You dont have javascript enabled! Please enable it! 1965.12.21 | বাত্যা-উপদ্রুত এলাকা সফরান্তে শেখ মুজিবরের জিজ্ঞাসা- দীর্ঘ ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেও অনুসন্ধানী দল প্রেরিত না হওয়ার কারণ কি? | দৈনিক ইত্তেফাক - সংগ্রামের নোটবুক

দৈনিক ইত্তেফাক
২১শে ডিসেম্বর ১৯৬৫

বাত্যা-উপদ্রুত এলাকা সফরান্তে শেখ মুজিবরের জিজ্ঞাসা
দীর্ঘ ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেও অনুসন্ধানী দল প্রেরিত না হওয়ার কারণ কি?
জাতীয় জরুরী অবস্থার পর্যায়ে গণ্য করিয়া পরিস্থিতি মােকাবিলার
যথাযােগ্য ব্যবস্থা দাবী

চট্টগ্রামের ঘূর্ণিবাত্যা দুর্গত এলাকা সফর শেষে ঢাকা প্রত্যাবর্তন করিয়া গতকল্য (সােমবার) সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তান। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান বলেন যে, ১৯৫৯ সাল হইতে কয়েকবার প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিবাত্যা ও সামুদ্রিক জলােচ্ছ্বাস পূর্ব পাকিস্তানে আঘাত হানিয়া বহুলােক ও সম্পদ বিনষ্ট করিয়াছে এবং প্রদেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত করিয়া দিয়াছে। কিন্তু ইহা খুবই পরিতাপের বিষয় যে, উপকূলবর্তী এই সকল এলাকা ও দ্বীপসমূহের জনসাধারণের দুর্গতি লাঘবে কার্যকরী কোন পরিকল্পনা গৃহীত হয় নাই। এমনকি স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও সরকারের মধ্যে যােগাযােগ প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থাও করা হয় নাই।
শেখ মুজিবর রহমান এবারকার ঘূর্ণিবাত্যায় ধ্বংসলীলাকে নজিরহীন আখ্যায়িত করিয়া জাতীয় আপদের ভিত্তিতে পরিস্থিতি মােকাবিলা করার জন্য সরকারের নিকট আহ্বান জানান।
তিনি দেশী-বিদেশী বিত্তবানদের নিকট দুর্গতদের সাহায্যে আগাইয়া আসারও অনুরােধ করেন।
বিবৃতিতে শেখ মুজিবর রহমান বলেনঃ গত ১৪ই ও ১৫ই ডিসেম্বর রাত্রে ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলােচ্ছাসে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ জনাব নূরুল ইসলাম চৌধুরী, এম সম্পাদক জনাব জহুর আহমদ চৌধুরী এবং চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ সম্পাদক জনাব এম, এ, আজীজ সমভিব্যাহারে আমি সফর করিয়া গতরাত্রে (রবিবার) ঢাকা প্রত্যাবর্তন করিয়াছি। এবারকার প্রলঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলােচ্ছ্বাসে টেকনাফ, উখিয়া, রামু, কক্সবাজার, চকোরিয়া, মহেশখালী ও সাতকানিয়া থানা এলাকা সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে। তবে, এবারকার এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ নজিরহীন এবং জীবন ও সম্পদের ক্ষতিও সর্বাপেক্ষা বেশী।
বিভিন্ন পত্রিকায় ক্ষয়-ক্ষতির যে বিবরণ প্রকাশিত হইয়াছে, উহা মােটেই অতিরঞ্জিত নহে বলিয়া মনে হয়। দূরবর্তী দ্বীপ এলাকার সহিত যােগাযােগ থাকায় ধন ও প্রাণের ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ এখনও অজ্ঞাত রহিয়াছে।
স্থানীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মীরা এবং সরকারী কর্মচারীরা দুর্গতদের সাহায্য প্রেরণে চেষ্টার ত্রুটি করিতেছেন না। কিন্তু ঘটনার এক সপ্তাহ পরেও পরিবহন সমস্যা উক্ত প্রচেষ্টা ব্যাহত করিতেছে। বেসরকারী লােকদের পরিবহন সমস্যা আরও জটিল। সাহায্যসামগ্রী সংগ্রহ করিয়া উহা দুর্গতদের জন্য প্রেরণ এবং ক্ষয়-ক্ষতির প্রকৃত তথ্য সংগ্রহের জন্য তাহারা কোন যানবাহন পাইতেছেন না। সবচাইতে দুঃখের ব্যাপার এই যে, দুর্ঘটনায় ৪৮ ঘণ্টা পরেও ভাসমান লােককে উদ্ধার করার জন্য কোন ব্যবস্থাই করা হয় নাই। এইরূপ নির্ভরযােগ্য সংবাদও পাওয়া গিয়াছে যে, ঘূর্ণিবাত্যার ৭২ ঘণ্টা পরও বাঁচার জন্য প্রাণপণ সংগ্রামরত লােককে প্রচণ্ড ঢেউয়ে তীরে লইয়া আসার পর উদ্ধার করা হইয়াছে। প্রকাশ, গতকল্য এক সাংবাদিক সম্মেলনে প্রদেশের গভর্ণর জানাইয়াছেন যে, ভাল পােশাক পরিহিত একজন সুদর্শন যুবকের লাশ উদ্ধার করা হইয়াছে। উহা দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, মৃত্যুর পূর্বে উক্ত যুবক বাঁচার জন্য অন্তত ৯৬ ঘণ্টা সংগ্রাম করিয়াছে।
প্রথম সুযােগেই ১৫ই ডিসেম্বর পূর্বাহ্নে গভর্ণর ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা সফরে গিয়াছেন। বেসরকারী মালিকানার যন্ত্রচালিত নৌযান হুকুমদখল করিয়া, সরকারী ও আধা-সরকারী প্রতিষ্ঠান এবং পাকিস্তান নৌবাহিনীর চট্টগ্রাম ইউনিটের সকল নৌযান লইয়া অনুসন্ধান পার্টি গঠনের জন্য গভর্ণর নির্দেশ দিয়াছেন কিনা, জানি না। যথাসময়ে এবং একাগ্রভাবে উদ্ধার কার্য পরিচালিত হইলে ঘূর্ণিঝড়ের কয়েকদিন পরেও জীবন বাঁচানাের জন্য সংগ্রামরত মুমূর্ষ বহুলােককে বাঁচান সম্ভব হইত।
১৯৫৯ সাল হইতে কয়েকবার প্রলঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলােচ্ছ্বাস প্রদেশকে আঘাত হানিয়াছে এবং প্রদেশের বহুলােক ও সম্পদ ধ্বংস করিয়া অর্থনীতিকে পঙ্গু করিয়া দিয়াছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে উপকূলবর্তী এলাকা ও দ্বীপসমূহের জনগণ যে অপরিসীম দুর্দশার সম্মুখীন হয়, উহা লাঘব করার জন্য কোন কার্যকরী ব্যবস্থা গৃহীত হয় নাই। এমনকি স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও সরকারের মধ্যে যােগাযােগ রক্ষা করারও কোন ব্যবস্থা করা হয় নাই। গভর্ণরের মুখেই এই দুঃখজনক পরিস্থিতির স্বীকৃতি মিলিয়াছে। প্রকাশ, গভর্ণর বলিয়াছেন যে, এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সরকারের সাহায্য প্রার্থনা করার মত কক্সবাজারে কোন ওয়ারলেস সেট ছিল না।
অতীতের ন্যায় এবারও শাসনযন্ত্রের উচ্চপর্যায়ের কিছু লােকের মধ্যে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ ও মৃত্যু সংখ্যা কম করিয়া দেখানাের প্রবণতা লক্ষ্য করা গিয়াছে-যদিও এই দুর্যোগের জন্য তাহারা দায়ী নহেন। এই সকল মহল দফায় দফায় ক্ষয়-ক্ষতির বিবরণ প্রকাশ করিতেছেন। মনে হয় যেন একসঙ্গে ক্ষয়-ক্ষতির তথ্য প্রকাশ করা হইলে তাহাদের সুনাম নষ্ট হইবে। এই ধরনের ন্যক্কারজনক মনােভাব নিজেদের দুঃখ-দুর্দশার স্বীকৃতি লাভে উদগ্রীব দুর্গতদের লইয়া তামাসা করার সামিল। প্রাণহানী সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য সংগ্রহের জন্য সকল মৃতদেহ উদ্ধার করা সম্ভব নহে বিধায় সংশ্লিষ্ট এলাকার জনসংখ্যা সম্পর্কে তদন্তের উপর ভিত্তি করিয়া প্রাণহানী সম্পর্কে তথ্য জ্ঞাত হওয়াই যথার্থ পন্থা।
এ ব্যাপারে বাদানুবাদের সৃষ্টি না করার জন্য আমি সকলের প্রতি অনুরােধ জ্ঞাপন করিতেছি। কেননা উহাতে দুর্গতদের কোন লাভ হইবে না। বর্তমান মুহূর্তে সকল মহল হইতে সম্ভাব্য সকল প্রকার সাহায্য প্রেরণ করাই সর্বাপেক্ষা বেশী প্রয়ােজন। দুর্গত এলাকাকে ‘সর্বাপেক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ঘােষণা করার জন্য আমি সরকারের নিকট আহ্বান জানাইতেছি এবং জাতীয় দুর্যোগের ভিত্তিতে পরিস্থিতি মােকাবিলা করার জন্য অনুরােধ জানাইতেছি।
এই প্রচণ্ড শীতের দিনে খাদ্যের পরেই বস্ত্রের প্রয়ােজন। তাই উভয়বিধ সাহায্য প্রেরণ করা দরকার। উল্লিখিত সাহায্যের সাথে মেডিক্যাল সাহায্যও প্রেরণ করা প্রয়ােজন। এই সঙ্গে আমি দুর্গত এলাকায় বিনামূল্যে খাদ্যদান, পূর্ণাঙ্গ রেশনপ্রথা চালু, সুদিন না আসা পর্যন্ত খাজনা ও কর মওকুফ, কৃষকদের গবাদিপশু ও কৃষি উপকরণ সরবরাহ এবং জেলেদের জাল ও নৌকা সরবরাহ করার জন্য আবেদন জানাইতেছি। এই প্রসঙ্গে আমি সকল জাতি এবং বিশেষ করিয়া পাকিস্তানের বিত্তশালীদের সর্বপ্রকার সাহায্য লইয়া অবিলম্বে দুর্গত ভাইদের পাশে দাড়ানাের জন্য আবেদন জানাইতেছি।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক॥ দ্বিতীয় পর্ব