You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.06 | চরমপত্র - সংগ্রামের নোটবুক

৬ জুন ১৯৭১
‘অল্প শােকে কাতর আর অধিক শােকে পাথর। সেনাপতি ইয়াহিয়া এখন পরায় পাথর হয়ে গেছেন। আজকাল কারও সাথে বিশেষ বাচিত্ পর্যন্ত করছেন না। এখন বেচারার একেবারে ধান্ধা লাগার অবস্থা। কোন্ দিক রেখে কোন দিক সামলায়। অফিসে বসে টেবিলের দিকে নজর দিলেই দেখতে পাচ্ছেন, একগাদা Urgent File তার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। একটাতে রয়েছে বাংলাদেশে কয়েক হাজার সৈন্য নিহত হবার কাহিনী। পাশের ফাইলটাতে লেখা আছে আরাে কয়েক হাজারের মতাে আহত সৈন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরগুলােতে কাতরাচ্ছে। ওপাশের ফাইলটাতে রয়েছে পাকমুদ্রা Devalue করতে হবে আর কেবলমাত্র নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা দেয়ার পরই বৈদেশিক সাহায্য আসবে। এদিককার একটা ফাইলে বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশের গণঅসন্তোষের কথা রয়েছে। আশ্চর্য, সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যাপক গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়ার পরও এসব সংবাদ আসে কিভাবে?
ঐ ফাইলটা আবার কি? এ্যা- ঢাকার ৬৫ জন বাঙালি দালাল বুদ্ধিজীবীদের বিবৃতিটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনাে খবরের কাগজে ছাপানাে সম্ভব হয়নি। ওয়াশিংটন আর নিউ ইয়র্কের পাকিস্তান এমব্যাসির স্টাফগুলাে করে কি? কত চেষ্টা করে এসব দালালদের দস্তখত সংগ্রহ করা হলাে। আর মার্কিন কাগজগুলােতে তা ছাপনাে সম্ভব হলাে না? জেনারেল টিক্কার নির্দেশে হামিদুল হক চৌধুরীই তাে চমৎকার Draft টা করেছিল। এখন আমার হুকুম হচ্ছে, নিউ ইয়র্কে টাইমস পত্রিকায় বিজ্ঞাপন হিসেবে বিবৃতিটা ছাপানাে হােক।
আরে এটা আবার কি? করাচী চেম্বার অব কমার্সের চিঠি মনে হচ্ছে। এ ব্যাটাদের নিয়ে আর পারা গেল না। তােদের বাজার ঠিক রাখার জন্যই তাে বাংলাদেশ আক্রমণ করতে হলাে। যার জন্য চুরি করি সেই বলে চোর? আহঃ আবার অসময়ে টেলিফোন কেন? হ্যালাে :হ্যা কথা বলছি। কি বললে? জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল বিবৃতি দিয়েছেন?
বহু প্রচেষ্টার পরেও সেনাপতি ইয়াহিয়ার জঙ্গী সরকার বাংলাদেশে হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার কথা লুকিয়ে রাখতে পারেনি। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উথান্ট তীব্র ভাষায় ইয়হিয়া সরকারের নিন্দা করেছেন। তিনি বলেছেন, পূর্ব বাংলার ঘটনাবলি মানব জাতির ইতিহাসে এক মর্মান্তিক অধ্যায়। জাতিসংঘ সাংবাদিক সমিতির। এক মধ্যাহ্ন ভােজে উথান্ট এ বিবৃতি দিয়েছেন। ইসলামাবাদের জঙ্গী সরকার সংবাদপত্র ও বেতারকেন্দ্রগুলাের উপর পূর্ণ সেন্সরশিপ দিয়েও মানব সভ্যতার সবচেয়ে জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের কাহিনী চেপে রাখতে পারেনি। দাবানলের মতাে এসব কাহিনী বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে।
এদিকে ওয়াশিংটন থেকে এক ভয়াবহ দুঃসংবাদ এসে পৌঁচেছে। সিনেটের এডওয়ার্ড কেনেডি বলেছেন, আর কতদিন ধরে জেনারেল ইয়াহিয়ার সরকার অবস্থা স্বাভাবিক বলে দাবি করতে থাকবেন? অথচ প্রতিদিনই হাজার হাজার বাঙালি শরণার্থী সীমান্তের ওপারে চলে যাচ্ছে?
সঙ্গে সঙ্গে Agency for International Development সংস্থা ইসলামাবাদের জঙ্গী সরকারের কাছে কৈফিয়ৎ চেয়েছে? ইয়াহিয়া সরকারের বড় বড় গোঁফওয়ালা। জেনারেলরা সব মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে শুরু করলাে। হ্যাতাইনরা জানলাে ক্যামনে? সবার কপাল কুঁচকে উঠলাে। নভেম্বরের সাইক্লোনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রিলিফের মালপত্র আনা নেওয়ার জন্য যে পঞ্চাশটা বড় ধরনের যান্ত্রিক নৌকা দিয়েছিল, সেগুলাে আসল কামে না লাগিয়ে এখন বাংলাদেশে সৈন্য যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। ঢাকাকরাচী-ইসলমাবাদের বড় বড় মহরথীরা এই ব্যাপার সম্পর্কে Inquiry করে আহম্মক বনে গেছেন। ধর্মের কল নাকি বাতাসে নড়ে। রিলিফের যান্ত্রিক নৌকাগুলাে নিয়ে মওলবী সাবেরা এখন এরকম একটা অবস্থায় পড়েছেন। অদ্ভুত আর অপূর্বভাবে এই ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে। ইসলামাবাদের জঙ্গী সরকারের মাথায় হঠাৎ করে এক জব্বর প্ল্যান এসেছিল। পাকিস্তানের লােকদের বােঝাতে হবে যে, হানাদার সৈন্যরা বাংলাদেশের নদীমাতৃক বরিশাল, পটুয়াখালী আর গােপালগঞ্জ এলাকায় নির্বিবাদে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেমন চিন্তা তেমনি কাজ। নভেম্বর সাইক্লোনের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রিলিফের কাজের জন্য যে সব যান্ত্রিক নৌকা দিয়েছিল, সেসব নৌকায় হানাদার সৈন্যদের বরিশালের অভ্যন্তরে নিয়ে যাবার কয়েকটা ফটো তােলা হলাে। Special Messenger দিয়ে এসব ফটো করাচীতে এনে পাকিস্তানের বিভিন্ন কাগজে ছাপাবার ব্যবস্থা হলাে।
আমেরিকান ইনফরমেশন সার্ভিস থেকে করাচীর Dawn-এ ছাপানাে এমনি এক ছবি কেটে ওয়াশিংটনের হেড অফিসে পাঠানাে হলাে। মার্কিনী অফিসাররা ছবিটা পরীক্ষা করে আঁতকে উঠলাে। হ্যা কোনােই ভুল নেই। রিলিফের যান্ত্রিক নৌকাগুলাে পাক ফৌজরা এখন দিব্বি বাংলাদেশে ব্যবহার করছে। এখন উপায়? মার্কিন জনসাধারণের ট্যাক্সের টাকায় মানবতার খাতিরে রিলিফের জন্য এসব যান্ত্রিক নৌকা দেয়া হয়েছিল; সেসব যান্ত্রিক নৌকাই এখন ইসলামাবাদের জঙ্গী সরকার মানব নিধনের জন্য ব্যবহার করছে। তাই মার্কিন সরকার সেনাপতি ইয়াহিয়ার পাষণ্ড সরকারের কাছে এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। ইসলামাবাদের জঙ্গী সরকার ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করেনি যে সামান্য একটা ফটোর জন্য তারা এতটা হেনস্থা হবে। আরে ও ধরনের বেআইনী ও বেইনসাফী কাজ তাে হর-হামেশাই করা হচ্ছে। এদিকে এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় সাব কমিটির চেয়ারম্যান মিঃ কর্নেলিয়াস গ্যালাগার সেনাপতি ইয়াহিয়ার সরকারকে শাসিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ২৫শে মার্চ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে সামরিক সাহায্য দেয়া সাসূপেন্ড করেছে। কিন্তু অবিলম্বে পূর্ব বাংলায় বর্বর হত্যাকাণ্ড বন্ধ করে নির্বাচিত সদস্যদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে শান্ত পরিবেশের সৃষ্টি না করলে, কনসর্টিয়ামের সদস্যভুক্ত সমস্ত দেশের উপর চাপ সৃষ্টি করে ইসলামাবাদকে বেসামরিক সাহায্য প্রদান বন্ধের ব্যবস্থা করা হবে।
কেননা প্রথম দিকে আমরা ভেবেছিলাম এটা হচ্ছে পাকিস্তানের ঘরােয়া ব্যাপার। কিন্তু মানব ইতিহাসের জঘন্য হত্যাকাণ্ডের ফলে ৫০ লাখ শরণার্থী দেশ ত্যাগ করায় এখন এটা পরিষ্কারভাবে একটা আন্তর্জাতিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটায় ইয়াহিয়ার চান্দি অকরে গরম অইছে। তাই বলেছিলাম, অল্প শােকে কাতর, আর অধিক শােকে পাথর। সেনাপতি ইয়াহিয়া অহন পরায় পাথর হয়ে গেছেন।

সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল