You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.04 | চরমপত্র - সংগ্রামের নোটবুক

৪ জুন ১৯৭১
সেনাপতি ইয়াহিয়ার জঙ্গী সরকার এখন বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকায় এক ‘বিদিকিছুছি’ অবস্থায় পড়ে গেছে। কেননা বহু তেল পানি খরচ করে ইয়াহিয়ার পরামর্শদাতা এম.এম. আহম্মদ বিশ্ব ব্যাংকের একটা ছয় সদস্য মিশনকে দাওয়াত করে এনেছেন। এই মিশন এখন সরেজমিনে বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকার অর্থনৈতিক পরিস্থিতির পর্যলােচনা করছেন। এম.এম. আহম্মদ নিউ ইয়র্কে বড় গলায় বলে এসেছিলেন যে, বাংলাদেশের পরিস্থিতি এখন সম্পূর্ণ আয়ত্বাধীনে আর অবস্থা শান্ত হয়ে গেছে। বিশ্ব ব্যাংকের সাহায্য পেলেই প্রাচুর্যের জোয়ার এসে যাবে। বিশ্ব ব্যাংক মিশন ঢাকায় এসে ভিরি খেয়েছেন। তেজগাঁও বিমানবন্দরের চেহারাটা একেবারে ভিয়েতনামের নিউ বিমানবন্দরের মতাে মনে হচ্ছে। চারদিকে বিমানবিধ্বংসী কামানগুলাে আকাশের দিকে হা-করে তাকিয়ে রয়েছে। আর অজস্র বাংকার তৈরি করে হানাদার সৈন্যরা তাদের স্বদেশের পালিয়ে যাবার একমাত্র বিমানবন্দরটা পাহারা দিচ্ছে। আশেপাশে কোনাে বেসামরিক লােক নেই বললেই চলে। খালি দলে দলে আর্মি জওয়ানরা মার্চ করে যাচ্ছে।
একটু খবর নিয়েই বিশ্ব ব্যাংকের সদস্যদের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। বাংলাদেশের বেশির ভাগ এলাকাতেই কোনাে ট্রেন চলাচল করছে না। দু’একটা জায়গায় হানাদার সৈন্যরা অনেক কষ্টে ট্রেন সার্ভিস চালু করেছিল। কিন্তু মুক্তিফৌজের গেরিলা Action-এ তাও বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অসংখ্য ব্রিজ আর Culvert ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। রাস্তাঘাটগুলাের অবস্থা আরও কুফা হয়ে রয়েছে। Inter District-ট্রাক-সার্ভিসগুলাে অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দর দুটো বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে। সেখানকার ডকগুলেতে কোনাে শ্রমিক নেই বললেই চলে। হানাদার বাহিনী বিপুল বিক্রমে নিরস্ত্র ডক শ্রমিকদের হত্যা করাতেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এখন সেই হানাদার বাহিনী আবার ডক শ্রমিক খুঁজে বেড়াচ্ছে। কী করুণ। অবস্থা।
আর এদিকে আভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন সংস্থার কর্মচারীদের কাজে যােগ দেয়ার জন্যে আবার আহ্বান জানানাে হয়েছে। গত দশ সপ্তাহে এবার দিয়ে ছ’বার এ ধরনের আবেদন করা হলাে। এবারের আবেদনে আগের মতােই ভয়াবহ শাস্তি দেয়া হবে বলে শাসানাে হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ, তেজগাঁ আর টঙ্গীর শিল্প এলাকার খবর নিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের সদস্যদের আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেছে। তিন পার্সেন্ট। অর্থাৎ কিনা শতকরা তিন ভাগ শ্রমিক কাজে যােগ দিয়েছে। অবশ্য এদের কেউই বঙ্গভাষী নয়। এদের এখন একটাই Duty, সেটা। হচ্ছে তেল দেয়া। অর্থাৎ কিনা মিলের যন্ত্রপাতিগুলােতে যাতে জং না পড়ে তার ব্যবস্থা। করা। তাই বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকার কলকারখানাগুলাের চাক্কা বন্দু। অবস্থা বেগতিক দেখে হানাদার সৈন্যের একটা দল রফতানী ব্যবসায়ে নেমেছেন। সে এক অদ্ভুত ব্যাপার! ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ আর চট্টগ্রামের পাটের গুদামগুলাে লুট করে কিছু কাঁচা পাট হানাদার সৈন্যরা জাহাজ বােঝাই করে শিপিং বিল ছাড়াই বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। ব্যাস, ওইখানেই রফতানী ব্যবসার খতম-তারাবি হয়ে গেল। হাতের কাছে লুট করার মতাে আর পাট নেই- ব্যবসাও নেই।
কিন্তু ঢাকার গায়েবী আওয়াজ থেকে এই রফতানী ব্যবসার কথাই জোর গলায়। প্রচার করা হলাে। কেননা একথা শুনলেই বাংলাদেশের লোেকরা ভাববেন যে, অবস্থা একেবারে Normal হয়ে গেছে। অপূর্ব চিন্তাধারা এদের। আর এরই জন্য ঢাকার ‘গায়েবী আওয়াজ’ অফিসে এদের নােরি একেবারে পােক্ত হয়ে গেছে।
যাক যা বলছিলাম। করাচী আর লাহােরের Stock Exchange থেকে বড় দুঃসংবাদ এসে পৌঁছেছে। সেখানকার শেয়ার মার্কেট ধড়-ধড় করে পড়ে যাচ্ছে। তিন মাস ধরে বাংলাদেশের ব্যবসা বন্ধ হওয়াতেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বেশি না, এর মধ্যেই এসব ব্যবসায়ীর মাত্র চল্লিশ কোটি টাকার লােকসান হয়েছে। আর তাতেই পশ্চিম পাকিস্তানে একটার পর একটা কলকারখানা বন্ধ যাচ্ছে। এখানেই কাহিনীর শেষ নয়। মারাত্মক শ্রমিক অসন্তোষ যাতে করে পশ্চিম পাকিস্তান আচ্ছন্ন করতে না পারে, তার জন্যই বহু ট্রেড ইউনিয়ন নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ থেকে আদায় পত্র নেই বললেই চলে। ইসলামাবাদের জঙ্গী সরকার চলতি আর্থিক বছরে বাংলাদেশ থেকে প্রায় চারশ’ কোটি টাকা বিভিন্ন খাতে ট্যাকস আদায় করতে পারবে বলে যে হিসেব করেছিলেন, তা খাতা-কলমেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। তাই জঙ্গী সরকারের উন্নয়ন বাজেটের ২৩০ কোটি টাকার প্ল্যান শিকেয় তুলে রাখা হয়েছে।
পাকিস্তান একটা অদ্ভুত দেশ। প্রতি বছর এই পাকিস্তান থেকে প্রায় সাড়ে তিনশ’ কোটি টাকার মাল বিদেশে রফতানী হতাে। এর মধ্যে পূর্ব বাংলা থেকে রফতানীর পরিমাণ ছিল প্রায় দু’শ কোটি টাকা। আর বােনাস ভাউচারে বদৌলতে পশ্চিম পাকিস্তান দেড়শ’ কোটি টাকার মাল রফতানী করতাে। কিন্তু আমদানীর ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তান বছরে পাঁচশ’ কোটি টাকার মাল আমদানী করতাে আর পূর্ব বাংলাকে মাত্র পৌনে দু’শ’ কোটি টাকার দ্রব্য আমদানীর Permission দেয়া হতাে। বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতির সমস্ত টাকাটাই ইসলামাবাদের জঙ্গী সরকার পশ্চিমা দেশগুলােকে ছাড়াও চীনের হাতে পায়ে ধরে সংগ্রহ করতাে। কিন্তু এবার case খুবই খারাপ। বাংলাদেশ আক্রমণ করতেই এক নাস্তানাবুদ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তানের সঞ্চিত বৈদেশিক মুদ্রা ও রিজার্ভ সােনার পরিমাণ যেখানে ৯০ কোটি টাকা ছিল; তা এখন ৬০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। মাফ চাই মহারাজ’ বলে বৈদেশিক ঋণের কিস্তি না দিয়ে আর মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ থেকে বাকিতে মাল আমদানীর পরও অবস্থা কুফা’ই রয়ে গেছে। অবশ্য সেনাপতি ইয়াহিয়ার জঙ্গী সরকারকে চীন ১০ কোটি টাকা সাহায্য করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের যুদ্ধ চালাতেই তাে দিনে দেড় কোটি টাকা খরচ হচ্ছে।
অর্থনৈতিক পরিস্থিতির এহেন অবনতির দরুণ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাণিজ্যিক সংস্থাগুলাে পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেনের ক্ষেত্রে শতকরা একশ’ ভাগ L.C. মার্জিন দাবি করা ছাড়াও আন্তর্জাতিক ব্যাংকের গ্যারান্টি চেয়েছেন।
এদিকে পশ্চিমা অর্থনীতিবিদরা হিসেব করে দেখেছেন যেভাবে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটছে তাতে করে আগামী আগস্ট মাসের মধ্যেই ইসলামাবাদের জঙ্গী সরকার সােজা লালবাতি জ্বালাবে। তাই বৃটেন ও জাপানের বীমা কোম্পানিগুলাে পর্যন্ত পাকিস্তানে রফতানীকৃত মালের ইস্যুরেন্স করতে অস্বীকার করেছে। এমনি এক অবস্থায় সেনাপতি ইয়াহিয়ার পরামর্শদাতা এম.এ. আহম্মদ Where is your leg? বলতে বলতে বিশ্ব ব্যাংকের দরজায় একটা ডুঙ্গি হাতে হাজির হয়েছিলেন। আর সে জন্যেই বিশ্ব ব্যাংকের একটা প্রতিনিধি দল এখন হানাদার দখলকৃত এলাকা সফরে এসেছেন। অবশ্য বিশ্ব ব্যাংক জানিয়েছে যে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমঝােতা আর শন্তি ফিরিয়ে আনবার পরই কেবল মাত্র সাহায্য আর ঋণ দেয়া হতে পারে। আর একটা কথা। বিশ্ব ব্যাংক মিশনের এই রিপোের্ট দাখিল হলে নিদেন পক্ষে তিন মাস পর শর্ত সাপেক্ষে সাহায্য আসবে। ততদিন সেনাপতি ইয়াহিয়ার দম থাকলে হয়!

সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল