You dont have javascript enabled! Please enable it! 1966.04.19 | শেখ মুজিবর রহমান গ্রেফতার : জামিনে মুক্তি লাভ | দৈনিক ইত্তেফাক - সংগ্রামের নোটবুক

দৈনিক ইত্তেফাক
১৯শে এপ্রিল ১৯৬৬

শেখ মুজিবর রহমান গ্রেফতার : জামিনে মুক্তি লাভ
এবার দেশরক্ষা বিধিবলে আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের
(ইত্তেফাকের বিশেষ প্রতিনিধি প্রেরিত)

যশাের, ১৮ই এপ্রিল। – গতকাল রাত্রি চারটায় পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনের ৪৭(৫) ধারাবলে পুলিস পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবর রহমানকে খুলনা হইতে সদলবলে ঢাকা যাওয়ার কালে যশােরে গ্রেফতার করে। যশাের সদর দক্ষিণ মহকুমা হাকিমের এজলাস হইতে শেখ মুজিবর রহমান আজ জামিনে মুক্তি লাভ করেন। উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গ সফর শেষ করিয়া তিনি আজ সদলবলে ঢাকা প্রত্যাবর্তন করিয়াছেন। এই মামলাটি লইয়া বর্তমানে প্রদেশের বিভিন্ন আদালতে শেখ সাহেবের বিরুদ্ধে মােট ৬টি মামলা বিচারাধীন রহিয়াছে।
পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচী অনুযায়ী শেখ মুজিব কাল খুলনায় বিপুল সমাবেশে বক্তৃতাদানের পর সদলবলে ঢাকার পথে মােটরযােগে খুলনা ত্যাগ করেন। পথিমধ্যে আওয়ামী লীগ নেতা ও প্রাক্তন মন্ত্রী জনাব মসিউর রহমানের যশােরস্থ বাসভবনে তিনি সদলবলে আতিথ্য গ্রহণ করেন। গােয়ালন্দে ঢাকাগামী প্রথম ফেরী ধরার জন্য তিনি রাত চারটায় সদলবলে জনাব মসিউর রহমানের বাসভবন হইতে রওয়ানা হন। জনাব মসিউর রহমানের বাসভবন হইতে মাত্র বিশ গজ যাওয়ার পরই পুলিস মােটরের গতিরােধ করে। খুলনায় পােষ্টিং জনৈক ডি, আই, বি সাব-ইন্সপেক্টর এই পুলিস দলের নেতৃত্ব করিতেছিলেন। উক্ত অফিসারটি গ্রেফতারি পরােয়ানা প্রদর্শন না করিয়া শেখ সাহেবকে যশাের কোতওয়ালী থানায় যাওয়ার অনুরােধ করেন। শেখ সাহেব গ্রেফতারি পরােয়ানা প্রদর্শন না করিলে থানায় যাইতে অস্বীকার করিলেও অফিসারটি পরােয়ানাটি দেখাইতে বিরত থাকেন। এক পর্যায়ে জনাব মসিউর রহমান ও জনাব তাজুদ্দিনও শেখ সাহেবের সঙ্গে একযােগে গ্রেফতারি পরােয়ানা প্রদর্শনের দাবী জানাইলে অফিসারটি দ্বিধাজড়িত ভাবে পকেট হইতে একটি কাগজ বাহির করেন। উক্ত কাগজখানি ঢাকা হইতে খুলনা পুলিসের নিকট একটি “রিকুইজিশন অর্ডার”। উক্ত অর্ডারে শেখ সাহেবকে গ্রেফতার করিয়া নিকটস্থ কোন ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে তাঁহাকে পেশ করিতে বা ঢাকা প্রেরণ করিতে বলা হইয়াছে। গতকাল ঢাকার রমনা থানায় দায়েরকৃত ৮০নং মামলার গ্রেফতারি পরােয়ানা বলিয়া উহাতে উল্লেখ ছিল। খুলনা পুলিস গতকালই বেলা ১১টায় এই নির্দেশনামা পাইয়াছে বলিয়া ঐ অর্ডারে উল্লেখ আছে। উক্ত অর্ডারে যশাের ডেপুটি কমিশনারের “এণ্ডোর্সমেন্ট না থাকায় শেখ সাহেব এই গ্রেফতারি পরােয়ানা অবৈধ বিধায় উহার নির্দেশ পালন করিতে অস্বীকার করেন। তিনি পুলিসকে বলেন যে, তিনি উক্ত পরােয়ানাকে অগ্রাহ্য করিয়া চলিয়া যাইতে পারেন, তবে তিনি বিশৃংখলা সৃষ্টি করিতে চান নাই বলিয়া পুলিসকে গ্রেফতারি পরােয়ানাটি আইনতঃ সিদ্ধ করিয়া আনার সুযােগ দেন।
পুলিস শেখ সাহেবকে যশােরে আটক করায় তাহার পক্ষে আজ ঢাকার প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিষ্ট্রেট জনাব এম, এ, মালেকের আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে আনীত রাষ্ট্রদ্রোহী মামলায় হাজির হওয়া সম্ভব হয় নাই। এই আদালতে আলােচ্য মামলার সওয়াল-জওয়াব অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল।
আজ বেলা দশটায় পুলিস শেখ সাহেবকে যশাের সদর (দক্ষিণ) মহকুমা হাকিম জনাব সােলায়মানের আদালতে হাজির করিলে এডভােকেট জনাব মসিউর রহমানের নেতৃত্বে যশাের বারের ১৫ জন আইনজীবী শেখ সাহেবের জামিনের আবেদন করেন। মাননীয় মহকুমা হাকিম শেখ মুজিবর রহমান আগামী ২১শে এপ্রিলে পূর্বে ঢাকায় প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিষ্ট্রেট জনাব এম, এ, মালেকের আদালতে আত্মসমর্পণ করিবেন-এই শর্তে তাঁহাকে ৫ হাজার টাকার জামিন ও সমপরিমাণ অর্থের মুচলেকায় মুক্তি দান করেন। মাননীয় ম্যাজিষ্ট্রেট তাহার নির্দেশে বলেন যে, শেখ মুজিবর রহমান একজন স্বীকৃত জননেতা এবং সমগ্র বিষয়টি পর্যালােচনা করিয়া আমার ধারণা জন্মিয়াছে যে, এইক্ষেত্রে জামিন মঞ্জুর করা যাইতে পারে।
আবেদনকারীর পক্ষে এডভােকেট মসিউর রহমান আদালতে বলেন যে, আজ ঢাকায় একটি মামলায় হাজিরা দেওয়ার জন্যই শেখ মুজিবর রহমান যে ঢাকা যাইতেছিলেন এই সংবাদ গতকাল সংবাদপত্রে প্রকাশিত হইয়াছে। তিনি আদালতে সংবাদপত্র হইতে সংশ্লিষ্ট অংশটি পড়িয়া শােনান। তিনি বলেন যে, শেখ মুজিবর রহমান একজন সাধারণ নাগরিক মাত্র নন, তিনি পাকিস্তানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনেতিক দলের স্বীকৃত নেতা। তাঁহার সফর ও কর্মসূচী সংবাদপত্রের মারফতে সাধারণ্যে প্রকাশ করা হয়। পুলিসও তাঁহার সফরসূচীর সংবাদ রাখে। এমতাবস্থায় পথিমধ্যে শেষরাত্রে তাঁহার গতিপথ রােধ করার পশ্চাতে একজন নাগরিককে অহেতুক হেস্তনেস্ত করার প্রবণতা রহিয়াছে। তাছাড়া রমনা থানার মামলায় শেখ সাহেবের অপরাধের প্রকৃতি সম্বন্ধে কোন কিছু উল্লেখ করা নাই।
শেখ মুজিবকে আদালতে উপস্থিত করা হইলে আদালত কক্ষে তিলধারণের ঠাই ছিল না। আদালত অঙ্গনেও তখন ভিড় জমিয়া উঠে। আদালত শেখ সাহেবকে জামিন মঞ্জুরীর কথা ঘােষণার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত জনতা উল্লাসে ফাটিয়া পড়ে। শেখ সাহেব আদালত কক্ষের বাহিরে আসিলে উপস্থিত জনতা তাহাকে বিপুলভাবে মাল্যভূষিত করে ও নানারূপ ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত করিয়া তােলে। জনতা অতঃপর মিছিল করিয়া শেখ মুজিব ও তাঁহার দলের অন্যান্যকে জনাব মসিউর রহমানের বাসভবনে লইয়া যায়।
প্রসংগতঃ উল্লেখযােগ্য যে, গত রবিবারে (১৭ই এপ্রিল) ঢাকার রমনা থানায় রুজুকৃত ৮০নং মামলার আসামী হিসাবে ঐদিনই সকাল বেলায় শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে এই গ্রেফতারী পরােয়ানা জারি করা হয়। রমনা থানার সহিত যােগাযােগ করিয়া জানা গেল যে, গত ২০শে মার্চ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশন শেষে স্থানীয় আউটার স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত জনসভায় “রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আপত্তিকর” উক্তি করায় শেখ সাহেবের বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করা হইয়াছে।
শেখ মুজিবের জামিনের আবেদনে এডভােকেট মসিউর রহমানকে অপর যে ১৪ জন আইনজীবী সহায়তা করেন তাঁহারা হইতেছেন এডভােকেট নূরুল ইসলাম, উকিল মেসার্স রওশন আলী (যশাের জেলা আওয়ামী লীগ সম্পাদক), আনােয়ারুল কাদের, সৈয়দ মুকাররম হােসেন ফারাজী ও মােশাররফ হােসেন এবং মােক্তার মেসার্স আবদুল হক খান, ফজলুল করিম, এ, এস, গজনবী, সৈয়দ আলী, আলতাফ হােসেন, আবদুর রশীদ খান, সাহাদাৎ হােসেন ও আরশাদ আলী।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক॥ দ্বিতীয় পর্ব