকা কইর‌্যা ধরলে ‘দো ক্রোড় রুপেয়া।’ বিশ লাখের কোম্পানি। কিন্তু অউগগা Demand দুই কোটি। কি হইলাে ভীমজী সা’ব? আর সােলজার গাে গ্রুপ ইস্যুরেন্স করবেন না? অহন বন্দর রােডের হেড অফিসের উপর লাল ফ্ল্যাগ তুললে কি অইবাে? কার পাল্লায় পড়ছেন। বােঝেন নাই তাে?
ভীমজী সা’বে কাঁপতে কাঁপতে একটা জবাব লিখ্যা পাকিস্তান অবজার্ভার আর মর্নিং নিউজের Cutting পাড়াইছে। ইয়াহিয়া সা’বে কইছে এইডা তাে যুদ্ধ না, এইডা হইতাছে Internal Affair. রাওয়ালপিণ্ডির মিলিটারি হেড কোয়াটার্স মহা গরম। তাইলে কিন্তু আসল Demand কইরা দিমু। জেনারেল নিয়াজীর বুদ্ধিমতাে অনেকগুলায় সােলজার তাে কলেরা আর নিমােনিয়া রােগে মরছে বইল্যা দেখানাের পর লিস্টি কমাইয়া দশ হাজার করা হইছে। নাঃ নাঃ নাঃ দেরী করন যায় না। শিগগিরই মাল-পানি ঝাড়াে। এর মাইদ্দেই লাহাের-রাওয়ালপিণ্ডিতে বােরখা-ওয়ালীগাে চাইরড়া মিছিল হইছে।
হ-অ-অ-অ এইদিকে এইগুলা কি হুনতাছি। মেহেরপুর থনে হানাদার ফৌজ সাম্। অহন মেহেরপুর টাউনের মাইদ্দেই Fight হইতাছে। আর হেগাে ভাগােনের জায়গা নাইক্যা। এ্যার মাইদ্দে সােলজারগাে মওলবী সা’বও ভাগছে। তাই হেরা ইয়া আলী কইয়্যা ক্যদোর মাইদ্দে হুইত্যা পড়তাছে। মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা চীনা রাইফেল ও ওয়্যারলেস সেট আর আমেরিকান মর্টার ও এল.এম.জি. পাইয়্যা মহাখুশি। আহারে, ধাওয়াইয়া কি আরাম রে! বেশি না মেহেরপুরে গেরিলারা পঞ্চান্নটা হানাদার সৈন্যের। লাশ পাইছে। রংপুর, দিনাজপুরে, সাতক্ষীরা, সিলেটে একই রকম কারবার চলতাছে। এদিকে টাঙ্গাইলের রিপাের্টে হাম না কাঁদবাম। হেইখানে ছ্যাল কুত কুতু, ছ্যাল কুত্ কুতু, ছ্যাল কুত্ কুতু- মানে কিনা হা-ডু-ডু খেলা শুরু হইছে। কাদেরিয়া বাহিনী যখনই টের পাইছে যে, নরসিংদী-কুমিল্লার হেইদিকে কি যেনাে একটা কারবার হওনের ঠ্যালায় টাঙ্গাইল থনে কিছু সােলজার হেইদিগে গ্যাছে গা, বাইস কাদেরিয়া বাহিনী জঙ্গল থনে। বাইরাইয়া গাবুর মাইর। এক চোটে হানাদার বাহিনীর ৭৭ জন সােলজার আর পুলিশ আজরাইল ফেরেশতার দরবারে যাইয়্যা হাজির হইলাে।
এই খবর পাইযা নিয়াজী সা’বে ময়নামতী ক্যানটনমেন্ট থনে কিছু সােলজার আনলাে। ব্যাস, কুমিল্লার জাঙ্গালিয়াতে ঘ্যাটাঘ্যাট, ঘ্যাটাঘ্যাট-কি জানি একটা ব্যাপার। হইয়্যা গেলােগা। কুমিল্লা টাউনে কারফিউ, Blackout দুইভাই হইলাে আর এই দিকে কাদেরিয়া বাহিনী যহন দেখলাে দখলদার বাহিনী, ট্যাংক, মর্টার লইয়্যা আইতাছে, তখন টাঙ্গাইল টাউনে ৪৮ ঘণ্টার কারফিউ দিয়া আবার জঙ্গলের জায়গা মতাে যাইয়া বইলাে। ইয়াহিয়া সাবের সােলজার, টাঙ্গাইলে আইয়া দ্যাহে কি, মুক্তিবাহিনী তাে নাই-ই, রাস্তাঘাটে মানুষ পর্যন্ত নাই। কেইসটা কি? অনেক কষ্টে জনা দুই দালাল খুঁইজ্যা জানতে পারলাে গেরিলারা কারফিউ দিয়া গ্যাছেগা। হেইর লাইগ্যা রাস্তায় কোনাে মানুষ নাইক্যা। লগে লগে হেগাে চান্দি গরম হইয়া গেলােগা। হেরা চিল্লাইয়া কইলাে, ইয়ে কারফিউ তােড়াে। ইয়ে কারফিউ ঝুট হ্যায়।’
ক্যামন দিনকাল পড়ছে? মেলেটারি কারফিউ ভাঙ্গতে চাইতাছে আর পাবলিক কারফিউ মানতে চাইতাছে। কবে না জানি হুনুম গেরিলারা কাপড় পিন্ধ্যা আছে দেইখ্যা ইয়াহিয়া সাবের সােলজাররা আর কাপড় পিনুবাে না। হেরা আদম হইয়া ফাইট করবাে। হেইদিনের কথা চিন্তা কইর‌্যা বুক আমার অক্করে ফাটফাট করতাছে।

সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল