You dont have javascript enabled! Please enable it! 1966.05.10 | চিন্তা ও বাক-স্বাধীনতার উপর নয়া হামলার তীব্র নিন্দা- অবিলম্বে আটক নেতৃবৃন্দের মুক্তি দাবী | দৈনিক ইত্তেফাক - সংগ্রামের নোটবুক

দৈনিক ইত্তেফাক
১০ই মে ১৯৬৬

‘অসঙ্গত ও নীতি বিগর্হিত *অযাচিত ও জবরদস্তিমূলক’ *উদ্দেশ্যপ্রণােদিত
নেতৃবৃন্দের আটকের প্রতিবাদে তুমুল ক্ষোভঃ
চিন্তা ও বাক-স্বাধীনতার উপর নয়া হামলার তীব্র নিন্দা
অবিলম্বে আটক নেতৃবৃন্দের মুক্তি দাবী
(স্টাফ রিপাের্টার)

শেখ মুজিবর রহমানসহ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে দেশরক্ষা আইনবলে গ্রেফতার করিয়া কারাগারে আটকের সংবাদে রাজধানী ঢাকার সর্বমহলে যুগপৎ বিস্ময় ও ক্ষোভের সঞ্চার হয়।
জাতীয় পরিষদে বিরােধী দলের নেতা জনাব নুরুল আমীন এক বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে গৃহীত এই ব্যবস্থাকে ‘চিন্তা ও বাক-স্বাধীনতার উপর নয়া হামলা’ বলিয়া অভিহিত করিয়া বলেন যে, যুদ্ধোত্তরকালেও দেশরক্ষা আইনবলে বিনাবিচারে নেতৃবৃন্দের এই আটক কেবল অসঙ্গতঃই নহে-নীতি বিগহিতও।
জাতীয় পরিষদে বিরােধী দলের সহকারী নেতা শাহ আজিজুর রহমান নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে গৃহীত এই ব্যবস্থাকে ‘অযাচিত’ ও ‘জবরদস্তিমূলক’ বলিয়া অভিহিত করেন। তিনি বলেন যে, ধৃত নেতৃবৃন্দের কণ্ঠে আঞ্চলিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের সার্বজনীন দাবীই ধ্বনিত হইতেছিল। নেজামে ইসলাম নেতা জনাব ফরিদ আহমদ এক বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দের এই আটককে উদ্দেশ্যপ্রণােদিত’ বলিয়া অভিহিত করিয়া বলেন যে, সরকার শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযােগে যে মামলা দায়ের করিয়াছেন, তাহার ফলাফল জানা পর্যন্ত অপেক্ষা করাও কি সরকারের পক্ষে সম্ভব ছিল না? তিনি বলেন যে, নেতৃবৃন্দকে কারাগারে নিক্ষেপ করিয়া গণআন্দোলন কখনও স্তব্ধ করা যায় না। ন্যাপ-সম্পাদক সৈয়দ আলতাফ হােসেন, জাতীয় পরিষদ সদস্য জনাব কামরুজ্জামান এবং যশাের ও কুমিল্লার আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিব প্রমুখের আটকের তীব্র নিন্দা করিয়া অবিলম্বে তাঁহাদের মুক্তি দাবী করেন।
নূরুল আমীন
জাতীয় পরিষদে বিরােধী দলের নেতা জনাব নূরুল আমীন, শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য নেতাকে বিনাবিচারে দেশরক্ষা আইনে আটক রাখার ব্যবস্থাকে চিন্তা ও বাক-স্বাধীনতার উপর নয়া হামলা বলিয়া অভিহিত করিয়া বলেন যে, গণতন্ত্রমনা মানুষ মাত্রেই ইহাকে ধিক্কার দিবে। তিনি বলেন যে, সরকার উপর্যুপরি দেশবাসীকে এই আশ্বাসই দিয়াছেন যে, দেশরক্ষা আইন একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা এবং ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট জরুরী পরিস্থিতি মােকাবিলার জন্যই অস্থায়ীভাবে এই আইন প্রণয়ন করা হইয়াছে। তাই, প্রয়ােজনের বাহিরে বা যুদ্ধাবসানের পরও দেশরক্ষা আইনের এই প্রয়ােগ বা ব্যবহার শুধু অসঙ্গতই নয় নীতি বিগর্হিতও বটে।
শাহ আজিজ
জাতীয় পরিষদের বিরােধী দলের ডেপুটি নেতা ও আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী দলের নেতা শাহ আজিজুর রহমান আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের গ্রেফতারের তীব্র নিন্দা করিয়া তাহাদের আশু মুক্তি দাবী করেন। তিনি বলেন যে, শেখ মুজিবর রহমান ও আওয়ামী লীগের অপরাপর নেতা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের সার্বজনীন দাবীই ব্যক্ত করিয়া তুলিয়াছেন। তিনি বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে সর্বত্র বিভিন্ন আদালতে শেখ মুজিবর রহমানের বিরুদ্ধে নানাবিধ নির্দিষ্ট মামলা বিচারাধীন আছে। যদি তিনি কোন অন্যায় করিয়া থাকেন বা দেশের কোন আইন লংঘন করিয়া থাকেন তবে সংশ্লিষ্ট আদালতে তাহার বিচার হইবে। নির্দিষ্ট মামলা যেখানে বিচারাধীন আছে সেক্ষেত্রে তাহাদের গ্রেফতারের ও আটকের কোন যৌক্তিকতা নাই। শাহ আজিজ বলেন যে, আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের গ্রেফতার জবরদস্তিমূলক এবং নিতান্তই অনাবশ্যক। নেতৃবৃন্দের গ্রেফতারের ফলে দেশে ব্যাপকভাবে অসন্তোষ ও প্রতিবাদের ঝড় উঠিয়াছে। তিনি আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের আশু মুক্তি দাবী করেন।
কামরুজ্জামান
জাতীয় পরিষদে সম্মিলিত বিরােধী দলের সম্পাদক ও আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্য জনাব এ, এইচ, এম, কামরুজ্জামান আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের গ্রেফতারের তীব্র নিন্দা করেন। তিনি সরকারকে স্মরণ করাইয়া দেন যে, রাজনৈতিক প্রশ্নে নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দ্বারা কোনদিনই প্রতিপক্ষকে পর্যুদস্ত করা যায় না। নির্যাতন ও নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করিলে দেশে শান্তি ও শৃংখলা বিঘ্নিত হইবারই আশঙ্কা থাকে। জনাব কামরুজ্জামানও দফার প্রশ্নে সরকারকে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের আহ্বান জানান। অবিলম্বে তিনি আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দসহ সকল রাজবন্দী ও প্রতিরক্ষা আইনে আটক বন্দীদের মুক্তি দাবী করেন।
ফরিদ আহমদ
নেজামে ইসলাম নেতা জনাব ফরিদ আহমদ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের গ্রেফতারের নিন্দা করিয়া তাহাদের আশু মুক্তি দাবী করেন। তিনি সরকারকে উদ্দেশ্য করিয়া বলেন যে, নেতৃবৃন্দকে জেলে পুরিয়া দিয়া আন্দোলন দমানাে যায় না। জাতীয় পরিষদ সদস্য জনাব মাহমুদ আলী বলেন যে, আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের আটক সরকারের একটি অন্যায়, নীতি বিগর্হিত ও নির্যাতনমূলক ব্যবস্থার অন্যতম। দেশের আইন ভঙ্গ করিলে আদালতে বিচারের সম্মুখীন হওয়ার অধিকার নাগরিক মাত্রেরই আছে। বিশেষ ধরনের রাজনীতি করিতে গিয়া রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের আটক করিয়া রাখা শুধু গণতন্ত্রের বিরুদ্ধাচরণই নয়, এই ব্যবস্থা স্বাধীনতার উপরই একটা প্রত্যক্ষ হামলা।
সৈয়দ আলতাফ হােসেন
পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপ-এর সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আলতাফ হােসেন গত রাত্রে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবর রহমান ও অন্যান্য নেতার গ্রেফতারের তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জ্ঞাপন করেন। তিনি বলেন, কেহ জনগণের অধিকার ও স্বার্থের কথা বলিলেই তাহার বিরুদ্ধে অত্যাচার ও নিপীড়ন শুরু হয়। ন্যাপ নেতা আরও বলেন, শেখ মুজিবর রহমান ও তাহার দল পূর্ব পাকিস্তানের অভাব-অভিযােগ সম্বলিত ৬-দফা দাবী উত্থাপন করায় সম্প্রতি কর্তৃপক্ষের কোপ দৃষ্টিতে পতিত হন। দেশের গণতন্ত্রমনা প্রত্যেক নাগরিককে শেখ মুজিবর রহমান ও অন্যান্য নেতার এই গ্রেফতারের প্রতিবাদে আগাইয়া আসার জন্য ন্যাপ’ সম্পাদক সৈয়দ আলতাফ হােসেন আহ্বান জানান।
মসিহুর রহমান
সাবেক প্রাদেশিক মন্ত্রী ও বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা জনাব মসিহুর রহমান এক বিবৃতিতে শেখ মুজিবর রহমানসহ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনে গ্রেফতারের নিন্দা করেন। তিনি বলেন যে, নির্যাতন ও নিপীড়নের দ্বারা কোন সরকারই কোন গণ-দাবী স্তব্ধ করিতে পারে নাইআমাদের দেশের ক্ষমতাসীনরাও পারিবেন না।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক॥ দ্বিতীয় পর্ব