You dont have javascript enabled! Please enable it! 1966.03.30 | রাজনৈতিক মঞ্চ | দৈনিক ইত্তেফাক - সংগ্রামের নোটবুক

দৈনিক ইত্তেফাক
৩০শে মার্চ ১৯৬৬

রাজনৈতিক মঞ্চ
মােসাফির

ছয়-দফা কর্মসূচী প্রকাশিত হইবার প্রথমদিকে বিরােধী দলীয় মহলে যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়াছিল, তাহা লক্ষ্য করিয়া আমরা কিছুটা ব্যথিত বােধ করিতেছিলাম। শুধু মিশ্র প্রতিক্রিয়াই নয়, চৌধুরী মােহাম্মদ আলী সাহেব ক্ষমতাসীন দল অপেক্ষাও এক ডিগ্রী চড়া কথাবার্তা বলিতেছিলেন। তিনি ক্ষমতাসীন দলের মতই ইহার মধ্যে বিচ্ছিন্নবাদিতার ‘ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করিয়াছিলেন। ইহা অপেক্ষাও পরিতাপের বিষয় যে, চৌধুরী সাহেবের সুরে সুর মিলাইয়া এখানকার নেজামে ইসলাম, জামাতে ইসলামী এবং কাউন্সিল মুসলিম লীগ ওয়ালারাও ৬-দফার মধ্যে বিচ্ছিন্নবাদিতা আবিষ্কার করিয়াছিলেন।
৬-দফার প্রতি জনসমর্থন দুর্বার হইয়া উঠার ফলেই হউক অথবা শুভবুদ্ধির উদয় হওয়ার জন্যই হউক, আশার কথা, এক্ষণে একমাত্র কনভেনশন লীগ ছাড়া এই প্রদেশের সকল রাজনৈতিক দল উচ্চকণ্ঠে স্বায়ত্তশাসনের দাবী উত্থাপন করিতেছেন। এমনকি মিঃ ফজলুল কাদের চৌধুরী চট্টগ্রামের জনসভায় বক্তৃতা প্রদানকালে প্রকাশ করিয়াছেন যে, করাচী ‘ক্লিফটন বিচে’ যখন কনভেনশন লীগের জন্ম হয়, তখন আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন অনুমােদন করিয়া প্রস্তাব গৃহীত হইয়াছিল। ধোকা দিবার জন্য উক্ত প্রস্তাব গৃহীত হইয়াছিল কি-না, তাহা আমরা বলিতে পারি না। তবে কনভেনশন লীগের মত প্রতিষ্ঠান কর্তৃকও আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব গ্রহণের মধ্যদিয়া স্বায়ত্তশাসন দাবীর অপ্রতিরােধ্য জনপ্রিয়তারই প্রমাণ মিলে।
পূর্ব পাকিস্তানের সকল দল কর্তৃক আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রতি সমর্থন একটি উৎসাহজনক ব্যাপার সন্দেহ নাই। কিন্তু এই প্রসঙ্গে আমরা একটি কথা না বলিয়া পারিতেছি না। স্বায়ত্তশাসনের দাবী নূতন নয়, বহু পুরাতন। মিঃ নূরুল আমীন যথার্থই বলিয়াছেন যে, স্বায়ত্তশাসনের দাবী পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মতই একটি পুরাতন ব্যাপার। ১৯৪৯ সালে গণপরিষদ কর্তৃক শাসনতন্ত্রের কাঠামাে সম্পর্কে যে মূল নীতিনির্ধারক প্রস্তাব গৃহীত হইয়াছিল, তাতেও উভয় অঞ্চলের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের উল্লেখ ছিল। তৎপর ঢাকায় অনুষ্ঠিত এ্যাণ্ড ন্যাশনাল কনভেনশনের প্রস্তাবে এবং যুক্তফ্রন্টের ২১-দফা দাবীতেও আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবী সন্নিবেশিত হইয়াছিল। কিন্তু ৬-দফা প্রস্তাবে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের যেরূপ বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও সুনির্দিষ্ট রূপ প্রদান করা হইয়াছে, অন্য কোন প্রস্তাবে ইতিপূর্বে সেরূপ স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট কিছু বলা হয় নাই। আর আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দাবীর ইতিপূর্বেকার এই অস্পষ্টতার দরুনই চৌধুরী মােহাম্মদ আলীর মত লােকেরাও আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবীর প্রতি সমর্থন দিতে পারিয়াছেন। অবশ্য তাঁর আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের সংজ্ঞা আর আমরা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন অর্থে যা বুঝি বা চাই, তার মধ্যে বিরাট পার্থক্য রহিয়াছে। অপরপক্ষে, ৬-দফা প্রস্তাব উঠিতেই গণমনে যে আলােড়নের সৃষ্টি হইয়াছে এবং প্রদেশের বুদ্ধিজীবী ও যুবসমাজের মধ্যে ৬-দফা যে দৃঢ় সমর্থন লাভ করিতেছে, তার প্রধান কারণ হইল, ৬-দফায় আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের একটি সুস্পষ্ট রূপরেখা অঙ্কিত হইয়াছে। ইহাতে শুধুমাত্র লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিই প্রতিফলিত হয় নাই, গত ১৮ বছরের শাসন-ব্যবস্থার বিশেষ বিশেষ অভিজ্ঞতার প্রতিফলিত হইয়াছে। আমাদের মতে ৬-দফার জনপ্রিয়তার ইহাই মূল কারণ।
৬-দফা যখন জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন কুড়াইতে সমর্থন হইয়াছে এবং এই ৬-দফা প্রােগ্রাম উপলক্ষ করিয়াই চ্যালেঞ্জ ও পাল্টা-চ্যালেঞ্জ চলিয়াছে, তখন যে-সকল দল আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের সমর্থন, তাঁদের পক্ষেও অস্পষ্টভাবে স্বায়ত্তশাসনের প্রতি সমর্থন না দিয়া এই ৬-দফাকে সমর্থন দিলেই সুবিধা হয় বলিয়া আমরা মনে করি। ৬-দফার রচয়িতা কে কারা, তাহা অপেক্ষাও গুরুত্বপূর্ণ হইল ৬-দফার বিষয়বস্তু।
স্বভাবতঃই এই বিষয়বস্তুর নিরিখে সবকিছু বিচার না করা হইলে স্বায়ত্তশাসনের সমর্থক হইয়াও আমরা সকলে এ-যাবৎ যে অস্পষ্টতা ও অনিশ্চয়তায় ভুগিতেছিলাম, তার অবসান করা সম্ভব নয়। বলাবাহুল্য, ৬দফার সংগ্রামে এই মুহুর্তে নেতৃত্ব বা মন্ত্রীত্বের কোন প্রশ্ন নাই। সকলের মিলিত প্রচেষ্টায় ৬-দফা দাবী প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হইলে জনগণের ভােটেই রাজনীতিকদের জনপ্রিয়তা যাচাই, প্রতিনিধি নির্বাচন প্রভৃতি সম্পন্ন হইবে। এক্ষণে এই সংগ্রামে প্রয়ােজন হইবে ত্যাগ, লাঞ্ছনাগঞ্জনা ও নির্যাতন ভােগের।
এদেশের পার্লামেন্টারী শাসন-ব্যবস্থার আমলেও সকল মহল হইতেই জোরেশােরে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবী উত্থাপিত হইত। এমনকি, বর্তমান শাসনতন্ত্রেও স্বায়ত্তশাসনের উল্লেখ রহিয়াছে। বহু বিষয় প্রাদেশিক সরকারের কর্তৃত্বাধীনও রহিয়াছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার এবং অর্থনৈতিক বিধি-ব্যবস্থার মূল চাবিকাঠি অন্যত্র থাকায় তথাকথিত স্বায়ত্তশাসন। কাগজপত্রেই সীমাবদ্ধ রহিয়াছে তাহাই নয়, কোন কোন ক্ষেত্রে ইহা অত্যাচার-অনাচার ও বঞ্চনার সাফাই হিসাবে ব্যবহৃত হইয়াছে।
একটি দেশের শাসনতন্ত্র ও শাসনব্যবস্থা দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা ও পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমেই সুনির্দিষ্ট রূপ পরিগ্রহ করে। লাহাের প্রস্তাবে কি আছে কি নাই, তাহাও আজ হয়তাে কারও মনে পড়িত না, যদি পাকিস্তানের ভৌগােলিক অবস্থানের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া গত ১৮ বছর দেশের শাসনব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক বিধি-ব্যবস্থা সুচারুরূপে উভয় অঞ্চলের জনগণের সমকল্যাণে পরিচালিত হইত। কিন্তু দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য-শিল্প, চাকরি বাকরি ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রভৃতি ব্যবস্থাদিতে এমনি একচোখা নীতি অনুসরণ করা হইয়াছে, যার ফলে সমাজে একশ্রেণীর কায়েমী স্বার্থী জন্মলাভ করিয়াছে ও আঞ্চলিক বৈষম্য বিরাট আকার ধারণ করিয়াছে। আর এই অর্থনৈতিক বৈষম্য ও কায়েমী স্বার্থীদের প্রভাব খর্ব করার পরিবর্তে আজ আমরা যাহা দেখিতে পাইতেছি, তাহাতে জাতীয় সম্পদের উপর কায়েমী স্বার্থীদের প্রভাব দিন দিন বৃদ্ধি পাইতেছে ; দেশের রাজনীতিতে তথা শাসনব্যবস্থায় জনগণ তাে অধিকারবঞ্চিত আছেই। কায়েমী স্বার্থ ও শােষণবিজ্ঞানের অবশ্য ইহাই চিরন্তন ধারা। আজ তাই আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের সেই পুরাতন দাবী তুলিলেও কায়েমী স্বার্থীরা খাপ্পা হইয়া উঠেন তাহাই নয়, জনগণের ভােটাধিকার তথা প্রাপ্তবয়স্কদের সরাসরি ভােটে প্রতিনিধি নির্বাচনের সামান্য দাবীটুকু উঠিলেও তারা রাজনীতিকদের উপর দোষারােপ করাই নয়, জনগণের জ্ঞান-বুদ্ধির উপর কটাক্ষ করেন। ইহা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মুষ্টিমেয় কায়েমী স্বার্থী দেশের সম্পদের উপর এই ধরনের আধিপত্য বিস্তার না করিলে যে পাকিস্তান জনগণের ভােটে এবং লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে অর্জিত হইয়াছে সেই পাকিস্তানে জনগণের ভােটাধিকার ও লাহাের প্রস্তাবের কথা তুলিতেই ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’, ‘শত্রুর চর’ ইত্যাদি অপবাদ ও গালাগালি শ্রবণ করিতে হইত না। না জানি এই কায়েমী স্বার্থীদের ডালপালা আরও বিস্তৃত হইলে এবং শিকড় আরও দৃঢ় হইলে তারা এদেশের অধিবাসীদের কোন পর্যায়ে নিয়া যান।
পূর্ব পাকিস্তানীরা কাহারও প্রতি বিদ্বেষ বা হিংসার ভাব পােষণ করে না, তারা অতিরিক্ত কিছু চায়ও না। এমনকি গত আঠারাে বৎসর যাবৎ বিভিন্ন ক্ষেত্রে শােষিত ও বঞ্চিত হইয়াও ইহার ক্ষতিপূরণও দাবী করে না। এই সকল পুরানাে কাসুন্দি না ঘাটিয়া ভবিষ্যতে যাতে আর বঞ্চিত ও শােষিত হইতে না হয়, তার প্রতিকারকল্পেই ৬-দফা প্রস্তাব উত্থাপিত হইয়াছে। যে কোন সুবিবেচক লােক বা গােষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের এই দাবীকে উদার মনােভাবের পরিচায়ক বলিয়া গণ্য করিতেন। অথচ আমাদের দুর্ভাগ্য যে, ইহার বিপরীত ব্যবহারই আমরা লাভ করিতেছি। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান সেদিনও ঢাকায় বলিয়াছেন যে, পূর্ব পাকিস্তান তার নিজস্ব সম্পদ দ্বারা বাঁচিয়া থাকিতে পারে না। আমরা পশ্চিম পাকিস্তান হইতে আলাদা হইয়া পৃথকভাবে অবস্থান করিতে চাহি না। কেননা, পাকিস্তানের এক অঞ্চল অন্য অঞ্চলের শক্তির পরিপূরক। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান নিজস্ব সম্পদ দ্বারা বাচিয়া থাকিতে পারে না, এই কথা বলার অর্থ কি? পূর্ব পাকিস্তান কি পশ্চিম পাকিস্তান বা অন্য কাহারাে Subsidy’র উপর বাঁচিয়া আছে? না প্রকৃত অবস্থা সম্পূর্ণ বিপরীত? উভয় অঞ্চলের অর্থনীতির বিস্তারিত এখানে আলােচনা না করিয়া আমরা শুধু এই প্রশ্নটিই তুলিয়া ধরিতে চাই যে, ৬-দফা প্রস্তাবে ত পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ দিয়াই স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনীতি গড়িয়া তুলিবার প্রস্তাব রহিয়াছে ; পশ্চিম পাকিস্তান হইতে কোন কিছু পাওয়ার বা আদায়ের প্রস্তাব ত উহাতে নাই। তাহা হইলে ৬-দফা প্রস্তাব পূরণে আপত্তি কেন?
যাই হউক, ৬-দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে সকলে মিলিয়া দুর্বার জনমত গঠন করিতে পারিলে এই দাবী কাহারও পক্ষে প্রতিহত করা সম্ভব হইবে না। তাই আমরা মনে করি, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের সমর্থক বিভিন্ন দল অস্পষ্টভাবে ও বিভিন্ন সুরে কথা না বলিয়া ৬-দফার ভিত্তিতে দাবী উত্থাপন করিতে পারিলে লক্ষ্যে পৌছা সহজ হবে।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক॥ দ্বিতীয় পর্ব