You dont have javascript enabled! Please enable it! 1966.03.26 | আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন কেন? | দৈনিক ইত্তেফাক - সংগ্রামের নোটবুক

দৈনিক ইত্তেফাক
২৬শে মার্চ ১৯৬৬

আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন কেন?

ভারত রাজী হবে কি না, সে প্রশ্ন সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক ও অবাস্তব। তবে যে দৃষ্টিকোণ থেকে অভিযােগটি উত্থাপিত হয়েছে, তা বাস্তবিকই দুর্ভাগ্যজনক। কারণ বৃহত্তর বাংলা গঠনের কল্পনাও কোন পূর্ব পাকিস্তানীর মাথায় নেই, তাদের মাথায় শক্তিশালী কেন্দ্র নয়- শক্তিশালী পাকিস্তানের স্বপ্ন। তাই পূর্ব পাকিস্তানীর বক্তব্য শােষণের বিরুদ্ধে শােষণমুক্ত সমাজব্যবস্থার, অসাম্যের বিরুদ্ধে সাম্যের শক্তির ধমকের বিরুদ্ধে বাস্তব সত্য উপলব্ধি-তথা বুভুক্ষা, দারিদ্র্য ও মৃত্যুর বিরুদ্ধে সুখ-সমৃদ্ধি ও বাঁচার। এ বাঁচার দাবীর প্রণেতার পরিচয় বড় কথা নয়। কথা হচ্ছে, পরিকল্পিত পথ শােষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা ও শক্তিশালী পাকিস্তান রচনার পক্ষে কতদূর সহায়ক। যদি সহায়ক বলে দেশবাসী সমর্থনদান করেন, তাহলে সে আর দলবিশেষ বা ব্যক্তিবিশেষের পরিকল্পনা থাকে না। জাতির পরিকল্পনায় পর্যবসিত হয়। শেখ মুজিবের ছয়দফা আজ আর কোন ব্যক্তিবিশেষের বা দলবিশেষের নয়, ইহা সাড়ে পাঁচ কোটি পূর্ব পাকিস্তানীর।
পূর্ব পাকিস্তানের মুখপাত্র হিসাবে শেখ মুজিব ছয়দফা প্রস্তাব পেশ করেছেন। ইতিমধ্যেই প্রদেশবাসী তাতে অকুণ্ঠ সমর্থন দান করেছে। তথাপি কোন স্বার্থান্বেষী মহলের যদি কিছু বক্তব্য থাকে, তাহলে তারা জনতার দরবারে হাজির হয়ে চক্ষু-কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করতে পারেন।
শেখ মুজিবের উত্থাপিত ছয়দফা নূতন কিছু নয়, তাতে কারাে আতঙ্কিত হওয়ারও কিছু নেই। এ দাবী বহুকালের। শেখ মুজিব পুরনাে কথাটা নতুন করে বলেছেন এই যা। যাঁরা ছয়দফায় বিস্ময় বােধ করেছেন, ইতিহাসের দিকে তাদের একবার ফিরে তাকানাে উচিত। সে ইতিহাস অত্র পত্রিকার বহু প্রবন্ধেই আলােচিত হয়েছে। মােদ্দাকথা, পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবী আনকোরা নতুন কিছু ব্যাপার নয়। এতে বৃহত্তর বাংলা গঠনের “বাঙ্গালী মুসলমান শুধু ইংরেজের নয়-হিন্দুরও গােলাম”, “গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার আশঙ্কা ইত্যাদি অভিযােগ কিভাবে উত্থাপিত হতে পারে, তা সত্যি আমাদের বুদ্ধির অগম্য। ইতিহাস সাক্ষী, বাঙ্গালী কোনদিন ভীরুর মত পরাধীনতা স্বীকার করে নেয়নি। বাঙ্গালী সন্তান সিরাজদৌল্লা স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছেন, তিতুমীর বাঁশের কেল্লা তৈরী করে দোর্দণ্ড প্রতাপে ইংরেজের মােকাবিলা করেছেন। ভীরুর মত পরাধীনতা স্বীকার করে নেয়নি। অগণিত বাঙ্গালী মুসলমান স্বাধীনতা সংগ্রামে রক্ত দিয়েছেন। অবশ্য পূর্ব পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে এ ধরনের জঘন্য মন্তব্য নতুন নয়। যখনই এ অঞ্চলের মানুষ অন্যায় অসাম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে, তখনই তাদের দেওয়া হয়েছে বিচ্ছিন্নতাবাদের, আঞ্চলিকতাবাদের, সংহতি বিনষ্টের অপবাদ। শুধু তাই নয়, ইসলাম ও পাকিস্তান বিপন্নের ধুয়া তােলা হয়েছে। জননেতাদের শত্রুর চর আখ্যায়িত করা হয়েছে। ঐতিহাসিক লাহাের প্রস্তাবকালে মরহুম শেরেবাংলা এ, কে, ফজলুল হককে শেষ বয়সে অন্তরীণাবদ্ধ করা হয়েছে। সর্বজনমান্য হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে কারারুদ্ধ ও দেশ হতে বহিষ্কার করা হয়েছে। তরুণ বিপ্লবী নেতা শেখ মুজিবসহ এতদঞ্চলের প্রায় তিন হাজার রাজনৈতিক কর্মীকে কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে নিক্ষেপ করা হয়েছে। সেদিন যেমন স্বার্থান্বেষী মহলের চক্রান্ত সফল হয়নি, আজো হবে না। এ নিশ্চয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আমরা চাই কেন?
এর একমাত্র এবং সহজ ও সােজা উত্তর হচ্ছে পাকিস্তানকে শক্তিশালী করার জন্য। কারণ, সারা দেহে রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে মুখে রক্ত সঞ্চালনের নাম যেমন স্বাস্থ্য নয়, তেমনি বৃহত্তর জনসমাজকে সর্বনাশের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়ে মুষ্টিমেয় ভাগ্যবানের হাতে সম্পদ পরীভূতকরণ এবং সকল মানুষকে অধিকারবঞ্চিত দেখে এক স্থানে এবং সমস্ত শক্তি একহাতে ধারণের অনুকূলে যুক্তি প্রদর্শন করছেন। কিন্তু বিগত উনিশ বৎসরের ভ্রান্ত শাসন আমাদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করে দিয়েছে।
বিগত উনিশ বছরে আমরা দেখেছি কি করে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলকে একশ্রেণীর কায়েমী স্বার্থের ধন-সম্পদ লুণ্ঠনের সংরক্ষিত বাগিচায় পরিণত করা হয়েছে। এই শােষণক্রিয়ার ফলে অধিকাংশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী পূর্ব পাকিস্তানীদের পূর্বে যেখানে দু’খানা লুঙ্গি ক্রয়ের সামর্থ্য ছিল, সে স্থলে আজ তাদের একখানা গামছা ক্রয়েরও সাধ্য নেই। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শৈল্পিক-তথা সর্বক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানীরা আজ শুধু বঞ্চিত নয়, লাঞ্ছিত ও শােষিত।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক॥ দ্বিতীয় পর্ব