You dont have javascript enabled! Please enable it! 1965.08.20 | আওয়ামী লীগের ভূমিকায় গাত্রদাহের কারণ কি? | দৈনিক ইত্তেফাক - সংগ্রামের নোটবুক

দৈনিক ইত্তেফাক
২০শে আগষ্ট ১৯৬৫

আওয়ামী লীগের ভূমিকায় গাত্রদাহের কারণ কি?

(ষ্টাফ রিপাের্টার)
ঢাকায় জাতীয় প্রেস ট্রাষ্টের একটি ইংরাজি দৈনিক (যাহার সংস্করণ একযােগে করাচী হইতেও প্রকাশিত হয়) বর্তমান পররাষ্ট্র নীতি সম্পর্কে আওয়ামী লীগের ভূমিকাকে জাতীয় স্বার্থবিরােধী বলিয়া আখ্যায়িত করিয়াছে। প্রেস ট্রাষ্টের উক্ত পত্রিকাটির করাচীস্থ সংবাদদাতা আওয়ামী লীগের পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কিত ভূমিকায় করাচীতে ব্যাপক অসন্তোষ আবিষ্কার করিয়াছেন। এবং সেই আবিষ্কার ঢাকা সংস্করণে ফলাও করিয়া প্রচার করা হইয়াছে। পররাষ্ট্রনীতির আসল রূপ ব্যক্ত করা প্রসঙ্গে গত মাসের শেষদিকে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান। দেশবাসীকে দেশের সত্যিকারের সমস্যা হইতে বিক্ষিপ্ত চিত্ত না হওয়ার জন্য যে আহ্বান জানান সেই আহ্বানই প্রেস ট্রাষ্টের কাগজটির গাত্রদাহের কারণ হইয়া দাঁড়াইয়াছে বলিয়া রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের নিশ্চিত ধারণা।
উল্লেখযােগ্য যে, শেখ মুজিবর রহমান তাহার বিবৃতিতে বর্তমান পররাষ্ট্রনীতিকে জনসাধারণের দৃষ্টি দেশের মূল সমস্যা হইতে বিক্ষিপ্ত করার একটি হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হইতেছে বলিয়া অভিযােগ করেন। তিনি অভিযােগ করেন যে, বর্তমান পররাষ্ট্রনীতিতে একটি ‘ভূয়া বামপন্থী নমুনার রাংতা জড়ানাে হইয়াছে এবং ক্ষমতাসীন দল প্রগতিবাদী পররাষ্ট্রনীতির অনুসারী বলিয়া প্রচার করিয়া তাহাদের অনুকূলে জনমত গড়িয়া তােলার প্রয়াস পাইতেছেন। শেখ মুজিব পরিস্থিতির বিশ্লেষণ দান করিয়া দেশবাসীকে অন্তঃসারশূন্য বর্তমান পররাষ্ট্রনীতি এবং ইহার মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে দেশবাসীকে সতর্ক করাইয়া দেন। তিনি স্মরণ করাইয়া দেন। যে, আজ পররাষ্ট্রনীতির দোহাই দিয়া যখন এক বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টির সর্বাত্মক প্রয়াস করা হইতেছে তখন দেশের আসল সমস্যা সম্পর্কে দেশবাসীকে আরও হুঁশিয়ার থাকিতে হইবে। দেশের আসল সমস্যা যথা (১) পূর্ণ ও নিয়ন্ত্রণমুক্ত গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, (২) সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন, (৩) পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা, (৪) লাহাের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন কায়েম, (৫) জাতীয় জীবনের সকল পর্যায়ে (দেশরক্ষা সমেত) বৈষম্য দূরীকরণ ইত্যাদি।
রাজনৈতিক মহল বলেন, এই ধরনের দাবী-দাওয়া আঞ্চলিক বা অভিনব কিছু নয়। প্রকৃত প্রস্তাবে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর হইতে আওয়ামী লীগ তথা সমগ্র দেশবাসী এইসব দাবী-দাওয়া আদায়ের জন্য অবিরাম সংগ্রাম করিয়া আসিতেছেন।
প্রেস ট্রাষ্টের কাগজে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যে প্রচারণা শুরু করা। হইয়াছে তাহার পশ্চাতে কোন গূঢ় রহস্য বা তাৎপর্য আছে বলিয়া পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক মহলের বিশ্বাস। তাঁহারা জিজ্ঞাসা করেন, অতঃপর কি? তবে কি অদূর ভবিষ্যতে পররাষ্ট্র নীতির প্রগতিবাদী ও বামপন্থী ভূয়া খােলস খুলিয়া পড়িবার উপক্রম হইয়াছে?
দলবিশেষের প্রতি আক্রমণ চালাইয়া ও বিদ্বেষ ছড়াইবার মধ্যদিয়াই কি তবে ক্ষমতাসীন দল ভােল পাল্টাইবার পালা সাঙ্গ করিতে চান? ক্ষমতাসীন দল কি আজ অস্বীকার করিতে পারেন যে, কনসর্টিয়ামের বৈঠক আহুত হইয়াছে এবং মার্কিন সাহায্য আগতপ্রায়?
ক্ষমতাসীন দল কি অস্বীকার করিতে পারেন যে, তাঁহারা দেশে অর্থপিপাসুদের সীমাহীন অর্থ তৃষ্ণার কাছে আত্মসমর্পণ করেন নাই?
উক্ত মহল বলেন, ১৯৫৮ সালের পর হইতে অদ্যাবধি রাষ্ট্রীয় কোন ব্যাপারে দেশবাসীর উপরে আস্থা স্থাপন করা হয় নাই। একটি স্বাধীন জাতির মৌলিক সত্তার প্রতি ক্ষমতাসীন দল কোনদিন শ্রদ্ধাশীল হয় নাই। তাহারা দেশবাসীকে ‘অক্ষম’ ও ‘অপাংক্তেয়’ হিসাবেই বিবেচনা করিয়াছেন। দেশবাসীকে তাঁহারা ভােটের অযােগ্য ভাবিয়াছেন। দেশবাসীকে সুপরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রীয় জীবন হইতে বহুদূরে সরাইয়া দেওয়া হইয়াছে। এই ‘নিগৃহীত’, ‘অক্ষম’ ও ‘অপাংক্তেয় দেশবাসীর কাছে ক্ষমতাসীন দল তথাকথিত বামপন্থী ও প্রগতিবাদী পররাষ্ট্রনীতির সমর্থন চাহিয়াছেন। দেশবাসী ক্ষমতাসীন দলের এই যাঞ্চাকে ‘ভাগ্যের নির্মম পরিহাস’ ও প্রহসন ছাড়া আর কিছুই মনে করিতে পারেন না।
রাজনৈতিক মহল বলেন, পাকিস্তান সৃষ্টির পর হইতে (একমাত্র জনাব শহীদ সােহরাওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় বাদে) পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য দাবী-দাওয়া ন্যক্করজনকভাবে অবহেলিত হইয়াছে। শুধু তাহাই নয়, এইসব দাবী-দাওয়াকে জাতীয় স্বার্থবিরােধী এবং ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ বলিয়া অভিহিত করা হইয়াছে। আজও যখন আওয়ামী লীগ তথা দেশবাসী পূর্ব পাকিস্তানকে দেশরক্ষার ব্যাপারে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অস্ত্র নির্মাণ কারখানা এবং সামরিক একাডেমীর দাবী উত্থাপন করে তার মধ্যেও কায়েমী স্বার্থবাদী মহল জাতীয় স্বার্থবিরােধী কার্যকলাপের গন্ধ আবিষ্কার করে। কে না জানে যে, পূর্ব পাকিস্তান ভারতের বাদামী সাম্রাজ্যবাদের মুখে নিরুপায় ও অসহায়? পাকিস্তানের যে অংশে দেশের শতকরা ৫৬ জন অধিবাসী বাস করে সে অঞ্চলের নিরাপত্তা বিধানের দাবীতে জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্য শাহ আজিজুর রহমান। পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র নির্মাণ কারখানা ও সামরিক একাডেমী প্রতিষ্ঠার দাবী তােলেন। এই দাবীর বাস্তবায়নের প্রয়ােজন এইজন্য যে, যুদ্ধের সময় পশ্চিম পাকিস্তান হইতে ‘টেলিগ্রাফ করিয়া সৈন্য বা সমর-সম্ভার পূর্ব পাকিস্তানে আনা সম্ভব নয় (জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্য জনাব কামরুজ্জামানের ভাষায়)। দাবীটি ক্ষমতাসীন দল প্রত্যাখ্যান করেন।
উক্ত মহল আরও বলেন, এহেন অবস্থায় দেশবাসী আজ সত্যই হতবুদ্ধি হইয়া পড়িয়াছে দেশবাসী আজ বুঝিতে পারিতেছে না কোনটা জাতীয় স্বার্থবিরােধী আর কোনটা নয়। দেশের নিরাপত্তা বিধান করিতে চাওয়াই কি তবে জাতীয় স্বার্থবিরােধী কাজ?
পরিশেষে উক্ত মহল বলেন, কায়েমী স্বার্থবাদের মুখপত্রগুলির ভূমিকাও দেশবাসীর কাছে সুবিদিত। তাই ইহাদের প্রচারণায় দেশবাসীর বিভ্রান্ত হইবার আশঙ্কা নাই। এই মুখপত্রগুলিই বছরের পর বছর দেশবাসীর-বিশেষ করিয়া পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য দাবী-দাওয়ার বিরােধিতা করিয়াছে। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রামের সময়, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক বিজয়ের পর এবং আরও বহুক্ষেত্রে কায়েমী স্বার্থবাদের মুখপত্র এইসব সংবাদপত্রের ন্যক্করজনক ভূমিকা নগ্নভাবে দেশবাসীর কাছে ধরা পড়ে। ইহাদের উদ্দেশ্য দেশবাসীকে অধিকার-বঞ্চিত করিয়া পঙ্গু করিয়া রাখা।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক॥ দ্বিতীয় পর্ব