দৈনিক ইত্তেফাক
১১ই মে ১৯৬৬
নেতৃবৃন্দের গ্রেফতারে সকল মহলে প্রতিবাদের ঝড়
(ষ্টাফ রিপাের্টার)
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের গ্রেফতারের প্রতিবাদে সমগ্র প্রদেশে ব্যাপক অসন্তোষ ও বিক্ষোভের ঝড় উঠিয়াছে। প্রাদেশিক রাজধানীতে বিরােধী দলীয় নেতৃবৃন্দ ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের গ্রেফতারের তীব্র নিন্দা করিয়া তাঁহাদের আশু মুক্তি দাবী করিয়াছেন।
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ গতকাল সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে শেখ মুজিবর বেরহমানসহ আওয়ামী লীগের অপর ৬ জন নেতার গ্রেপ্তারের তীব্র নিন্দা করেন। তিনি সরকারকে সতর্ক করিয়া দিয়া বলেন যে, ৬-দফা মানুষের জীবন-মরণের দাবী। নির্যাতন ও নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করিয়া মানুষের জীবন-মরণের দাবীকে নস্যাৎ করা যায় না। ক্ষমতায় আঁকড়াইয়া থাকার জন্য ক্ষমতাসীনরা যেখানেই জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তি বল প্রয়ােগের স্তব্ধ করার চেষ্টা করিয়াছে, সেখানেই নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রাম অধিকতর জোরদার হইয়া উঠিয়াছে। মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ঘােষণা করেন যে, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের যে সার্বজনীন দাবী তােলার অভিযােগে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে আটক করা হইয়াছে এদেশের অগণিত মজলুম জনগণের পক্ষ হইতে আমি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে সেই দাবী জনসমক্ষে তুলিয়া ধরিতেছি। আগামী ১৩ই মে নেতৃবৃন্দের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ প্রদেশব্যাপী যে প্রতিবাদ দিবস আহ্বান করিয়াছে, এদেশের প্রতিটি গৃহ হইতে সেদিন নির্যাতন ও নিবর্তনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আওয়াজ বুলন্দ করিয়া তােলার জন্য আমি দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাইতেছি। জাতীয় পরিষদে স্বতন্ত্র সদস্য ডক্টর আলীম আল-রাজি আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের আশু মুক্তি দাবী করিয়া বলেন যে, দেশরক্ষা আইনে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করিয়া সরকার এই আইনের মারাত্মক অপব্যবহার করিয়াছেন। যে-কোন জাতীয় প্রশ্নে সরকারের বিরােধী মতবাদ পােষণ করা বা সে মতবাদ শাসনতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণভাবে প্রচার করার অধিকার স্বাধীন দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার। যুদ্ধে সৃষ্ট বিশেষ পরিস্থিতি মােকাবিলার জন্য দেশরক্ষা আইনের প্রবর্তন করা হয়। এই আইনের প্রয়ােগ দ্বারা রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের শায়েস্তা করা সমীচীন নয় এবং এই ব্যবস্থা আমাদের জাতীয় স্বার্থের অনুকূলও নয়। ঢাকা জামাতে ইসলামের আমীর জনাব কে জে মুরাদ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের গ্রেফতারের তীব্র নিন্দা করেন। তিনি বলেন যে, দেশরক্ষার জন্য যে আইন করা হইয়াছে, যে আইনের দ্বারা বিরােধী দলকে ঘায়েল করার চেষ্টা অত্যন্ত লজ্জাকর এবং এতে সরকারের মারমুখী নীতিরই অভিব্যক্তি ঘটিয়াছে।
পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জনাব সিরাজুল হােসেন খান আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের গ্রেফতারকে ব্যক্তি স্বাধীনতার উপর হামলা বলিয়া অভিহিত করেন। তিনি নেতৃবৃন্দের আশু মুক্তি দাবী করেন। অবিলম্বে জরুরী পরিস্থিতির অবসান ও দেশরক্ষা আইন বাতিল করার জন্যও তিনি দাবী জানান। যশােরে প্রতিবাদ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের গ্রেফতারের তীব্র নিন্দা ও আটক নেতাদের মুক্তি দাবী করিয়া যশাের আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এক বিবৃতি দিয়াছেন। বিবৃতিতে তাঁহারা বলেন, নিপীড়িত মানুষের দাবীই শেখ মুজিব তুলিয়া ধরিয়াছেন। এই কারণে সরকার তাঁহাদের কারান্তরালে নিক্ষেপ করিয়াছেন। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের ইহা বুঝা প্রয়ােজন যে, দমননীতি প্রয়ােগ করিয়া কোন শাসকগােষ্ঠীই মানুষের ন্যায্য দাবী প্রতিহত করিতে পারে নাই। সুতরাং সরকার যে পথে অগ্রসর হইয়াছেন,তাহা পরিত্যাগ করিয়া সত্যকে উপলব্ধি করিতে প্রয়াসী হইলে দেশবাসীর জন্য মঙ্গলজনক হইবে। বিবৃতিতে স্বাক্ষরদান করেন মেসার্স আবদুর রশীদ, এম, রওশন আলী বি, এল, সৈয়দ আতর আলী, সােহরাব হােসেন এল, এল বি, আফছার উদ্দীন আহম্মদ, খােন্দকার আব্দুল হাফিজ, এল, এল, বি, জে, কে এম, আবদুল আজীজ ও আলহাজ নূর বখশ।
চট্টগ্রামে ক্ষোভ প্রকাশ
গত ৯ই মে চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ অফিসে এক সভায় নেতৃবৃন্দের গ্রেফতারে ক্ষোভ প্রকাশ করিয়া শীঘ্রই তাহাদের মুক্তি দাবী করা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন ডাঃ সৈয়দুর রহমান চৌধুরী। সভায় বিভিন্ন বক্তা সরকারের দমননীতির কঠোর সমালােচনা করিয়া এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে, দেশবাসীর ন্যায্য দাবী প্রতিফলন করিয়া যদি কারাবরণ করিতে হয়, তবে কারাবরণের জন্য এই দেশে লােকের অভাব হইবে না। তাহারা অবিলম্বে আটক নেতৃবৃন্দের মুক্তি দাবী করেন।
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক॥ দ্বিতীয় পর্ব