You dont have javascript enabled! Please enable it! 1966.05.21 | আটক নেতৃবৃন্দের মুক্তিসহ কতিপয় সুস্পষ্ট দাবীর ভিত্তিতে ৭ই জুন হরতাল আহ্বান | দৈনিক ইত্তেফাক - সংগ্রামের নোটবুক

দৈনিক ইত্তেফাক
২১শে মে ১৯৬৬

আটক নেতৃবৃন্দের মুক্তিসহ কতিপয় সুস্পষ্ট দাবীর ভিত্তিতে ৭ই জুন হরতাল আহ্বান
আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্ত
(ষ্টাফ রিপাের্টার)

দেশবাসীর আশা-আকাংক্ষার ভিত্তিতে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন পরিচালনারত নেতৃবৃন্দকে দেশরক্ষা বিধিবলে কারাগারে আটক করার ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনার জন্য আহূত পুর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি গতকাল (শুক্রবার) দীর্ঘ পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী আলাপ-আলােচনার পর ৬-দফার সমর্থনে ও কতিপয় সুস্পষ্ট দাবীর ভিত্তিতে আগামী ৭ই জুন প্রদেশব্যাপী সাধারণ হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত করে এবং এই হরতাল সাফল্যমণ্ডিত করিয়া তােলার জন্য আওয়ামী লীগের শাখা কমিটিসমূহের প্রতি আহ্বান জানায়।
শেখ মুজিবর রহমান প্রমুখ আওয়ামী লীগ নেতার আটকের পর প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের এই প্রথম জরুরী বৈঠকে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালােচনার পর দেশবাসীর অভিপ্রেত ৬-দফার সমর্থনে ও (ক) শেখ মুজিবসহ অবিলম্বে সকল আটক নেতার মুক্তিদান, (খ) দেশের বুক হইতে অবিলম্বে জরুরী অবস্থার অবসান ঘােষণা করতঃ দেশরক্ষা বিধি বাতিল, (গ) লেভী প্রথা প্রত্যাহার করিয়া সমগ্র প্রদেশে পূর্ণাঙ্গ রেশনিং ব্যবস্থা প্রবর্তন, (ঘ) টেপাতা অর্ডিন্যান্স প্রত্যাহার, (ঙ) শ্রমিক আন্দোলন সংক্রান্ত বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করিয়া আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার স্বীকৃত বিধানমতে শ্রমিক সংগঠনের স্বাধীনতা দান এবং (চ) সংবাদপত্রের উপর হইতে বিধিনিষেধ প্রত্যাহারের দাবীতে ৭ই জুন সমগ্র প্রদেশব্যাপী হরতালের আহ্বান জানান হয়।
নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলন পরিচালনারত নেতৃবৃন্দকে দেশরক্ষা বিধানবলে আটকের নীতির তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা করিয়া ধৃত নেতৃবৃন্দসহ সকল রাজবন্দীর আশুমুক্তি দাবী করিয়া ওয়ার্কিং কমিটি বলেন যে, পাকিস্তানের দুই দেশের মধ্যে বৃহত্তর ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাদি সমাধানের একমাত্র ফর্মুলা মনে করিয়া ৬-দফার পিছনে আজ যখন দেশবাসী কাতারবন্দী হইয়াছে, ঠিক তখনই সরকার জনসাধারণের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনকে স্তব্ধ করিয়া দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে আটক করিয়াছেন।
আলােচনাকালে কমিটির সদস্যবৃন্দ এই অভিমত প্রকাশ করেন যে, নেতৃবৃন্দের আটকের এ রহস্য আজ দেশবাসীর নিকট দিবালােকের মত স্পষ্ট হইয়া গিয়াছে। তাই দেশের গণতান্ত্রিক শিবির আজ প্রতিবাদমুখর।
শেখ মুজিবর রহমানের ধানমণ্ডাইস্থ বাসভবনে অনুষ্ঠিত ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে দলের অস্থায়ী সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সভাপতিত্ব করেন। ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য ছাড়াও বিভিন্ন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকেরা বিশেষ আমন্ত্রণক্রমে বৈঠকে যােগদান করেন। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্যরা ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, প্রদেশের খাদ্যসঙ্কট, শ্রমিক অসন্তোষ, বেকার সমস্যা, দ্রব্য মূল্যের অগ্নিমূল্য প্রভৃতি প্রশ্নে ওয়ার্কিং কমিটিতে পাঁচঘণ্টা কাল আলােচনা চলে।
দীর্ঘ আলাপ-আলােচনার পর ওয়ার্কিং কমিটি ৬-দফা দাবী আদায়ের জন্য আপােষহীন আন্দোলন চালাইয়া যাওয়ার সঙ্কল্প ঘােষণা করে। দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত ৬-দফা দাবীর সপক্ষে এবং রাজবন্দীদের মুক্তির দাবীতে পথসভা, শান্তিপূর্ণ মিছিল ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠানের জন্য ওয়ার্কিং কমিটি জেলা, মহকুমা ও থানা আওয়ামী লীগের প্রতি নির্দেশ দেন। ওয়ার্কিং কমিটি ঘােষণা করেন যে, ৬-দফা দাবী আদায়ের পথে সকল বাধা-বিপত্তির মােকাবিলা করার জন্য আওয়ামী লীগ সর্বদা প্রস্তুত আছে ও থাকিবে। ফলে তাহাদের আঁতে ঘা লাগিয়াছে। তিনি বলেন যে, নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলন আমাদের একমাত্র অস্ত্র-সুতরাং আন্দোলন চলিবে। আর তাহাতে নির্যাতনও আসিবে। কারণ, “নির্যাতনই স্বেচ্ছাচারী সরকারের হাতের একমাত্র সম্বল।” তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে তিনি ঘােষণা করেন যে, আমাদের উপর জরুরী আইন ও পাকিস্তান রক্ষা বিধির খড়গ নিপতিত হইতে পারে, এ ব্যাপারে আমরা সম্পূর্ণ সচেতন। তাই নির্যাতনের মুখে বুক পাতিয়া দাঁড়ানাের পূর্ণ প্রস্তুতি লইয়াই আমরা আজ কার্যক্ষেত্রে আগাইয়া আসিয়াছি। আমরা বিশ্বাস করি, এই নির্যাতনেই জাতিকে যথাযােগ্য পুরস্কারে ভূষিত করিবে- এই নির্যাতনের কষাঘাতেই জাতিকে সাফল্যের স্বর্ণদ্বারে পৌছাইয়া দিবে। আওয়ামী লীগ নেতা জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ, খােন্দকার মােশতাক আহমেদ, জনাব নূরুল ইসলাম চৌধুরী, জনাব আবদুল মােমেন, শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন, জনাব ওবায়দুর রহমান প্রমুখ অনেকেই সভায় বক্তৃতা করেন। জনাব বি, এম, ইলিয়াস সভায় সভাপতিত্ব করেন। প্রারম্ভে সন্দ্বীপ হইতে আগত বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী মােহাম্মদ সাদী সভায় গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক॥ দ্বিতীয় পর্ব