৯ জুন ১৯৭১
১৮৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময়কার ছােট্ট একটা কাহিনী দিয়ে আজকের কথা শুরু করা যাক। আমি তখন ঢাকার ইকবাল হলের ছাত্র। ২১শে ফেব্রুয়ারি বিকেল তিনটা দশ মিনিটে মেডিকেল ছাত্রাবাসে পুলিশের গুলি বর্ষণে ছ’জন ছাত্র নিহত হলে ঢাকা শহর এক ভয়ংকর রূপ পরিগ্রহ করলাে। ঢাকার আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা যাদুমন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজের পাশে এসে দাঁড়ালাে। মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সবাই আক্রোশে ফেটে পড়লাে। সন্ধ্যার একটু আগে পলাশী ব্যারাকে রেলওয়ে ক্রসিং-এর ওপাশটায় একটা ছােট্ট রেস্টুরেন্টে বসে চা খাচ্ছিলাম। আমার পাশের টেবিলটাতে একজন বয়স্ক ঢাকাইয়া বসে বিড়ি টানছিল। এমন সময় মাইক লাগানাে একটা ভ্যান এসে হাজির হলাে। ভ্যানটার পেছনে সৈন্য বােঝাই একটা জিপ পাহারা দিচ্ছে। মাইকে ঢাকা শহরে কারফিউ জারির কথা ঘােষণা করা হলাে। ঢাকাইয়া ভদ্রলােক নিজে নিজেই বলতে লাগলেন কারফিউ দিছে, হালায় কারফিউ দিয়া ডর দেহায়। বাইশ সাল থাইক্যা কারফিউ দেখত্যাছি। কারফিউর মধ্যে মাইয়া অইছিলাে। মহল্লার মাইনষে কইলাে, মাইয়ার নাম কি থুইবা? হেই মাইয়ার নাম থুইছিলাম কারফিউ বিবি। আর আইজ কারফিউ দিয়া ডর দেহায়?”
সেই ঢাকা শহরে গত ২৫শে মার্চ থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় আড়াই মাস ধরে রােজই কারফিউ জারি রেখে সেনাপতি ইয়াহিয়ার জঙ্গী সরকার অবিরামভাবে চেঁচিয়ে চলেছে অবস্থা একেবারে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আর ঢাকার অবস্থা স্বাভাবিক বলে প্রমাণ করতে। যেয়ে টিক্কা সরকার অদ্ভুত আর অপূর্ব সব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। এরা হঠাৎ করে এক নির্দেশ জারি করে বসেছেন। ঢাকা শহরের যেসব পাকা বাড়িতে কামানের গােলার ভয়াবহ চিহ্ন রয়েছে, সেসব বাড়ির মালিকদের বাড়ি মেরামত করতে হবে। বিশ্ব জনমতের চাপে পড়ে যখন ছ’জন বিদেশী সাংবাদিককে নিয়ন্ত্রিত সফরে আনা হয়েছিল, ঠিক সেই সময় এ নির্দেশ জারি করা হলাে। কিন্তু ব্যাপারটা পুরাে Misfire করলাে। কেননা পাকা বাড়িগুলাের মালিকরা হয় হানাদার বাহিনীর শিকারে পরিণত হয়েছে, না হয় গ্রামের অভ্যন্তরে চলে গেছেন। আর সেখানে হানাদার বাহিনীর স্যাঙাত্রা দিব্বি বসে শিক-কাবাব খাচ্ছে। জেনারেল টিক্কার সাধ্য নেই এ হুকুমনামা ফিরিয়ে নেয়ার। কেননা ইসলামাবাদের নির্দেশেই এ হুকুম দেয়া হয়েছে। স্যাঙাত্রা বাড়ি মেরামতের order শুনে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে টিক্কার দরবারে হাজির হলাে। আবার হুকুম হলাে বেড়া বানাও। বাঁশের বেড়া বানিয়ে খুঁটি পুতে কামানের গােলার চিহ্নগুলাে ঢেকে রাখাে। রাতারাতি ঢাকায় বাঁশের দাম আগুন হয়ে গেল।
কিন্তু যত গণ্ডগােল বাঁধলাে ঢাকার প্রেস ক্লাবকে নিয়ে। জেনারেল টিক্কার সাগরেদরা বাড়ি মেরামতের হুকুম জারি করলাে। কেননা ২৫শে মার্চ রাতে হানাদার বাহিনীর ট্যাঙ্ক থেকে গােলা মেরে প্রেস ক্লাবের দোতলার উপরের লাউঞ্জটা গুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু একি? ক্লাবের প্রেসিডেন্ট আর সেক্রেটারি গেল কোথায়? দু’জনেই লাপাত্তা। তাই বাড়িটার original মালিকের খোঁজ পড়লাে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর দেখা গেল মালিক হাতের কাছেই রয়েছে। আর সে মালিক হচ্ছে পূর্ব বাংলা সরকার স্বয়ং। অনেক ভেবে জেনারেল টিক্কা নিজেই নিজের সরকারের উপর নােটিশ জারি করলেন। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকার হানাদার সরকারের সি এন্ড বি বিভাগ ঢাকার প্রেস ক্লাব । মেরামত করলাে। না করে উপায় নেই। বিদেশী সাংবাদিকেরা তাে এই প্রেস ক্লাবেই প্রথমে এসে হাজির হবেন।
ঢাকার বাজার ও বস্তি এলাকাগুলাে আগুন ধরিয়ে আর মেসিনগানের বেপরােয়া গুলিতে হাজার হাজার আদম সন্তান হত্যা করার পর যে ধ্বংসস্তুপগুলাে অবশিষ্ট ছিল সেসব বুলডােজার দিয়ে সমান করে দেয়া হয়েছে। যে সমস্ত জায়গা এক সময়ে জনপদের কলকোলাহলে মুখরিত ছিল, সেখানে এখন কবরের নিস্তব্দতা নেমে এসেছে।
কিন্তু এতে করেও জেনারেল টিক্কা তার নৃশংসতাকে লুকিয়ে রাখতে পারেনি। সরকার নিয়ন্ত্রিত সফর সত্ত্বেও বিদেশী ঝানু সাংবাদিকদের নজরে সব কিছুই পড়েছে। একজন লিখেছেন হানাদার সৈন্যরা এরকমই বেপরােয়া নিধন কাজ চালিয়েছে যাতে লাশ খেয়ে উদর পূর্তির পর শকুনগুলাে পর্যন্ত আর উড়তে পারছে না। খুলনাকে এখন মৃত্যুপুরী বলেই মনে হয়।
এর দিন দশেক পর আবার ন’জন বিদেশী সাংবাদিককে সরকার নিয়ন্ত্রিত সফরে আনা হলাে। জেনারেল টিক্কা এদের বললেন, সব কিছুই স্বাভাবিক হয়ে গেছে, এমন। কি স্কুলগুলাে পর্যন্ত চালু হয়েছে। হাজার হলেও সাংবাদিক। তাই একটু খোজ করতেই আসল ব্যাপারটা এঁদের চোখে ধরা পড়ে গেল। হঁা, ঢাকায় অনেক ক’টা স্কুলই খােলা হয়েছে। একজন লিখেছেন, একটা স্কুলের ছাত্র সংখ্যা হচ্ছে আটশ’ সেখানে ছাত্র হাজিরার সংখ্যা হচ্ছে বিশ থেকে তিরিশ জন; আর একটা অবাঙালি অধ্যুষিত স্কুলে ৭৫০ জন ছাত্র পড়তাে, সেখানে মাত্র ৭০ জন ফিরে এসেছে। অনেক স্কুলে মিলিটারি ক্যাম্প করেছে। ঢাকার প্রখ্যাত শাহীন স্কুল এর মধ্যে অন্যতম।
সাংবাদিকটি আরাে লিখেছেন “খােদ ঢাকা শহরেই মুক্তিযােদ্ধাদের কাজকর্ম শুরু হওয়ার নমুনা পাওয়া গেছে। ঢাকায় অবস্থানরত বিদেশী নাগরিকরা এ ব্যাপারটা সমর্থন করেছেন। ঢাকায় একজন বাঙালিকে সন্তর্পনে জিজ্ঞেস করলাম, আপনাদের আওয়ামী লীগ আর বাংলাদেশ কি এখনাে বেঁচে আছে? একটু হেসে ভদ্রলােক বললেন, বাংলাদেশ আর আওয়ামী লীগের মৃত্যু নেই। বুকের কাছটাতে হাতের ইশারা করে দেখিয়ে বললেন, ‘এই খানটাতে রয়েছে। ভদ্রলােকের অদ্ভুত মনােবল দেখে আমি বিমূঢ় হয়ে পড়লাম। আর একজন বাঙালি জানালেন, হানাদার সৈন্যরা দখলকৃত এলাকায় যেভাবে নিরস্ত্র জনসাধারণের উপর অত্যাচার চালাচ্ছে, তাতে আমাদের অনেকেই হয়তাে বা বিজয়ীর বেশে ঢাকা নগরীতে মুক্তিফৌজের প্রবেশের সময় হাজির থাকতে পারবে না । কিন্তু তারা আসবেই আর খুব শিগগিরই আসবে।”
মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টার operation-এ বাংলাদেশকে পদানত করে জেনারেল টিক্কা আর জেনারেল মিঠার দল ঢাকা ক্লাবে বড়া পেগ হুইস্কি খাওয়ার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা আজ ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেছে। গত পঁচাত্তর দিন ধরে লড়াই করেও অবস্থার সামান্যতম পরিবর্তন হয়নি। বরং দিন দিন হানাদার বাহিনীর অবস্থা কুফা হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে বেশ কিছু কমিশন্ড অফিসার আর কয়েক হাজারের মতাে হানাদার সৈন্য চির দ্রিায় শায়িত হয়েছে। এছাড়া বিপুল সংখ্যক আহত হয়ে ছটফট করছে। এর মধ্যে আবার পাবনা-যশাের এলাকায় হানাদার সৈন্যদের মধ্যে এক কলেরা শুরু হয়েছে। এর উপর আবার মুক্তিফৌজের ক্যাচকা মাইর শুরু হয়ে গেছে।
বাংলাদেশের অনেক ক’টা জায়গায় মুক্তিফৌজের এই আন্ধারিয়া মাইরের চোটে এখন হানাদার বাহিনী হাউকাউ করতে শুরু করেছে। সে এক অদ্ভুত ব্যাপার। দিনের বেলায় এসব হানাদার সৈন্যরা নিরস্ত্র মানুষের উপর অত্যাচার করছে; আর রাতের অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাম্প আর ট্রেঞ্চের মধ্যে পেলিয়ে যাচ্ছে। তাই রাতের। বেলায় শুরু হয়েছে গেরিলাদের এই আন্ধারিয়া মাইর। ফলে হানাদার বাহিনী এখন অক্করে হুইত্যা পড়ছে। হ্যাতাইনরা অহন থাইক্যা নাকি হুইত্যা হুইত্যা Fight করবাে। কেননা সেনাপতি ইয়াহিয়া ওদিকে ইসলামবাদে অখন হুইত্যাই আছেন। আর জেনারেল টিক্কার শরীড়া ম্যাজ ম্যাজ করতাছে। অগাে রাইত্যের ঘুম অক্করে ছুইট্টা গেছে।
সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল