দৈনিক ইত্তেফাক
২০শে মে ১৯৬৬
৬-দফা আদায়ে দেশবাসীর অনড় সঙ্কল্প
আটক নেতৃবৃন্দের মুক্তি দাবীতে কাওরাইদে স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভা
(নিজস্ব সংবাদদাতা)
গফরগাঁও (ময়মনসিংহ), ১৯শে মে। – শেখ মুজিবর রহমান ও অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতার গ্রেফতারের প্রতিবাদে সম্প্রতি গফরগাঁও থানার কাওরাইদে স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। স্বল্পকালীন প্রচারে অনুষ্ঠিত উক্ত সভায় যে অভূতপূর্ব জনসমাবেশ হয়, তাহা ভবিষ্যৎ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের শুভ সংকেতবাহী। ইহার মধ্য দিয়া ৬-দফার প্রতি জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থনেরই পরিচয় ফুটিয়া উঠে। সভায় সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা ও স্থানীয় এলাকার মৌলিক গণতন্ত্রী জনাব সাইদুর রহমান।
সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন ৬-দফার ব্যাখ্যা করিয়া বলেন যে, ৬-দফা মুজিবরের নয়, আওয়ামী লীগের নয়, ৬-দফা জনসাধারণের প্রাণের দাবী, ন্যায্য দাবী।
ঢাকার বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা জনাব শামসুল হক বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন যে, দেশে খাদ্য পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করিতেছে। লেভীর মাধ্যমে কৃষকের গােলার ধান সরকারী গুদামে উঠাই ইহার কারণ বলিয়া তিনি মন্তব্য করেন। ৬-দফার বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করিয়া তিনি বলেন যে, জনসাধারণের প্রাণের দাবী ৬-দফা জনসমক্ষে তুলিয়া ধরার অপরাধেই সরকার শেখ মুজিবর রহমানকে গ্রেফতার করিয়াছেন। শেখ সাহেবের হয়রানির বিবরণ দান করিলে জনসাধারণ ‘শেম শেম’ ধ্বনিতে ফাটিয়া পড়ে।
ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতা জনাব রফিক উদ্দিন ভূইয়া তুমুল করতালির মধ্যে ঘােষণা করেন যে, কোন নির্যাতনই আমাদের টলাইতে পারিবে না। তিনি বলেন, ৬-দফার সহিত জনসাধারণের বাঁচামরার প্রশ্ন জড়িত।
তিনি আরও বলেন যে, ধান-চাউলসহ নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধিতে দেশে অস্বাভাবিক অবস্থা সৃষ্টি হইয়াছে। তিনি জনসাধারণের ৬-দফা আদায়ের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন অব্যাহত রাখার আবেদন জানান।
এতদ্ব্যতীত সভায় যাহারা বক্তৃতা করেন তাহাদের মধ্যে স্থানীয় বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ কর্মী রহুল আমীন ভূঁইয়া, মেজবাহ উদ্দিন, মনিরুদ্দিন ফকির, আবদুল মান্নান ও আজিজুল হকের নাম উল্লেখযােগ্য।
সভায় সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত প্রস্তাবে দেশরক্ষা আইনে ও নিরাপত্তা আইনে আটক সকল রাজবন্দীর মুক্তি দাবী করা হয়। দ্রব্যাদির ক্রমবর্ধমান মূল্যে সভায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। প্রদেশে টেণ্ডপাতার ব্যবহার পুনঃপ্রবর্তনের দাবী জানান হয়। সংবাদপত্রের উপর হইতে সকল বাধানিষেধ প্রত্যাহার করিবার দাবী জানাইয়াও সভায় একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। অবিলম্বে জরুরী পরিস্থিতি প্রত্যাহার করিয়া জরুরী পরিস্থিতির সঙ্গে আরােপিত সকল বিধিবিধানের অবসান ঘটাইবার দাবী জানাইয়া আর একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
বাগেরহাট
সম্প্রতি বাগেরহাট মিউনিসিপ্যাল পার্কে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ প্রধান জনাব শেখ মুজিবর রহমান ও অন্যান্য বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতার গ্রেফতারের নিন্দা করিয়া অবিলম্বে বিনাশর্তে তাঁহাদের আশু মুক্তি দাবী করা হয়। সভায় খাদ্যসমস্যা সমাধানের জন্যও সরকারের প্রতি জোর তাগিদ দেওয়া হয়। সভায় গৃহীত অপর প্রস্তাব জরুরী অবস্থা প্রত্যাহারের দাবী জানানাে হয়।
রাজবাড়ী
রাজবাড়ী, ১৪ই মে গতকল্য স্থানীয় রেলওয়ে ক্লাবের পার্শ্বস্ত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবর রহমানের গ্রেফতারের প্রতিবাদে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। নির্ধারিত সময়ের বহুপূর্ব হইতেই বহু দূরদূরান্ত হইতে জনসাধারণ সভাস্থলে উপস্থিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন রাজবাড়ী মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি ডাক্তার এস,এম, ইয়াহিয়া। সভায় বক্তৃতা করেন মকসুদ আহমদ, নাজিবর রহমান, আবদুল লতিফ বিশ্বাস, ডাঃ জলিলুর রহমান, বাবু চিত্তরঞ্জন গুহ ও আমজাদ হােসেন। সভা প্রারম্ভে শেখ মুজিবর রহমান প্রণীত ৬-দফা পাঠ করা হয়। সভার শুরু হইতেই রাত্রি ৮টা পর্যন্ত বিপুল করতালির মধ্যে শ্রোতাগণ বক্তাদের বক্তৃতা শ্রবণ করেন এবং ৬-দফা আদায় ও শেখ মুজিবর রহমানসহ সকল বেহরাজবন্দীর মুক্তি না দেওয়া পর্যন্ত নিয়মতান্ত্রিক গণআন্দোলন চালাইয়া যাওয়ার শপথ গ্রহণ করা হয়।
সভায় শেখ মুজিবর রহমানসহ সকল রাজবন্দীর আশু মুক্তি, জরুরী অবস্থার অবসান, দেশরক্ষা আইনের যথেচ্ছা ব্যবহারের তীব্র নিন্দা, দেশের খাদ্য পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করিয়া খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য নিত্য ব্যবহার্য। দ্রব্যের মূল্য হ্রাস করার জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী জানাইয়া কতিপয় প্রস্তাব গৃহীত হয়। চুয়াডাঙ্গা প্রতিবাদ দিবসে স্থানীয় টাউন ফুটবল মাঠে মহকুমা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের গ্রেফতারের প্রতিবাদে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। অত্র শহর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি জনাব আবুল হাশেম মােক্তার উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করেন।
সভায় বিভিন্ন বক্তা আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবর রহমানসহ সকলের মুক্তি দাবী করেন। তাহারা বলেন, দশ কোটি পাকিস্তানীর সামগ্রিক মঙ্গলের জন্য সরকার সমীপে একটা নূতন ‘ফর্মুলা পেশ করাই শেখ সাহেবের অপরাধ। কিন্তু শেখ মুজিবের ৬-দফা এদেশের মানুষের বাঁচামরার ফর্মুলা। এ দাবী শেখ মুজিবের একার নয়, ইহা দেশের আপামর জনসাধারণের প্রাণের দাবী।
ডাঃ আসাবুল হক বলেনঃ নেতাদের কারাগারে নিক্ষেপ করিয়া জনগণের এই প্রাণের দাবী কখনই নস্যাৎ করা যাইবে না। তিনি আরাে বলেন যে, আমরা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী। কাজেই সরকারকে আমাদের এই নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের যৌক্তিকতা অনুধাবনের আহ্বান জানাইতেছি।
পূর্বাহ্নে চুয়াডাঙ্গা মহকুমা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব ইউনুস আলি উকিল আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের গ্রেফতারের তীব্র নিন্দা করিয়া বলেন যে, জনগণের দাবীকে বানচাল করার জন্যই নেতৃবৃন্দকে কারাপ্রাচীরের অন্তরালে আটকাইয়া রাখা হইতেছে। কিন্তু দমন নীতির মাধ্যমে জনগণের দাবীকে কেহ কোনদিন দাবাইয়া রাখিতে পারে নাই। ৬-দফা দাবী সম্পর্কে তিনি বলেন, দেশের কল্যাণার্থে ৬-দফা দাবীর মাধ্যমে সরকারকে একটা পরামর্শ দেওয়া হইয়াছে মাত্র- ইহাতে অন্য কোনকিছুই বলা হয় না। পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের মঙ্গলের জন্যই এই দাবী উত্থাপন করা হইয়াছে বলিয়া তিনি উল্লেখ করেন। পরিশেষে উক্ত সভায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সভাপতি জনাব শেখ মুজিবর রহমানসহ অন্যান্য নেতা এবং পাকিস্তানের উভয় অংশের যে সমস্ত নেতাকে রাজনৈতিক কারণে আটক রাখা হইয়াছে তাহাদিগকে অনতিবিলম্বে বিনাশর্তে মুক্তিদানের জন্য প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক॥ দ্বিতীয় পর্ব