You dont have javascript enabled! Please enable it! 1966.04.25 | সংগ্রাম চলবেই: পল্টনের বিশাল জন-সমুদ্রে নেতৃবৃন্দের ঘােষণা | দৈনিক ইত্তেফাক - সংগ্রামের নোটবুক

দৈনিক ইত্তেফাক
২৫শে এপ্রিল ১৯৬৬

সংগ্রাম চলবেই: পল্টনের বিশাল জন-সমুদ্রে নেতৃবৃন্দের ঘােষণা
সভাপতির আসন শূন্য রাখিয়া সভার কাজ পরিচালনা
‘বিভক্ত’ জাতিকে সত্যিকারে ঐক্যবদ্ধ করার ব্যাপারে
৬-দফার তাৎপর্য ব্যাখ্যা
(ষ্টাফ রিপাের্টার)

গত ২০শে মার্চ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশন শেষে পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় শ্রোতৃমণ্ডলীর পীড়াপীড়িতে পুনরায় পল্টন ময়দানে জনসভা করিয়া শেখ মুজিবর রহমান ৬-দফা সম্পর্কে তাঁহার বক্তব্য বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন, গতকাল (রবিবার) পল্টন ময়দানে সেই প্রতিশ্রুত জনসভাই অনুষ্ঠিত হইয়া গেল, তবে শেখ সাহেবের অনুপস্থিতিতে সভাপতির আসন শূন্য রাখিয়া।
শেখ সাহেবকে ময়মনসিংহের কারাগারে রাখিয়াই এইদিন পল্টন ময়দানে সভার কাজ শুরু করা হয়। নির্ধারিত সময়ের বহু পূর্বেই সভাস্থল জনসমুদ্রে পরিণত হওয়ায় পূর্ব ঘােষণানুযায়ী ঠিক ৪টায়ই সভার কাজ শুরু হয়। সভায় প্রধান বক্তা ও প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবর রহমানের হয়রানির প্রতিবাদে ও তাঁহার প্রতি সম্মানের নিদর্শন স্বরূপ পল্টন ময়দানের এই দিনকার এই মহতী জনসভায় সভাপতির আসন শূন্য রাখার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করা হইলে শ্রোতৃমণ্ডলী এই সিদ্ধান্তকে তুমুল করতালির মধ্যে বিপুলভাবে অভিনন্দিত করেন। সভাপতির শূন্য আসনের পার্শ্বে মঞ্চে বসিয়া সভার কাজ পরিচালনা করেন আওয়ামী লীগের অন্যতম সহ-সভাপতি জনাব হাফেজ হাবিবুর রহমান। জনসভায় সভাপতির আসন শূন্য থাকা পাকিস্তানের ইতিহাসে ইহাই প্রথম। ঠিক নির্ধারিত সময়ে সভার কাজ আরম্ভ হওয়াও সাম্প্রতিক কালের পল্টন ময়দানে ইহাই প্রথম। প্রতিটি বক্তার কণ্ঠেই ধ্বনিত হয় ও অত্যাচার-নির্যাতন যত আসে আসুক-সংগ্রাম চলিবেই। মূল বক্তা শেখ মুজিবর রহমান, মামলাঘটিত কারণে কারাগারে আটক থাকিয়াই যেন এই সভার গুরুত্ব বাড়াইয়া দেন। প্রধান বক্তার অবর্তমানে সভায় ৬-দফায় ‘কি এবং কেন ব্যাখ্যা করিয়া এ বিষয়ে অপপ্রচারের জবাব দেন মেসার্স জহিরুদ্দীন, খােন্দকার মুশতাক আহমদ, মিজানুর রহমান চৌধুরী এম-এন-এ, খােন্দকার রফিকুল হােসেন, আওয়ামী লীগ সম্পাদক জনাব তাজুদ্দীন আহমদ, চট্টগ্রামের জহুর আহমদ চৌধুরী ও আওয়ামী লীগের সমাজকল্যাণ দফতরের সেক্রেটারী ওবায়দুর রহমান। প্রস্তাব পাঠ করেন ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি জনাব শামসুল হক।
সভার সূচনাতে ও সভা চলাকালীন কয়েকদফা আবহাওয়া ঘােরালাে হইয়া উঠিলেও, এমনকি কখনওবা ছিটেফোঁটা বৃষ্টি পড়িলেও শ্রোতৃমণ্ডলী অধীর আগ্রহে নেতৃবৃন্দের বক্তৃতা শ্রবণ করেন এবং ৬-দফা কেন’ পর্যায়ে নেতৃবৃন্দ যখন সংখ্যাতত্ত্ব ও ঘটনাপঞ্জীর সাহায্যে পাকিস্তানের বিগত ১৮ বছরের শাসনের ইতিহাসের বিভিন্ন দিক পর্যালােচনা করিতে থাকেন, উপস্থিত শ্রোতৃমণ্ডলী তখন কখনও তুমুল করতালি দিয়া, কখনওবা শ্লোগানের মাধ্যমে, আবার কখনওবা ‘শেম শেম’ ধ্বনি তুলিয়া বক্তার বক্তব্যের প্রতি সমর্থন জানাইতে থাকে। সভার শেষ পর্যায়ে ঝড়াে হাওয়ার সহিত টিপ টিপ করিয়া বৃষ্টি পড়িতে শুরু করিলেও সভার ঘােষিত কার্যসূচী অনুযায়ী শ্ৰোতৃমণ্ডলী ফেষ্টুন ও প্লাকার্ড লইয়া বিরাট শােভাযাত্রা সহকারে শ্লোগান দিতে দিতে শহর প্রদক্ষিণ করে। নবাবপুর রােড দিয়া শােভাযাত্রাটি বাহাদুর শাহ পার্ক, সদরঘাট, চকবাজার, জেলগেট প্রভৃতি রাস্তা প্রদক্ষিণ করিয়া মরহুম শহীদ সােহরাওয়ার্দীর মােনাজাতের পর মাজারে আসিয়া সেখান হইতে ছত্রভঙ্গ হয়। জাতীয় পরিষদ সদস্য জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী বক্তৃতার প্রারম্ভে ‘ক্ষমতাসীনদের কাহারাে সহিত আওয়ামী লীগের ব্যক্তিগত বিরােধ নাই বলিয়া ঘােষণা করিয়া সমষ্টিগত কারণে তাহাদের সহিত আওয়ামী লীগের যে বিরােধ, এক এক করিয়া তাহার বিবরণ দেন। তিনি বলেন যে, বিরােধ হইতেছে ১০ কোটি মানুষের ভােটের অধিকার ও মৌলিক অধিকার নিয়া; আইনের ছদ্মবেশে বে-আইনী ব্যবস্থা প্রয়ােগ নিয়া; অত্যাচার আর নিষ্পেষণ নিয়া। জনাব চৌধুরী যখন সংখ্যাতত্তের সাহায্যে পাকিস্তানের বিগত ১৮ বৎসরের ইতিহাসে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি ক্ষমতাসীনদের ‘সুবিচারের ফিরিস্তি তুলিয়া ধরিতে থাকেন, সভাস্থলে তখন এক অপূর্ব নীরবতা বিরাজ করিতে থাকে। প্রতিটি শ্রোতাই যেন সে সংখ্যাতত্ত্ব হৃদয়ে গাঁথিয়া লইতে চাহে। ৫০০ কোটি টাকা করিয়া ২বৎসরে মােট ১,০০০ কোটি টাকা ব্যয় করিলে প্রতি বৎসর ২০০ কোটি টাকার ফসল বিনষ্টকারী বন্যার হাত হইতে পূর্ববাংলাকে রক্ষা করা সম্ভব বলিয়া জনাব সােহরাওয়ার্দীর আমলে ক্রুগমিশন যে রিপাের্ট পেশ করিয়াছিলেন, ক্ষমতাসীন সরকার গত ৮ বৎসরেও সে বাবত এক কপর্দকও ব্যয় করেন নাই বলিয়া তিনি অভিযােগ করেন। জনাব চৌধুরী বলেন যে, এবারকার পাঁচসালা পরিকল্পনায় পূর্ববাংলার বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য যে ২৫০ কোটি টাকা দেওয়া হইয়াছে, তাহাও সরকারের এজমালী তহবিল হইতে দেওয়া হয় নাই। পূর্ব পাকিস্তানের অংশে প্রাপ্য তহবিল হইতেই দেওয়া হইয়াছে। রেলওয়ে শিল্পোন্নয়ন কর্পোরেশন প্রভৃতি প্রদেশের হস্তে ন্যস্ত করার ব্যাপারটিকে তিনি ‘যার যা তার তা’ নিয়মে পাকাবাড়ী ও কাঁচা বাড়ীর বাসিন্দা দুই ভাইর এজমালা সম্পত্তি বন্টনের সহিত তুলনা করেন। সাম্প্রতিক যুদ্ধোত্তর যুগে কেন্দ্রীয় চাকুরীতে লােক সংগ্রহের সংখ্যাতত্ত্ব ভিত্তিক ফিরিস্তিও তিনি শ্ৰোতৃমণ্ডলী সমক্ষে তুলিয়া ধরেন।
উপসংহারে তিনি শেখ মুজিবের হয়রানির কথা উল্লেখ করিয়া বলেন, এক কণ্ঠ স্তব্ধ করিয়া দশ কোটি মানুষের কণ্ঠ কখনও স্তব্ধ করা যাইবে না। তিনি বলেন, বিগত ১৮ বৎসরের শাসন পূর্ব পাকিস্তানকে শ্মশানে পরিণত করিয়াছে। তাই পূর্ব পাকিস্তান আজ এই ৬-দফা দাবী আদায়ের জন্য দৃঢ়সঙ্কল্প। আর দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত এই সংগ্রাম চলিতে থাকিবেই। প্রাক্তন পরিষদ সদস্য খােন্দকার মােশতাক আহমদ ৬-দফার ‘কি ও কেন ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে অতীতে পাকিস্তানের দুই অংশের ঐক্য ও সংহতির স্বার্থে পূর্ব পাকিস্তান বিভিন্ন সময়ে কিভাবে কত ত্যাগ স্বীকার করিয়াছে এক এক করিয়া তাহার বিবরণ দেন। প্রতিদানে পূর্ব পাকিস্তান কি পাইয়াছে-শ্রোতৃমণ্ডলীর উদ্দেশ্যে এই প্রশ্ন তুলিয়া ধরিয়া তিনি নিজেই তাহার বিশদ বর্ণনা দেন এবং বলেন যে, আজ দেশ ও জাতির প্রয়ােজনে, জাতীয় ঐক্য ও সংহতির বৃহত্তর স্বার্থেই আওয়ামী লীগ ৬-দফা প্রস্তাব লইয়া আসিয়াছে। এ প্রস্তাবের বিরােধিতার পরিণাম কাহারও পক্ষে শুভ হইতে পারে না। এ প্রসঙ্গে তিনি প্রাক-আজাদী যুগে ভারতীয় কংগ্রেস কর্তৃক কায়েদে আজমের ঐতিহাসিক ১৪-দফা মানিয়া না লওয়ার পরিণামের কথা স্মরণ করাইয়া দেন। প্রাক্তন পরিষদ সদস্য খােন্দকার রফিকুল হােসেন তাঁহার স্বভাসুলভ রসালাে ভঙ্গীতে ক্ষমতাসীনদের চেহারা জনসমক্ষে তুলিয়া ধরেন। বক্তৃতার পর্যায়ে পর্যায়ে গুরুগম্ভীর কণ্ঠে তিনি কঠোর সত্যের দিকে শ্ৰোতৃমণ্ডলীর দৃষ্টি ফিরাইয়া লইয়া সকলের মনে নূতন নূতন জিজ্ঞাসা জাগাইয়া তুলেন। ১৮ বৎসরের ইতিহাস হইতে শিক্ষা গ্রহণের জন্য তিনি সকলকে আহ্বান জানাইয়া বলেন যে, ১৯৫৪ সালের আগে যে জনাব সবুর, মােনায়েম খাঁ ও ওয়াহিদুজ্জামানরা দেশবাসীর সেবার ঠেলায় সাধারণ নির্বাচনে উৎখাত হইয়াছিলেন, ১৯৫৮ সালের ক্ষমতা দখলকারীরা তাহাদিগকেই আবার কোলে তুলিয়া লইয়া ইহাই প্রমাণ করিয়াছেন যে, জনগণ যাহাদের হাত হইতে নিষ্কৃতি পাইতে চাহিয়া সেদিন ঐতিহাসিক রায় দিয়াছিল, সেই তাহাদিগকেই আবার গােপন পথে জনগণের স্কন্ধে সওয়ার করাই ছিল সেদিনকার সে ‘বিপ্লবের মূল লক্ষ্য। অর্থাৎ জনগণের ইচ্ছানুযায়ী দেশ শাসন করা হইবে- ইহা তাহাদের কাম্য নয়। জনাব রফিকুল হােসেন দৃপ্তকণ্ঠে ঘােষণা করেন যে, ৬-দফা দাবী পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করিবে বলিয়া যাহারা দাবী করেন, তাঁহারা মিথ্যা বলেন। তিনি বলেন, বরং ক্ষমতাসীন সরকারের অনুসৃত নীতিই বর্তমানে দেশকে নানাদিক দিয়া বিভক্ত করিয়া রাখিয়াছে। জনাব রফিক বলেন, এই বিভক্ত অবস্থার অবসান ঘটাইয়া দুই অংশের মধ্যে সত্যিকার ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠাই ৬-দফার লক্ষ্য।
তিনি বলেন, আজাদী অর্জন কালেই কেবল ১০ কোটি মানুষের মধ্যে একবার সত্যিকার ঐক্য গড়িয়া উঠিয়াছিল। তারপর আর তাহাদের ঐক্যবদ্ধ হইতে দেওয়া হয় নাই। আওয়ামী লীগের ৬-দফাই হইল ১০ কোটি মানুষের আবার সত্যিকার ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সােপান।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক॥ দ্বিতীয় পর্ব