You dont have javascript enabled! Please enable it! 1966.04.16 | রাজনৈতিক মঞ্চ | দৈনিক ইত্তেফাক - সংগ্রামের নোটবুক

দৈনিক ইত্তেফাক
১৬ই এপ্রিল ১৯৬৬

রাজনৈতিক মঞ্চ
মােসাফির

ভুট্টো সাহেব ভালই করিয়াছেন। দুষ্ট লােকেরা যাহাই বলুক, শেষ পর্যন্ত তিনি বুদ্ধিমানের মত কাজ করিয়াছেন। অবশ্য দুষ্ট লােকেরা বলিবে যে, এবার তিনি যখন ঢাকায় আসিয়া শেখ মুজিবরের সহিত ছয়দফার উপর কনফ্রান্টেশনের প্রস্তাব দিয়াছিলেন-বিশেষ করিয়া শেখ মুজিব কর্তৃক গত ১৩ই এপ্রিল তার প্রস্তাব গ্রহণের পর তিনি ২৪শে’র স্থলে ১৭ই এপ্রিল ‘মােকাবিলা সভা’ অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দিয়াছিলেন তখন ইহা সকলেই অনুমান করিয়াছিল যে, তিনি সময়ের সংক্ষিপ্ততা এবং আইন ও শৃংখলা প্রভৃতির প্রশ্নে নিজ দলীয় সংশ্লিষ্ট লােকজনের সহিত আলাপ-আলােচনা করিয়াই এই প্রস্তাব দিয়াছিলেন। পক্ষান্তরে শেখ মুজিবই বরং মিঃ ভুট্টো নির্ধারিত ১৭ই তারিখ সম্পর্কে সঙ্গত ওজর দেখাইতে পারিতেন। কেননা, বহুপূর্বে ঐ তারিখে তার মফস্বল প্রােগ্রাম নির্ধারণ করা হইয়াছিল। তথাপি ভুট্টো সাহেবের সুবিধার জন্যই তিনি ১৫/১৬ই তারিখের মফস্বল প্রােগ্রাম পালন করতঃ ১৭ই তারিখে খুলনার প্রােগ্রাম বাতিল করিয়া হইলেও ঢাকায় জনাব ভুট্টোর সহিত মােকাবিলা সভায় উপস্থিত থাকিতে সম্মত হন। সুতরাং ‘মােকাবিলা সভার’ প্রশ্ন নিয়া এতদূর অগ্রসর হইবার পরে গতকল্য সাড়ে বারটায় যে অজুহাতে তিনি প্রস্তাবিত মােকাবিলা সভা অনুষ্ঠানে অক্ষমতা প্রকাশ করিয়াছেন তাহা অনেকের নিকটই যুক্তিপূর্ণ বলিয়া মনে হইবে না।
অবশ্য এইজন্য আমরা মিঃ ভুট্টোকে বেশী দোষারােপ করিতে চাই না। তিনি হয়ত ছয়-দফা প্রােগ্রাম রাজনৈতিক সমস্যা বিধায় সদিচ্ছা প্রণােদিত হইয়া উহাকে রাজনৈতিক পর্যায়ে মােকাবিলা করিবার উদ্দেশ্যে উক্ত প্রস্তাব দিয়াছিলেন। কিন্তু তার ফ্যাসাদ হইল যে, তিনি এই অঞ্চলের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশেষতঃ ছয় দফা তথা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কে আদৌ ওয়াকিফহাল নন। এই প্রদেশের তার সহযােগীরা ছয় দফাকে যেভাবে ফুঙ্কারে উড়াইয়া দেন তাহা হইতেই হয়ত তার ধারণা জন্মিয়াছিল যে, ছয় দফার বিপক্ষেই জনমত প্রবল এবং একজন নামকরা বাগ্মী হিসাবে তিনি ‘মােকাবিলা সভায় শেখ মুজিবকে সহজেই পরাজিত করিয়া এক অশেষ কৃতিত্বের অধিকারী হইবেন। মিঃ ভুট্টো একজন ভাল বক্তা কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তিনি ভাবালুতার দ্বারা পরিচালিত হন। তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং কনভেনশন মুসলিম লীগের মনােনীত প্রাক্তন সেক্রেটারী জেনারেল হইলেও রাজনীতিতে তিনি নূতন। তিনি যদি এদেশের রাজনীতির খবর রাখিতেন তাহা হইলে এই অঞ্চলে তার সহকর্মীরা জনমত সম্পর্কে যাহাই বলুন না কেন, তিনি নিজে স্মরণ রাখিতেন যে, পাকিস্তান আন্দোলনে বাংলার অধিবাসীরাই কার্যকরীভাবে রাজনৈতিক সচেতনতার প্রমাণ দিয়াছিলেন। তিনি স্মরণ রাখিতেন যে, এই অঞ্চলের জনগণ ভালমন্দ, ন্যায়-অন্যায় বিচার না করিয়াই ক্ষমতাসীনদের অন্ধ স্তাবকতা করে না। তাই ১৯৪৯ সালে যখন মুসলিম লীগ কেন্দ্র ও প্রদেশে সর্বত্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সেই সময় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর টাঙ্গাইলের প্রথম উপনির্বাচন বিরােধী দলীয় প্রার্থী জনাব শামসুল হক দোর্দণ্ড প্রতাপ ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ দলীয় প্রার্থীকে পরাজিত করেন এবং সেই পরাজয়ের পর মুসলিম লীগ ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত আর বিরােধী দলের সহিত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হইতে সাহসী না হওয়ায়, আইন পরিষদের ৩৫টি উপ-নির্বাচন স্থগিত থাকে। তিনি স্মরণ রাখিতেন যে, ১৯৫০ সালে লিয়াকত/বি, পি, সি রিপাের্ট প্রকাশ হইবার পর এই প্রদেশ হইতেই উহার তুমুল বিরােধিতা করা হয় এবং একটি সর্বদলীয় কনফারেন্স অনুষ্ঠান করিয়া যে বিকল্প বি, পি, সি প্রস্তাব রচিত হয় তারও প্রধান বিষয়বস্তু ছিল আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা এবং আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনই ছিল যুক্তফ্রন্টের ২১-দফার প্রধান কর্মসূচী। সেই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট শতকরা ৯৭ টি আসন দখল করিয়াছিল, একথাও মিঃ ভুট্টোর মনে পড়িত। তার মনে পড়িত, ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের কথা। আজও পূর্ব পাকিস্তানে এমন কোন রাজনৈতিক দল নাই যারা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের বিরােধিতা করিতেছেন। এমনকি কনভেনশন লীগকেও (অন্ততঃ মুখে) বলিতে হইতেছে যে, বর্তমানে পূর্বাপেক্ষা অধিক স্বায়ত্তশাসন এই অঞ্চল ভােগ করে।
[যদিও ইহা সত্য নয়, কেননা প্রচলিত প্রেসিডেন্সিয়াল ধরনের শাসনব্যবস্থায় প্রকৃত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন উপভােগ করার প্রশ্নই উঠিতে পারে না; বর্তমানে জনগণের সরাসরি ভােটে প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা সেখানে। নাই এবং গভর্নর ও মন্ত্রীরা কেহই জনগণ এমনকি আইন পরিষদের নিকটও দায়ী নন]।
এমতাবস্থায় এদেশের রাজনীতি সম্পর্কে বিশেষতঃ এই অঞ্চলের দাবীদাওয়া ও জনমত সম্পর্কে ভুট্টো সাহেবের যদি প্রত্যক্ষ জ্ঞান থাকিত তাহা হইলে কস্মিনকালেও তিনি ছয়-দফা তথা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের উপর কিছুতেই ‘বাজী রাখিতে পারিতেন না। তাঁর অজ্ঞতাপ্রসূত চ্যালেঞ্জের তাই স্বাভাবিক পরিণতিই ঘটিয়াছে।
এবার মিঃ ভুট্টো ঢাকা পৌছিয়া আবার ‘মােকাবিলা সভার প্রস্তাব দিলে আমরা অবাক বনিয়া গিয়াছিলাম। ভাবিতে ছিলাম যে, রাজনীতিকরা বিশেষতঃ ক্ষমতাসীনরা নিজেদের জনপ্রিয়তা সম্পর্কে কিংবা অন্য যে কোন বিষয় সম্পর্কে মুখে যত বাগাড়ম্বর করুন না কেন, প্রকৃত অবস্থা রিপাের্ট করার জন্য যে-সকল সরকারী ইনটেলিজেন্স সার্ভিস রহিয়াছে তারা আজকাল করেন কি? রাজনৈতিক আমলে দেখিয়াছি তিনটি ইনটেলিজেন্স সার্ভিস যথামিলিটারী ইনটেলিজেন্স, সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স ও প্রাদেশিক ইনটেলিজেন্স দেশের বিভিন্ন সমস্যা ও পরিস্থিতি সম্পর্কে কর্তৃপক্ষের নিকট নিয়মিত ‘গােপন রিপাের্ট প্রেরণ করিতেন। আমি ইনটেলিজেন্স রিপাের্টের অন্ততঃ শতকরা ৯০ ভাগ এবং সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্সের রিপাের্টের শতকরা ৬০/৭০ ভাগ প্রকৃত অবস্থার প্রতিফলন করিত। এ-ব্যাপারে আমার কিছুটা প্রত্যক্ষ জ্ঞান ছিল। একমাত্র প্রাদেশিক ইনটেলিজেন্সের রিপাের্ট অনেকটা ধামাধরা গােছের হইত এবং তারও কারণ ছিল যে, প্রাদেশিক সরকারকে তাহারা চটাইতে চাইতেন না। তাই রাজনৈতিক আমলে অন্ততঃ এই সকল গােপন সূত্রের মাধ্যমে শাসন কর্তৃপক্ষের দেশের প্রকৃত অবস্থা জানার সুযােগ ছিল। আজ তার কি হইল সেই প্রশ্নই আমাদের মনে জাগিতেছে। মন্ত্রীদের এবং অধস্তন ব্যক্তিদের পক্ষে সেই রিপাের্ট দেখিবার সুযােগ আছে কি না তাহা। আমরা বলিতে পারি না। এই অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে যাদের যােগাযােগ আছে এবং তাদের মনােভাব জানার আগ্রহ আছে তারা জানেন যে, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে এই অঞ্চলের জনমত কত প্রবল। আওয়ামী লীগ বিশেষ সতর্কতার সহিত দাবী করিয়াছে যে, অন্যূন ৭০% ইহার অনুকূলে। কিন্তু আমাদের ধারণা, স্বাধীন গণভােট অনুষ্ঠিত হইলে এই অঞ্চলের শতকরা পাঁচজন লােকও আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের বিপক্ষে ভােট প্রদান করিবে না।
যারা অবশ্য জনগণের ধারে কাছে যান না কিংবা জনমত গ্রহণে সাহসী হন না, তাঁদের মুখে লাগাম টানা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। বর্তমানে জনমত প্রতিফলনের ব্যবস্থা যেখানে নাই সেই বিচিত্র অবস্থায় যে-কেহ জনগণের সােল এজেন্ট সাজিলে তাকে কে বাধা দিতে পারে।
এই বিচিত্র ব্যবস্থাধীনে কার্টেল তথা একচেটিয়া পুঁজিপতিদের অর্থে পরিচালিত কোন কোন পত্রিকা পর্যন্ত বামপন্থী বনিতে পারে, তাদের লেখনি এবং তাদের সংবাদ পরিবেশনের ভাবখানা যেন এই যে, যে-কোন মুহূর্তেই তারা এদেশে ‘বিপ্লব ঘটাইয়া চীনের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করিয়া ফেলিতে উদ্যত; শুধুমাত্র মার্কিন ঘেঁষা এক-আধটি ‘দালাল’ পত্রিকা যেন তাদের বিপ্লব ঠেকাইয়া রাখিতেছে। জনগণকে নিয়া এত রঙ-বেরঙের খেলা করার সৌভাগ্য আর কোন দেশের হইবে কি না সন্দেহ।
তবে ভুট্টো সাহেব জ্ঞানী-গুণী লােক এবং গণতন্ত্রের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা আছে বলিয়াও তিনি প্রকাশ করেন। ইহা যদি সত্য হয় তবে তিনি তাঁর দলীয় কর্তাব্যক্তিদের বুঝাইবেন যে, একটি দেশের জনমত তথা দাবী-দাওয়া লইয়া বেশী খেলা করিলে দেশের সমস্যা বাড়ে বই কমে না। তিনি যে রাজনৈতিক পথে ছয়দফার মােকাবিলা করিবার পক্ষপাতী সেই সর্বজনস্বীকৃত রাজনৈতিক পথেই আমরাও ছয়দফাসহ দেশের সকল সমস্যার সমাধানে প্রস্তুত। এই গণতান্ত্রিক পথেই আঞ্চলিক বিরােধ, অর্থনৈতিক বৈষম্য, রাজনৈতিক অস্থিরতা সবকিছুর সমাধান করিয়া জাতীয় ঐক্য ও সংহতিকে সুদৃঢ় করিয়া তােলা সম্ভব। মিছা বাগাড়ম্বর কিংবা প্রকৃত অবস্থাকে চাপা দিয়া অথবা কণ্ঠরােধ ও নির্যাতনের আশ্রয় নিয়া কোন লাভ নাই, বরং তিক্ততা ও বিরােধ বাড়িয়াই চলিবে। পরিশেষে সমস্যার সমাধান যে পক্ষেই হউক, পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে ভুট্টো সাহেবের অন্ততঃ অজ্ঞতা না থাকে আমরা সেই সম্পর্কে নিশ্চিত হইতে চাই। কেননা, এই ধরনের অজ্ঞতা এ-দেশের বহু অনর্থ ঘটাইয়াছে। এই অজ্ঞতার দরুনই এই অঞ্চলের বশংবদদের উস্কানিতে শ্রদ্ধেয় নেতা শেরেবাংলা, শহীদ সােহরাওয়ার্দী এবং অন্যান্য নির্যাতিত নেতাকে ‘বৈদেশিক চর’ আখ্যায়িত করা হইয়াছে; বশংবদদের ভরসাতেই শহীদ সােহরাওয়ার্দীর বিরুদ্ধে বিদেশ হইতে টাকা গ্রহণের অপবাদ দিয়া গ্রেফতার করা হইয়াছিল এবং আশা করা হইতেছিল যে, তাঁহাকে গ্রেফতার করা হইলে এ অঞ্চলে একটি কুকুরও ঘেউ করিয়া উঠিবে না। একটি দেশের এক অঞ্চল সম্পর্কে অন্য অঞ্চলের কর্তাব্যক্তিদের এত অজ্ঞ থাকার পরিণতিই আজও আমরা ভােগ করিতেছি। সর্বাগ্রে এই অজ্ঞতার অবসান চাই।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক॥ দ্বিতীয় পর্ব