২৮ মে ১৯৭১
ঠ্যালার নাম জশমত আলী মােল্লা। সেনাপতি ইয়াহিয়া এখন ঠ্যালার মুখে পড়েছেন। কেননা বিদেশী মারণাস্ত্রে বলীয়ান হয়ে ইয়াহিয়ার ইঙ্গিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তার সমস্ত শক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েও বাংলাদেশকে দখল করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই ইয়াহিয়ার এখন চিড়ে চ্যাপ্টা অবস্থা। হাজার হাজার হানাদার জওয়ানদের হতাহত হবার সংবাদ এখন পশ্চিম পাকিস্তানে পৌছানাের সঙ্গে সঙ্গে সেখানে দারুণ উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। সেখানকার সংবাদপত্রের উপর পূর্ণ সেন্সরশিপ থাকা সত্ত্বেও এরা বিদেশী সংবাদপত্রে প্রকাশিত কিছু কিছু খবর পুনর্মুদ্রিত করাতেই এই বিদিকিছুছি অবস্থা দেখা দিয়েছে। এছাড়া প্রতিদিনই পি,আই,এ, বিমানে পাকিস্তান সামরিক অফিসারদের লাশ পশ্চিম পাকিস্তানে তাদের আত্মীয়স্বজনদের কাছে পৌছাচ্ছে বলে পরিস্থিতি আরাে জটিল হয়ে উঠেছে। লাহােরের ‘মিয়ানী সাহেব কবরস্থানে রােজই বাংলাদেশ থেকে এসব নিয়ে আসা লাশ দাফন করা হচ্ছে। তাই আজ পাঞ্জাবের ঘরে ঘরে কান্নার মাতম্ পড়ে গেছে।
সেনাপতি ইয়াহিয়া এ অবস্থার মােকাবিলা করতে যেয়ে সেখানকার সংবাদপত্রের উপর দারুণভাবে ক্ষেপে গেছেন। এমনকি লাহােরের সরকার পরিচালিত পাকিস্তান টাইমস এবং ইমরােজ, জামাতে ইসলামীর নওয়ায়ে ওয়াক্ত’ আর ভুট্টো সমর্থক ‘মুসাওয়াৎ’ পত্রিকার উপর সামরিক বিধি জারি করেছেন। কেননা এসব কাগজগুলাে বাঙালি হত্যার ষড়যন্ত্র জি হুজুরের মতাে সমর্থন করলেও, এদের প্রােপাগাণ্ডা লাইনটা গড়বড় হয়ে গেছে। আর এর ফলেই পশ্চিম পাকিস্তানে একথা ফাঁস হয়ে গেছে যে, বাংলাদেশে মুক্তিফৌজের হাতে হানাদার সৈন্যরা বেধড়ক মাইর খাচ্ছে। আর এ ধরনের গাবুর মাইরের চোটে পাক সেনারা একেবারে ঘাউয়া’ হয়ে উঠেছে।
তাই সেনাপতি ইয়াহিয়া এখন লাহােরের চারটা সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সামরিক আইনে বিচারের কথা ঘােষণা করেছেন। হায়রে দালালী! যার লাইগ্যা চুরি করি সেই কয় চুর’। নিয়তির বিধান কে খণ্ডাতে পারে! ইয়াহিয়ার সমস্ত দালালদের খুব শিগগিরই এ ধরনের অবস্থায় পড়তে হবে।।
এদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের যেসব শিল্পপতি আর ব্যবসায়ীর দল মাত্র মাস দুয়েক আগেও হত্যালীলা চালিয়ে বাংলাদেশের বাজার ঠিক রাখার উদ্দেশ্যে জেনারেল ইয়াহিয়াকে সমর্থন জানানাের জন্য প্রাণ জারে জার করেছিল, তারা এখন নাখােশ হয়ে উঠেছেন। কেননা গত দু’মাস ধরে পশ্চিম পাকিস্তানের কোনাে শিল্পজাত দ্রব্য আর বাংলাদেশের বাজারে পাঠানাে সম্ভব হয়নি। সেখানকার মিলের গুদামগুলাে তৈরি মালে পাহাড় হয়ে রয়েছে। ফলে শ্রমিক ছাটাই শুরু হয়ে গেছে। এছাড়া অনেকগুলাে কলকারখানা বাংলাদেশের কাঁচামালের অভাবে লালবাতি জ্বালিয়েছে।
পাকিস্তানের বৈদেশিক বাণিজ্যে এক ভয়াবহ রকমের ‘গ্যানজাম’ দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ থেকে কাঁচাপাট আর পাটজাত দ্রব্যের রফতানী একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে । চা আর চামড়ার সরবরাহ নেই বললেই চলে। তাই বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকা থেকে গত দু’মাস ধরে কোনাে রফতানী না হওয়ায় পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে এক মারাত্মক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে। আর এরই ফল হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানে বিদেশী জিনিষপত্র আমদানী দারুণভাবে নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে। শুধু তাই-ই নয়, লজ্জার মাথা খেয়ে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা পরিস্কারভাবে বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছে যে, আগামী নভেম্বর মাসের আগে পাকিস্তানের পক্ষে ধার পরিশােধের কোনাে কিস্তি দেয়া অসম্ভব।
এমনকি সুদ পর্যন্ত পরিশােধ করা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশে যুদ্ধ চালাতে যেয়ে পাকিস্তান সরকারকে প্রতিদিন দেড় কোটি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে বলে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তাই সেনাপতি ইয়াহিয়ার চ্যালা এম.এম. আহম্মদ ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে যেকোনাে শর্তে পশ্চিমা দেশগুলাে থেকে টাকা ধার নেয়ার জন্যে এখন দরজায় দরজায় ‘ল্যালপার মতাে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোনাে কোনাে দেশ অবিলম্বে বাংলাদেশের সঙ্গে একটা রাজনৈতিক সমঝােতায় আসার জন্য পরামর্শ দেয়ায় আহম্মদ সাহেব তার মুনিব সেনাপতি ইয়াহিয়ার কাছে জরুরি আঞ্জম পাঠিয়েছেন। আর অমনি ‘সােনার চাদ পিতলা ঘুঘু’ ইয়াহিয়া ঘােষণা দিয়েছেন যে, হে আমার বেরাদারানে বঙ্গাল, আপনারা যারা সীমান্তের ওপারে চলে গেছেন, তাঁরা তখলিফ করে হানাদার দখলকৃত এলাকায় ফিরে আসুন। পাক সেনারা বাংলাদেশের শহর এলাকায় হত্যা করার মতাে নিরস্ত্র লােকদের হাতের কাছে না পেয়ে পেরেশান হয়ে উঠেছে। কিন্তু দিন কয়েক অপেক্ষা করেই খান সাহেব বুঝলেন যে, হঁ্যা কিছু বাঙ্গালি দখলকৃত শহরগুলাতে ফিরে এসেছে বৈকি। তবে তাঁরা নিরস্ত্র নয়- তারা হচ্ছেন সশস্ত্র গেরিলা যােদ্ধার দল। সাদাপাকা মােটা ভ্র দুটো খান সাহেবের আবার কুঁচকে উঠলাে। একটা সাংবাদিক সম্মেলন আহ্বান করে বললেন, স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এলেই ‘দেশপ্রেমিক নির্বাচিত সদস্যদের হাতে ক্ষ্যামতা হস্তান্তর করা হবে। কেন আবার কি হলাে? পরাজিত রাজনৈতিক নেতাদের হাতে ক্ষমতা দেওয়ার ক্ষ্যামতা হলাে না? এইনা বলে বাংলাদেশে ক্ষমতা নেয়ার মতাে কেউই নেই? এই না বলে আওয়ামী লীগাররা রাষ্ট্রদ্রোহী- আওয়ামী লীগারদের হাতের কাছে পেলে শির কুচাল দেঙ্গা? তাই আওয়ামী লীগ বেআইনী ঘােষণা করেছাে? তাহলে আবার দেশপ্রেমিক আওয়ামী লীগারদের খুঁজে বেড়াচ্ছ কেন?
হায়রে ইয়াহিয়া! কত কেরামতি না তুমি জানাে! বাম্বু চেনাে? এখন বুঝি বায়ু এসেছে। আর সেই বায়ুর ঠ্যালায় কেরামতি দেখাচ্ছাে? কিন্তু বাপধন- ময়না আমারকোনাে কেরামতিই যে আর কাজে লাগবে না। এখন বুঝি চান্দি গরম হইছে। আর হেই গরম চান্দি লইয়া পাগল অইয়া তুমি আবােল তাবােল কইতাছে! কিন্তু একটা কথা কইয়া দেই- ঠ্যালা চেনাে? হেই রাম ঠ্যালার নাম কিন্তুক জশমত আলী মােল্লা বুঝছাে?
সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল