দৈনিক ইত্তেফাক
২৬শে ফেব্রুয়ারী ১৯৬৬
৬-দফার প্রতি লালদীঘির বিরাট জনসভার অকুণ্ঠ সমর্থন
‘দেশ ও দশের বৃহত্তর কল্যাণের খাতিরে
দাবী আদায়ের জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকারের সংকল্প ঘােষণা
(ইত্তেফাকের চট্টগ্রাম অফিস হইতে)
২৫শে ফেব্রুয়ারী।- অদ্য বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘি ময়দানে অনুষ্ঠিত প্রায় ৬ ঘণ্টাব্যাপী পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সম্প্রতি ঘােষিত ৬-দফা কর্মসূচীর প্রতি চট্টগ্রামবাসী অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করিয়া দেশ ও দশের বৃহত্তর স্বার্থে জনগণের আশা ও আকাংক্ষার ভিত্তিতে সুস্পষ্ট কর্মসূচীর ভিত্তিতে নেতৃত্ব দিতে আগাইয়া আসায় আওয়ামী লীগের প্রতি অভিনন্দন জানান হয়। সভায় গৃহীত এই প্রস্তাবে দেশের আপামর জনসাধারণকে ৬-দফার ভিত্তিতে দেশব্যাপী দুর্বার আন্দোলন গড়িয়া তােলার আহ্বান জানান হয়। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযােগ্য যে, প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের ৬- দফা কর্মসূচীর প্রতি জনমত যাচাইর প্রয়াস ইহাই প্রথম। এই উপলক্ষে শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে ঢাকা হইতে আগত আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ আজ চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আয়ােজিত লালদীঘি ময়দানের জনসভায় দলীয় ৬- দফার বিভিন্ন দিকের উপর আলােকপাত করিয়া বক্তৃতা করেন। বিগত কিছুদিন যাবৎ কেবল পত্রপত্রিকার পৃষ্ঠায় যে ৬-দফার কথা শুনিয়া আসিয়াছেন, আজ নেতৃবৃন্দের মুখ হইতে প্রত্যক্ষভাবে উহার পটভূমি, জাতীয় জীবনে উহার তাৎপর্য ও আগামীদিনের করণীয় কর্তব্য সম্পর্কে বিস্তারিত পথনির্দেশ পাইবার জন্য লালদীঘি ময়দানে সভার বহু পূর্ব হইতেই বিপুল জনসমাগম হয়। নেতৃবৃন্দের বক্তৃতায় উপস্থিত শ্রোতৃমণ্ডলী এতই উৎসাহিত বােধ করিতে থাকে যে, শেখ মুজিবের আহ্বানে শূন্যে হস্ত উত্তোলন করিয়া একবাক্যে তাঁহারা ঘােষণা করে যে, ৬-দফার বাস্তবায়নের মধ্যদিয়া দেশ ও দশের সত্যিকার কল্যাণসাধনের সংগ্রামে যে-কোন বাধাবিপত্তি তাঁহারা হাসিমুখে বরণ করিতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। সমস্বরে উচ্চারিত ‘৬-দফা মানতে হবে’, ‘আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দিতে হইবে’ প্রভৃতি ধ্বনির মধ্যদিয়া তাঁহারা আওয়ামী লীগের দাবীকে বুলন্দ করিয়া তােলে। বিপুল করতালির মধ্যে শেখ মুজিবর রহমান লালদীঘির জনসমুদ্রকে উদ্দেশ করিয়া বলেন, আমরাও আজ বার্ধক্যের কোঠায় আসিয়া পৌছিতে চলিয়াছি। নূতন দিগন্তে আজ আমরা নূতন মুখের দেখা পাইতেছি। অন্ততঃ এই নূতনদের জীবনকে যাহাতে আমরা বঞ্চনা ও নির্যাতনমুক্ত করিয়া তাহাদিগকে সুখ ও সমৃদ্ধির নিশ্চয়তার সন্ধান দিয়া যাইতে পারি, তজ্জন্য আসুন আমরা কোরবানীর জন্য প্রস্তুত হই। আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত ছয়-দফাই নূতন দিগন্তের এই নূতনদের মুক্তির সনদ। পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে পাঁচকোটি মানুষের হৃদয় কন্দরে খুঁজিয়া দেখুন, আওয়ামী লীগের ছয়-দফা তাঁহাদের প্রতিটি হৃদয়েই স্পন্দিত হইতেছে। বিগত যুদ্ধের শঙ্কাকুল দিনগুলির কথা ভাবিয়া দেখুন। জাতীয় সংহতির সেই চরমতম পরীক্ষার মুহূর্তগুলির প্রেক্ষিতে এইসব দাবীর প্রয়ােজনীয়তা ও গুরুত্ব আরও বেশী প্রকট হইয়া দেখা দিয়াছে। শেখ মুজিব বলেন যে, বিগত যুদ্ধের আলােকে গােটা দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাদির চুলচেরা বিচার করিয়াই আওয়ামী লীগ স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছে যে, বিশ্ব মানচিত্রে পাকিস্তানকে একটি শক্তিশালী ও সত্যিকার সুসংহত জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করিতে হইলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার ভুল বুঝাবুঝির চির অবসান ঘটাইতে হইবে। পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থীমহল এবং এই মহলের যেসব এজেন্ট পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সৃষ্টির পর হইতে আজও তৎপর আছেন, তাহাদের শেষবারের মত আজ উপলব্ধি করিতে হইবে যে, পাকিস্তানের এক অংশকে অন্য অংশের অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক উপনিবেশে পর্যবসিত করা সম্ভব নয় আর সত্যিকার অর্থে তাঁহাদের এ প্রচেষ্টা পাকিস্তানকে দুর্বল করারই নামান্তর। তাদের আরও বুঝিতে হইবে যে, পূর্ব পাকিস্তানবাসীরা তাহাদের কারচুপি ধরিয়া ফেলিয়াছে, এবং সেইজন্যই তাঁহারা আজ বিগত কালের “ঠাণ্ডাযুদ্ধের অবসান ঘটাইয়া পাকিস্তানকে মজবুত করিতে বদ্ধপরিকর। আর এই উদ্দেশ্য লইয়াই পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের আশা-আকাংক্ষা মােতাবেক আওয়ামী লীগ এই ৬-দফা প্রণয়ন করিয়াছে। শেখ মুজিবর রহমান দেশবাসী আপামর জনসাধারণকে উদ্দেশ করিয়া বলেন, প্রকৃত অর্থে এই ৬-দফা কর্মসূচী আওয়ামী লীগের নয়,এই ৬-দফা পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের। এই ৬-দফা বাস্তবায়নের সংগ্রামে যে অত্যাচার-নির্যাতন ভােগ করিতে হইবে, সেই অত্যাচার-নির্যাতনের ভাগী হওয়ার জন্যই আমরা জনতার কাতারে আসিয়া দাঁড়াইয়াছি। জনগণের এই ৬-দফা দাবী আদায়ের সংগ্রামকে জোরদার করার জন্য তিনি দলমত নির্বিশেষে সকল মহলের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।
চট্টগ্রামবাসীদের উদ্দেশ করিয়া তিনি বলেন যে, একদিন সমগ্র পাকভারতের মধ্যে বৃটিশ সরকারের জবরদস্ত শাসনব্যবস্থাকে উপেক্ষা করিয়া এই চট্টগ্রামের জালালাবাদ পাহাড়েই বীর চট্টলের বীরসন্তানের স্বাধীনতার পতাকা উড্ডীন করিয়াছিলেন। আমিও চাই যে, পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চিত মানুষের ন্যায্য দাবী আদায়ে সংগ্রামী পতাকাও চট্টগ্রামবাসীরা চট্টগ্রামেই প্রথম উড্ডীন করুন। তিনি দেশবাসীকে স্মরণ করাইয়া দেন যে, আওয়ামী লীগ একটি অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তাই বলিয়া পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় সেনাবাহিনী বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করিবে, আওয়ামী লীগের একজন কর্মী প্রাণ থাকিতেও তা বরদাশত করিবে না। সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট সকলকে সতর্ক করিয়া দিতে চায় যে, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা লইয়া যারা হেলাফেলা করিয়াছে বা করিতেছে, পূর্ব পাকিস্তানবাসী তাঁহাদের কোনদিন ক্ষমা করিবে না। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার বৈষম্যের উল্লেখ করিয়া শেখ মুজিব বলেন যে, ১৯৪৮ সাল হইতে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানের জাতীয় সম্পদ হইতে মােট ১৪০০ কোটি টাকা ব্যয় করা হইয়াছে। আর সেই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয় করা হইয়াছে মাত্র ৫৪০ কোটি টাকা। অথচ এই সময়সীমার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় সম্পদের শতকরা ৬০ ভাগ উপার্জন করিয়াছে। বিদেশী সাহায্যেরও শতকরা ৮০ ভাগ পশ্চিম পাকিস্তানে বিনিয়ােগ করা হইয়াছে। শেখ সাহেব বলেন যে, কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরিতেও আজ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানীদের সংখ্যা শতকরা ২৫ ভাগের উপরে উঠিতে পারে নাই। শেখ মুজিবর রহমান লেভি প্রথার তীব্র সমালােচনা করেন। যেসব অঞ্চলে বাধ্যতামূলক লেভি আদায় করা হইতেছে সেইসব অঞ্চলে পূর্ণ রেশনিং ব্যবস্থা কায়েমের জন্য তিনি দাবী জানান। তিনি আমদানী নীতিরও সমালােচনা করেন। তিনি অভিযােগ করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের প্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদি বােনাস ভাউচারে আমদানী করিয়া একদিকে মনােপলিষ্ট ও কার্টেলিষ্টদের বেপরােয়া মুনাফা লুটার সুযােগ দেওয়া হইয়াছে। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানীদের দৈনন্দিন জীবনকে দুর্বিষহ করিয়া তােলা হইয়াছে। আওয়ামী লীগ নেতা খােন্দকার মােশতাক আহমদ প্রধানতঃ ৬-দফার অর্থনৈতিক দিক সম্বন্ধে বিস্তারিত আলােচনা করেন। তিনি দেশ ও দশের কল্যাণকামী মন লইয়া পশ্চিম পাকিস্তানী অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিকগণকে আওয়ামী লীগের ৬-দফা পরীক্ষা করিয়া দেখার অনুরােধ করেন। তিনি বলেন যে, যিনিই দেশ ও দশের স্বার্থকে সর্বোপরি স্থান দিবার মানসিকতার পরিচয় দিতে পারিবেন, তিনিই আমাদের সহিত একমত হইবেন যে, ৬-দফার বাস্তবায়ন ছাড়া শক্তিশালী ও সুসংহত পাকিস্তানের স্বপ্ন কেবল স্বপ্নই থাকিয়া যাইবে। জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্য জনাব মীজানুর রহমান চৌধুরী ও প্রাদেশিক পরিষদে বিরােধী দলের নেতা জনাব আবদুল মালেক উকিলও সভায় বক্তৃতা করেন।
প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের শ্রম সম্পাদক জনাব জহুর আহমদ চৌধুরী সভায় সভাপতিত্ব করেন। অদ্যকার সভায় বিশেষ লক্ষ্যণীয় বিষয় ছিল এই যে, রাত্রি দশটা পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় ছয় ঘণ্টা সভা চলিলেও সভায় শেষপর্যন্ত কোন শ্রোতাকেই স্থান ত্যাগ করিতে দেখা যায় নাই। পক্ষান্তরে, বিভিন্ন বক্তার বক্তৃতাকালে শ্রোতৃমণ্ডলীর মুহুর্মুহু করতালি ও শ্লোগানের মধ্যদিয়া বক্তার কথায় সমর্থন জানান। সভা শেষে তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে গৃহীত একটি প্রস্তাবের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ৬-দফার প্রতি লালদীঘির শ্ৰোতৃমণ্ডলী অকুণ্ঠ সমর্থন জানায় ও দেশবাসীর আশা ও আকাংক্ষার নিরিখে সুস্পষ্ট কর্মসূচী গ্রহণের ব্যাপারে সময়ােচিত নেতৃত্ব দিতে আগাইয়া আসায় আওয়ামী লীগকে অভিনন্দন জানায়। প্রস্তাবে প্রদেশব্যাপী ৬-দফার সমর্থনে দুর্বার গণআন্দোলন গড়িয়া তােলার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে পাঁচকোটি মানুষের প্রতি উদাও আহ্বান জানান হয়। সভায় গৃহীত অপর এক প্রস্তাবে শান্তিপূর্ণ পথে সকল সমস্যার সমাধানের মাধ্যমে ভারতসহ সকল প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তিতে বসবাস করার দৃঢ় সঙ্কল্প প্রকাশ করা হয়।
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক॥ দ্বিতীয় পর্ব