দৈনিক পয়গাম
৫ই এপ্রিল ১৯৬৬
ছয় দফা বনাম লাহাের প্রস্তাব
ছয় দফার প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন আর লাহাের প্রস্তাব এক নয়। ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাবের প্রথম মুদ্রিত সংস্করণে ষ্টেটস (States) কথা ছিল। কিন্তু মুসলিম লীগের ১৯৪৬ সনের দিল্লী কনভেনশনে তা সংশােধিত হয়। দিল্লী কনভেনশনে জনাব শহীদ সােহরাওয়ার্দী যে সংশােধনী প্রস্তাব আনেন, তাতে ষ্টেটসের স্থলে ষ্টেট কথাটি স্থান পায়। কায়েদে আজম এই কনভেনশনে সভাপতিত্ব করেন। প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হওয়ার পর কায়েদে আজমই ঘােষণা করেন যে, ষ্টেটস কথাটা ভুল ছাপা হইয়াছিল। ইহা ষ্টেট বা রাষ্ট্র হইবে। তিনি আরাে বলেন যে, লাহাের প্রস্তাবের মূল তাৎপর্যে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রই পরিকল্পিত হইয়াছিল। সুতরাং লাহাের প্রস্তাবের মূল উদ্দেশ্য ভুলিয়া গেলে চলিবে না। ক্যাবিনেট মিশনের নিকটও কায়েদে আজম মুসলমানের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবী পরে পেশ করেন। লর্ড মাউন্টব্যাটেন কর্তৃক ১৯৪৭ সনে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় একটি রাষ্ট্রের দাবী স্বীকৃত হয়। ১৯৪৯ সনে গণপরিষদের “আদর্শ প্রস্তাবে”ও একটি রাষ্ট্রের কথা বলা হয়। ১৯৫৬ সনের শাসনতন্ত্রেও তা গৃহীত হয়। ১৯৫৭ সনে উজিরে আজম হিসাবে জনাব সােহরাওয়ার্দী দ্ব্যর্থহীন জবানে ঘােষণা করেন যে, প্রদেশগুলি শতকরা ৯৮ ভাগ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ভােগ করিতেছে। এখানে উল্লেখযােগ্য যে, তখনও রেলওয়ে কেন্দ্রীয় বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
পাকিস্তান একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র না দুইটি এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের সীমানা কতদূর প্রসারিত করা যাইতে পারে; তা বিচারের জন্যই এ সম্পর্কে জনাব সােহরাওয়ার্দীর মতামত ও তার ঘােষণাকে এখানে বিশেষভাবে তুলিয়া দেওয়া হইল। আজ মরহুম সােহরাওয়ার্দীর প্রধানতম শিষ্য বলিয়া প্রচারিত শেখ মুজীবুর রহমানের ছয় দফা দাবী ইহারই পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচিত হইলে দেশবাসী উপকৃত হইবেন।
এক কথায় শেখ সাহেব ছয় দফা দাবীর যুদ্ধ ঘােষণা করিয়া ইতিহাস পাল্টাইয়া ফেলার চেষ্টায় মাতিয়াছেন। তিনি জনাব সােহরাওয়ার্দীকে তাঁর গুরু বলিয়া সেদিনও ঘােষণা করিয়াছেন। ফলে তাঁর লড়াইটা গুরুমারা বিদ্যায় পরিণত হইতে চলিয়াছে। এই গুরু-শিষ্যের লড়াই ওয়াকিফহাল মহলের নিকট উপভােগ্য হইলেও ইহার ফলে কোনাে কোনাে মহলে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হইতে পারে এবং একশ্রেণীর সরলমতি লােক বিভ্রান্ত হইতে পারে। সুতরাং প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন, লাহাের প্রস্তাব ও ছয়দফার নামে শেখ মুজীবুর রহমান যে ভাঁওতা ও ছলাকলার আশ্রয় নিয়েছেন, তার স্বরূপ যথাযথভাবে যত উদঘাটিত হয়, ততই মঙ্গল। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর জনাব আবদুল মােনায়েম খান মােমেনশাহীতে বিরােধী দলের ছয় দফার স্বরূপ কিছুটা উদঘাটিত করিয়া দিয়াছেন। এ ব্যাপারে মুসলিম লীগ ও অন্যান্য দলের দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দের বিশেষভাবে আজ মুখ খুলিবার প্রয়ােজন আছে। ১৯৫৪ সনে ২১ দফার নামে জনসাধারণকে যারা প্রতারিত করিয়াছিলেন, তারা আবার মাঠে নামিয়াছেন। তাঁদের আসল চেহারা ও তাঁদের অতীত বনাম বর্তমানের আলােকে সকলের নিকট তুলিয়া ধরিতে হইবে। কারণ, ইহার প্রয়ােজন আজ অত্যন্ত তীব্রভাবেই অনুভব হইতেছে।
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক॥ দ্বিতীয় পর্ব