সংবাদ
৪ঠা জুন ১৯৬৬
গণ-আন্দোলন গড়ার ক্ষেত্রে
একতা, না সংকীর্ণতা?
(জনৈক রাজনৈতিক ভাষ্যকার)
দেশের জনগণের জীবনে কতকগুলি মৌলিক সমস্যা যথা, গণতন্ত্রের অভাব, দেশের অর্থনীতিতে মার্কিনী পুঁজির ঔপনিবেশিক শােষণ, জমি হইতে মেহনতী কৃষকদের বঞ্চনা ও কৃষক সমাজের উপর বিভিন্নরূপ সামন্তবাদী শােষণ, শ্রমিক শ্রেণীর উপর পুঁজিপতিদের সীমাহীন শােষণ ও দেশের অর্থনীতিতে দেশের মুষ্টিমেয় বৃহৎ পুঁজিপতিদের একচেটিয়া অধিকার, মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবীদের স্বল্প আয় প্রতি জনগণকে নিরন্তর নিপীড়ন করে।
অন্যদিকে, বর্তমানে কতকগুলি বিশেষ সমস্যা যথা, খাদ্য ও নিত্যব্যবহার্য জিনিসের উচ্চমূল্য, দমননীতি ও বিনাবিচারে বহুসংখ্যক দেশপ্রেমিক কর্মী-নেতাকে কারাগারে আটক রাখা, জরুরী অবস্থা বহাল রাখা, স্বায়ত্তশাসনের অধিকারের অভাব, শ্রমিকের কম মজুরী, কৃষকের উপর খাজনা ট্যাক্সের বােঝা ইত্যাদি পূর্ব পাকিস্তানের গণমনকে বিশেষভাবে আলােড়িত করিতেছে।
ইহা সন্দেহাতীত যে, প্রথমােক্ত মৌলিক সমস্যাবলী হইতেই দ্বিতীয়ােক্ত জরুরী ও আশু সমস্যাবলীর উদ্ভব হইয়াছে। কিন্তু দ্বিতীয়ােক্ত সমস্যাবলীর চাপে জনগণের জীবনে বর্তমানে বিশেষ সমস্যা সৃষ্টি হইয়াছে।
খাদ্যের অবস্থা আজ মােটেই সন্তোষজনক নহে এবং গ্রামের অগণিত দরিদ্র মেহনতী মানুষ আজ খাদ্য ও নিত্যব্যবহার্য জিনিসের উচ্চমূল্যের জন্য এক বিষম সংকটে পড়িয়াছেন। ভবিষ্যতের আশংকায় তাঁহারা উদ্বিগ্ন বােধ করিতেছেন। নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের মূল্যের উর্ধ্বগতির জন্য শ্রমিক-কর্মচারীদের এবং মধ্যবিত্ত চাকুরেদেরও আজ অশেষ দুর্ভোগ ভােগ করিতে হইতেছে।
পাক-ভারত সশস্ত্র সংঘর্ষের সময়ে এবং তারপরেও দেশরক্ষা আইনে। বহু দেশপ্রেমিককে কারগারে বিনাবিচারে আটক রাখা হইতেছে। সেই সশস্ত্র। সংঘর্ষ শেষ হইয়া গেল, যুদ্ধ বিরতি হইল, তাসখন্দ ঘােষণা স্বাক্ষরিত হইল, সীমান্ত হইতে উভয় দেশের সৈন্য অপসারণ করা হইল-কিন্ত তবুও ঐ দেশপ্রেমিকরা জেলে এবং আরও নিত্য নূতন গ্রেপ্তার হইতেছে। জরুরী আইন বলবৎ রাখিয়া সমস্ত বৈধ ও গণতাত্রিক আন্দোলনের কণ্ঠরােধের চেষ্টাও চলিতেছে।
পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট বিলােপ-জনগণের দীর্ঘদিনের ন্যায়সঙ্গত গণতাত্রিক দাবী। এই দাবী পূরণের বদলে স্বৈরাচারী এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা দিন দিন দৃঢ় করা। হইতেছে।
লক্ষ লক্ষ বিড়ি শ্রমিক আজ স্রেফ নিজেদের বাঁচার জন্য টেণ্ডুপাতা অর্ডিন্যান্স বাতিলের দাবী করিতেছেন। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগােষ্ঠীর কোন ভ্রুক্ষেপ নাই।
বিভিন্ন গ্রাম্য অঞ্চলে কৃষকদের যেসব সভা-সমাবেশ হইতেছে তাহার প্রত্যেকটি হইতে খাজনা-ট্যাক্স কমান, দুর্নীতির বিলােপ প্রভৃতি দাবী একবাক্যে ধ্বনিত হইতেছে। কিন্তু এইসব দাবীর প্রতি সরকার বধির সাজিয়া বসিয়া আছে।
বিভিন্ন বিরুদ্ধবাদী দলও আজ তাহাদের নিজ নিজ সভা-সমিতি হইতে খাদ্য, নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্রের মূল্য হাস, রাজবন্দীদের মুক্তি, জরুরী আইন প্রত্যাহার, স্বায়ত্তশাসন, খাজনা-ট্যাক্স কমান এবং শ্রমিকদের কোন কোন দাবীর সমর্থনে প্রস্তাব গ্রহণ করিতেছেন। বুঝা যায়, তাঁহারাও কার্যতঃ এই সব দাবীগুলি জনগণের আশু ও জরুরী দাবী বলিয়া গণ্য করেন।
কিন্তু, প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগােষ্ঠী কোন দাবীই মানিতেছে না বরং তাহারা তাহাদের চিরাচরিত পন্থায় দমননীতি প্রয়ােগ দ্বারা এই সব দাবীর আন্দোলনকে দমন করিতে চাহিতেছে। দাবীগুলি এক-তবুও অনৈক্য। যেসব রাজনৈতিক দল ও সংস্থা গণদরদী ও গণতন্ত্রকামী বলিয়া দাবী করে, এই অবস্থায় তাঁহাদের কর্তব্য কি? সহজ বুদ্ধিতেই বােঝা যায় যে, একটা কার্যকরী ও জোরদার গণ-আন্দোলন গড়িয়া তুলিতে না পারিলে প্রতিক্রিয়া শাসকগােষ্ঠির নিকট হইতে কোন দাবী আদায় করা সম্ভব নহে। অন্যদিকে এই শাসকগােষ্ঠি আজ জনগণ হইতে এত বিচ্ছিন্ন যে, জোরদার ও কার্যকরী গণ-আন্দোলন গড়িয়া তুলিতে পারিলে কোন কোন দাবী হাসিল করা সম্ভব হইতে পারে। তাই জরুরী গণদাবীগুলির ভিত্তিতে একটা জোরদার ও কার্যকরী গণ-আন্দোলন গড়িয়া তােলাই হইল আজ গণ-স্বার্থের জন্য প্রয়ােজন। এই গণ-আন্দোলন গড়িয়া তােলার পথ কি?
ইহা স্বতঃসিদ্ধ যে, আজ পূর্ব পাকিস্তানে এমন কোন দল বা সংস্থা নাই, যাহারা অন্যান্য বিরােধী শক্তিকে বাদ দিয়া শুধু এককভাবে জনগণের দাবীর ভিত্তিতে একটা বড় রকমের আন্দোলন গড়িয়া তুলিতে পারে ও কোন দাবী আদায় করিতে পারে। কোন দাবীর ভিত্তিতে বিভিন্ন দলের ও সংস্থার ঐক্য হইল কার্যকরী গণ-আন্দোলনের জন্য আবশ্যিক বিষয়। অতীতে সমস্ত অভিজ্ঞতা যথা, ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ দিয়া থাকে।
তাই যদি সত্যিই সত্যিই কোন দল বা সংস্থা আজ জনগণের কোন সমস্যার কোন প্রতিকারের জন্য প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণআন্দোলন গড়ার কথা নিষ্ঠা ও গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে, তাহা হইলে সেই দল বা সংস্থাকে নিজেদের কর্মোদ্যোগ ও কর্মতৎপরতা চালাইয়া যাইবার সঙ্গে সঙ্গে ঐ দাবীর সমর্থক অন্যান্য দল ও সংস্থার সাথে গণআন্দোলনের জন্য একটা সমঝােতা ও একতা গড়ার চেষ্টাও করিতে হইবে।
কিনতু দুঃখের বিষয়, আজ এই ক্ষেত্রেই একটা বিষম সমস্যা দেখা যাইতেছে। খাদ্যের কথাই ধরুন। খাদ্যের ব্যাপারে বিভিন্ন বিরুদ্ধবাদী দল যেমন ন্যাপ, আওয়ামী লীগ, এন, ডি, এফ-সবাই একই কথা বলিতেছেন। সবাই বলিতেছেন যে, খাদ্য সংকটে জনগণের অসীম দুঃখ-দুর্দশা উপস্থিত হইতেছে যে, সমস্ত শহরে রেশনিং চাই, ২০ টাকা মণদরে চাউল চাই, নিত্যব্যবহার্য্য জিনিসের দাম কমাও ইত্যাদি। কিন্তু এইসব দাবী আদায়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ হইয়া আন্দোলন গড়ার উদ্দেশ্যে কেহই আগাইয়া আসিতেছেন না!
রাজবন্দীর মুক্তির বা জরুরী আইন প্রত্যাহারের প্রশ্ন ধরুন। ঐসব দলগুলিই দাবী করিতেছে যে, সমস্ত রাজবন্দীদের মুক্তি চাই ও জরুরী আইন প্রত্যাহার কর।
কিন্তু এ ক্ষেত্রেও তাঁহারা ঐক্যবদ্ধ হইয়া একটা কার্যকরী আন্দোলন গড়িয়া রাজবন্দীদের মুক্তি হাসিল করার জন্য বা জরুরী আইন প্রত্যাহার বাস্তবায়িত করার জন্য আগাইয়া আসিতেছেন না ! দেশরক্ষা আইনে ধৃত রাজবন্দীদের স্বাস্থ্য কারাগারে অতি নীচু স্তরের খাদ্য সরবরাহ ও অন্যান্য বহুবিধ সমস্যায় দিনের পর দিন ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে। অথচ ইহার প্রতিবাদে ঐসব দলগুলি ঐক্যবদ্ধভাবে কোন আওয়াজ তুলিয়া ইহার প্রতিকারের জন্য কোন চেষ্টা করিতেছেন না !
শ্রমিকের মজুরী বৃদ্ধি, কৃষকের উপর খাজনা-ট্যাক্সের বােঝা কমান প্রভৃতি ব্যাপারেও একই কথা। ঐ দলগুলি সবাই এইসব দাবী সমর্থন করেন।
কিন্তু, সবাই মিলিয়া আন্দোলন করিয়া সেগুলি আদায়ের চেষ্টা করার প্রশ্ন আসিলেই-সেখানেই শত কথা শত বাধা ! গত ধর্মঘটের পর হইতে বহু রেলশ্রমিক এখনও কর্মচ্যুত হইয়া পরিবারসহ অনশনের সামনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন। অথচ তাহাদের সম্পর্কে কোন কথা নাই।
স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কেও ঐসব দলগুলি মূলতঃ একই দাবী করেন। কেহ বলেন, “লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন”, কেহ বলেন, “৬-দফা”, কেহ বলেন, শুধু “পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন”। এ ক্ষেত্রে কতকগুলি বিষয়ে মতভেদ আছে বটে। কিন্তু সবাই যে স্বায়ত্তশাসন চায়, সে সম্পর্কে কোন সন্দেহ নাই। অথচ, এখানে একটা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ার কোন প্রচেষ্টা নাই।
অতএব, দেখা যায় যে, বিভিন্ন বিরুদ্ধবাদী দল জনগণের বর্তমান কতকগুলি সমস্যা নিয়া একই কথা বলেন এবং একই দাবীও করেন। কিন্তু ঐসব দাবী নিয়া একত্রে একটা কার্যকরী আন্দোলন গড়িয়া জনগণের দুঃখকষ্ট লাঘব করার জন্য কেহই আগাইয়া আসিতেছেন না। এ ক্ষেত্রে সবাই যার যার তার তার।
পেটি বুর্জোয়া সংকীর্ণতা
জনগণের স্বার্থের দৃষ্টিকোণ হইতে বিচার করিলে যেকোন গণ-দরদী দল বা ব্যক্তির আজ এই সিদ্ধান্তে পৌছাইতে হইবে যে, যে সব সমস্যায় আজ জনগণ নিপীড়িত হইতেছে, সেগুলির প্রতিকার করিতে হইলে প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে একটা প্রত্যক্ষ ও কার্যকরী গণ-আন্দোলন দরকার এবং সেরূপ আন্দোলন গড়িয়া তুলিতে হইলে জনগণের আশু দাবী-দাওয়ার ভিত্তিতে বিভিন্ন বিরুদ্ধবাদী দলগুলির ভিতর একটা সমঝােতা বা একতা প্রয়ােজন।
অথচ বিভিন্ন বিরুদ্ধবাদী দল জনগণের দাবী-দাওয়ার কথা বলিয়াও যেসব দাবীতে তাঁহারা একমত সেই সব দাবী নিয়া ঐক্যবদ্ধ হইয়া একটা কার্যকরী আন্দোলন গড়িয়া তুলিতে কেহই অগ্রসর হইতেছেন না! তাহা হইলে কি বুঝিতে হইবে যে, তাঁহারা শুধু কথা ও প্রচারেই সীমাবদ্ধ থাকিতে চান এবং জনগণের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের জন্য প্রত্যক্ষ আন্দোলন গড়ার কাজে তাহাদের সত্যিকারে কোন আগ্রহ নাই? কিংবা, দলগত সংকীর্ণতাতে তাহাদের দৃষ্ট কি এতদূর আচ্ছন্ন যে, জনগণের স্বার্থের চাইতে দলগত ‘স্বাতন্ত্র তাঁহাদের নিকট বড় জিনিস?
বস্তুতঃ আজ বিভিন্ন বিরুদ্ধবাদী দল মেহনতী জনগণের এই দুঃসময়েও প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগােষ্ঠির বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন গড়ার জন্য সমদাবীর ভিত্তিতে এক হইয়া কাজ করার প্রশ্নে যে উদাসীনতা, নিস্পৃহতা ও অবহেলা প্রদর্শন করিতেছে তাহার মধ্য দিয়া তাহাদের পেটি বুর্জোয়াসুলভ সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গীই পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছে। এই পেটি বুর্জোয়াসুলভ সংকীর্ণ দলগত মনােভাবই আজ গণতাত্রিক আন্দোলনে অনৈক্য সৃষ্টি করিয়া রাখিতেছে।
যেসব বিরুদ্ধবাদী দলের নেতৃত্ব স্বতঃসিদ্ধভাবেই বুর্জোয়া পেটি বুর্জোয়ার শ্রেণী স্বার্থে চালিত এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যাহারা সংস্কারপন্থী তাঁহাদের ক্ষেত্রে ঐ পেটি বুর্জোয়াসুলভ সংকীর্ণতা সহজেই বােধগম্য। কিন্তু ঐ সংকীর্ণতা শুধু তাহাদের ভিতরই সীমাবদ্ধ নহে। দুঃখের বিষয়, যেসব দল প্রগতিশীল বলিয়া দাবী করে এবং যাহাদের দায়িত্ব ছিল জনগণের দাবীদাওয়া নিয়া ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ার জন্য উদ্যোগ নেওয়া, সেইসব দলের নেতৃত্বের ভিতরও পেটি বুর্জোয়াসুলভ সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি বিরাজ করিতেছে। তাঁহারাও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ার জন্য উদ্যোগ নিতেছেন না। ফলে, বিভিন্ন বিরুদ্ধবাদী দল স্ব স্ব গণ্ডীতে আবদ্ধ হইয়া যে-যার কথা বলিয়া যাইতেছে। অন্যদিকে, মেহনতী জনগণ ভুখা থাকিতেছে, রাজবন্দীরা কারাগারে তিলে তিলে স্বাস্থ্য হারাইতেছেন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ স্বায়ত্তশাসনের অভাবে গুমরিয়া মরিতেছেন এবং দেশী ও বিদেশী শােষকগণ অবাধে জনগণকে শােষণ করিতেছে।
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক॥ দ্বিতীয় পর্ব