You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.08.21 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | ছাত্রলীগ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণ | সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
২১শে আগস্ট, মঙ্গলবার, ১৯৭৩, ৪ঠা ভাদ্র, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

ছাত্রলীগ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণ

গত পরশুদিন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধন করেছেন। স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশ ছাত্রলীগের এটা দ্বিতীয় মহাসম্মেলন। বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর উদ্বোধনী ভাষণটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা জনক। তাঁর মহান আদর্শের অনুসরণেই বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বিকাশ। তাই ছাত্রলীগের সম্মেলনে তাঁকে আসতেই হবে। যেহেতু বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতৃত্বেই সেদিন প্রথম ভাষা আন্দোলনের তথা পাকিস্তানী শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে সংগ্রামের সূত্রপাত হয়েছিলো সেহেতু ছাত্রলীগের কর্মীদের মাঝে বঙ্গবন্ধুর আগমন একটি আকর্ষণীয় ঘটনা। এবারও তিনি অতীতের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ছাত্রলীগের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের কথা উল্লেখ করেছেন। আবেগজড়িত কন্ঠে তিনি বলেছেন, ‘ছাত্রলীগের সম্মেলনে ডাক এলে আমি না এসে পারিনা, কেননা ছাত্রলীগের সঙ্গে আমার হৃদয়ের নিবিড় সম্পর্ক।’ ছাত্রলীগের মহাসম্মেলনে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দিয়েছেন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সমাজের ও দেশের বর্তমান বিভিন্ন সমস্যার আলোকে তাঁর বক্তব্য রেখেছেন। সকল অচলাবস্থার স্বীকৃতি জানিয়েই নেতা তাঁর সমাধানের পথ নির্দেশ করেছেন। সর্বোপরি তিনি যে মহান আহ্বান জানিয়েছেন তাহলো দেশের সকল প্রকার প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে যুব সমাজকে গণ-আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার। দেশে বর্তমানে নিদারুণ সন্ত্রাসের রাজত্ব চলছে। রাতের অন্ধকারে দুষ্কৃতিকারীরা দেশের সকল প্রগতিশীল কর্মী বিশেষত আওয়ামী লীগের কর্মীদেরকে হত্যা করছে। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত জোরের সঙ্গে ঘোষণা করেন—যেকোন শক্তির বিনিময়েই হোক এদের তৎপরতা বন্ধ করা হবে। তিনি গ্রামে গ্রামে মহল্লায় মহল্লায় প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান। শুধু পুলিশ দিয়ে দুষ্কৃতিকারীদেরকে দমন করা যে সম্ভব নয় সে কথাও তিনি উল্লেখ করেন। তাঁর আহ্বান, ‘তোমরা যুবকেরা প্রতিটি অঞ্চলে দুর্জয় দূর্গ গড়ে তোলো দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে।’ শুধু দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে নয়—সকল প্রকার দুর্নীতিবাজ, চোরাচালানকারী, মওজুতদার, মুনাফাখোর, অসৎ কর্মচারী, রাজাকার, আলবদর প্রভৃতি স্বাধীনতার শত্রুদের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন পরিচালনা করতে হবে। দেশের মানুষের রাতের ঘুম যারা কেড়ে নিয়েছে তাদের কোনক্রমেই রেহাই দেওয়া উচিত নয় বলেও তিনি মন্তব্য করেন। সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু আরও বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন। যেমন দেশে বর্তমানে যে শিক্ষক ধর্মঘট চলছে তার কথা উল্লেখ করে তিনি অবিলম্বে দেশের ও ছাত্রদের বৃহত্তর স্বার্থে ধর্মঘট প্রত্যাহারের আহ্বান জানান। নতুন শিক্ষানীতি প্রবর্তিত হলে শিক্ষক ও শিক্ষাক্ষেত্রের বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থার অবসান হবে বলে তিনি মনে করেন। তাছাড়া গণতন্ত্রের নীতিমালা মেনে চলারও তিনি আহ্বান জানিয়েছেন। শুধু গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা বলতে গিয়ে রাষ্ট্রের ও জাতির প্রতি আমাদের যে দায়িত্ব রয়েছে তা যেন আমরা ভুলে না যাই। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রয়েছে বলেও তিনি মতপ্রকাশ করেছেন। যা ইচ্ছা তাই লেখাই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নয়। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নামে কারো রাষ্ট্রদ্রোহিতা বা সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে লেখবার অধিকার দেওয়া হয়নি বলেও বঙ্গবন্ধু হুঁশিয়ার করে দেন। ছাত্রদেরকে লেখাপড়ায় আত্মনিয়োগ করার ‍উপদেশ দিয়েছেন জাতির জনক। তিনি অভিভাবকের ন্যায় ছেলেদেরকে সত্যিকার মানুষ হবার আহ্বান জানিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার একাংশে ছিলো স্বাধীনতার শত্রুদেরকে মোকাবেলা করার সংগ্রামী আহ্বান। তিনি সাম্প্রদায়িকতার বীজ ছড়ানোর বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, ‘আমার জীবনে সাম্প্রদায়িকতার ন্যক্কারজনক কার্যকলাপ সহ্য করতে রাজী নই।’ তিনি ছাত্র ও দেশের জনগণকে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জোর সংগ্রাম গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। বস্তুতঃপক্ষে বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ একটি ঐতিহাসিক ভাষণ। এ ভাষণের আলোকেই গোটা জাতিকে জাতীয় পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করতে হবে। এবং সকল প্রকার স্বাধীনতার শত্রুদের হুমকি দৃঢ় পদক্ষেপে গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে পর্যুদস্ত করতে হবে। আগামী সোনালী ভবিষ্যতের কামনায় সেই সংগ্রামের জন্যেই আজ প্রস্তুত হতে হবে।

সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম

গ্রামে গ্রামে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করা হচ্ছে। এটি শুধুমাত্র একটি তথ্য নয়, এটি একটি জ্বলন্ত অভিযোগ। গত পরশু বাংলাদেশ ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলন উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খুব আক্ষেপাত্মক সুরে বলেছেন, এদেশে আবার সাম্প্রদায়িকতার জন্ম হতে দেখলে তিনি যার পরনাই মর্মাহত হবেন। কিন্তু যারা সাম্প্রদায়িকতা নামক বিষবৃক্ষটি রোপণ করার জন্যে দিবানিশি তৎপর রয়েছেন তারা কি বঙ্গবন্ধুর ঐ খেদোক্তিতে কিছুমাত্র বিচলিত কিংবা সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানো থেকে বিরত থাকবেন? যারা আজ সাম্প্রদায়িকতার মতো ঘৃণ্য কাজে লিপ্ত রয়েছেন, তারা যে বঙ্গবন্ধুকে খুবই মান্য করে চলেন, তা কিন্তু আমাদের মনে হয়না। বঙ্গবন্ধুকে যদি ঐসব সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ সৃষ্টিকারীরা মান্যই করবেন, তাহলে একথা নিশ্চিত যে, তারা এহেন অপকর্মে অন্ততঃ তেমন সক্রিয় থাকতেন না। গ্রামে গ্রামে সাম্প্রদায়িকতার নেভা আগুনকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে গনগনে করারও কোন প্রয়োজন বোধ করতেন না। কিন্তু তাতো হবার নয়। একশ্রেণীর লোক দেশের মৌল নীতির অন্যতম ধর্মনিরপেক্ষতার বুকে ছুরি মেরে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প দিকে দিকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। অথচ এই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই আপোষহীন সংগ্রাম করে আসছেন এবং তিনি জীবনের অন্তিম দিন পর্যন্ত সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামরত থাকবেন। দেশে যখন আবার সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে তখনই বঙ্গবন্ধু ছাত্র সমাজকে সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধকল্পে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। ছাত্ররাই জাতির আশা ভরসার অন্যতম উৎস। তাই ছাত্র সমাজ যদি সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে দুর্বার সংগ্রাম গড়ে তোলেন, তাহলে এদেশে কোন দুর্মর শক্তিই সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানোর মতো হীনতম কাজে আত্মনিয়োগ করার দুঃসাহস পাবে না। সত্যি, গ্রামের দিকে যদি আমরা দৃষ্টিপাত করি, তাহলে দিব্যি দেখতে পাবো যে, সাম্প্রদায়িকতার যুপকাষ্ঠে কতো নিরীহ পরিবারকে নানা রকম হেস্তনেস্ত এবং দুর্দশায় জীবন কাটাতে হচ্ছে। কথায় কথায় অনেকেই বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠে। নিজেদের দুর্দশাগ্রস্ত জীবনের জন্যে ভারতকে দায়ী করে অনেকেই আবার লম্বা চওড়া বক্তৃতাবাজীতেও নেহায়েত কম যান না। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু সুস্পষ্ট ভাষায়ই বলেছেন যে, ভারত বিরোধিতার একমাত্র উদ্দেশ্য সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি ছাড়া আর কিছু নয়। তিনি আবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, আমরা ভারতের কাছে কৃতজ্ঞ। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের সময়ই নয় শুধু—স্বাধীনতার পরেও ভারত আমাদের কেবল খাদ্যই আড়াই কোটি মণ সাহায্য হিসেবে দিয়েছে। তবুও ভারত বৈরিতা যেন কারো কারো মজ্জাগত ব্যাপার হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু যথার্থই বলেছেন যে, ভারতের সমালোচনা, সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টিরই নামান্তর। তাই আমরা দেখতে পাই, যারা ভারত বিরোধিতা করছে, তারা জ্যামিতিক নিয়মেই দেশের অভ্যন্তরে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে। বাংলার বুকে আমরা সাম্প্রদায়িকতাকে প্রাণের বিনিময়ে চিরতরে কবরস্থ করেছি। এই সাম্প্রদায়িকতার বীজই যদি আবার উপ্ত করার প্রচেষ্টা চলে, তাহলে তা হবে নিদারুণ দুঃখ ও মর্মদাহের কারণ। তাই আমরা বলি, ছাত্রসমাজের প্রতি বঙ্গবন্ধু সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তোলার যে আহ্বান জানিয়েছেন, দেশের প্রতিটি ছাত্রকেই সেই আহ্বানে এগিয়ে আসা একান্ত দরকার।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন