আজাদ
১৬ই অক্টোবর ১৯৬৪
চিরদিন মানুষকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখা যায় না ?
মিস জিন্নার সতর্কবাণী-
“আমার লাঠি নাই, তবে সগ্রামী জনতার গর্জনই আমার হাতিয়ার”
(ষ্টাফ রিপাের্টার)
মিস ফাতেমা জিন্নাহ গতকল্য বৃহস্পতিবার এখানে আগমনের পর ঢাকার রাজনৈতিক জীবনের এক নতুন ইতিহাসের সূচনা হইয়াছে। এই রাজধানীর অতীতের সমস্ত রাজনৈতিক গৌরব যেন ম্লান হইয়া পড়িয়াছে। নতুন আশার আলােতে উদ্ভাসিত লক্ষ লক্ষ বাকরুদ্ধ নাগরিকের অসাধারণ উচ্ছাস ও উদ্দীপনা এই নয়া ইতিহাসের রচয়িতা।
এইখানে আজ পুরাতন ঐতিহ্যের ইতিহাস থামিয়া গেল। আন্দোলনের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হইল। গতকল্য সমগ্র রাজধানীর সকল মানুষই যেন মাদারে মিল্লাত মিস ফাতেমা জিন্নাহর বক্তৃতা শুনিবার জন্য পল্টনের সর্বকালের সর্ববৃহৎ জনসভায় উপস্থিত হইয়াছিলেন।
ঢাকার ইতিহাসে এমন বৃহৎ রাজনৈতিক জনসভার নজীর আর নাই।
বৈচিত্র্যময় জনজীবনের সকল দিকই ঐদিন বন্ধ ছিল। খােলা ছিল শুধু উন্মুক্ত পল্টন।
সম্মিলিত বিরােধী দলের মনােনীত প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী মােহতারেমা ফাতেমা জিন্না পল্টনের লক্ষ লক্ষ শ্রোতার শ্লোগান ও করতালির মধ্যে দৃপ্তকণ্ঠে ঘােষণা করেন যে, জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা ও অধিকার পুনরুদ্ধারের সময় এখন আসিয়াছে। মানুষের অত্যাচার সহ্য করার সীমা রহিয়াছে। চিরকালের জন্য জনসাধারণকে পদানত করিয়া রাখার প্রমাণ ইতিহাসে নাই। একদিন না একদিন তাহাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করিতে হয় এবং জনগণই হয় রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী।
এই প্রথমবার পল্টনের রাজনৈতিক জনসভায় এত অধিক সংখ্যক মহিলা ও ছাত্রী যােগদান করিয়াছেন।
সম্মিলিত বিরােধী দল কর্তৃক আয়ােজিত এই ঐতিহাসিক সভায় সভাপতিত্ব করেন মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগিশ। বক্তৃতা মঞ্চের উপর মিস জিন্নার পাশে লেঃ জেনারেল আজম খান, শেখ মুজিবর রহমান, জনাব মাহমুদুল হক ওসমানী, মৌলবী ফরিদ আহমদ, মালিক গােলাম জীলানী, বাকী বেলুচ, আজাদ কাশ্মীরের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জনাব কে, এইচ, খুরশিদ, হাজী দানেশ, অধ্যাপক গােলাম আজম, জনাব শফিকুল ইসলাম, জনাব আবুল কাসেম, শাহ আজিজুর রহমান, মহিউদ্দিন আহমদ, প্রাক্তন উজির জহিরুদ্দিন, বেগম রােকেয়া আনােয়ার প্রমুখ উপবিষ্ট ছিলেন।
জনসভা শুরু হওয়ার প্রায় চল্লিশ মিনিট পরে মিস ফাতেমা জিন্নাহ জনসভায় উপস্থিত হইলে অযুত কণ্ঠে মাদারে মিল্লাত জিন্দাবাদ শ্লোগানের ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত হইয়া উঠে। এই সময় এবং মাদারে মিল্লাতের বক্তৃতাকালে উল্লসিত জনতা এতটা চঞ্চল হইয়া উঠে যে প্রায় পনের মিনিটকাল কঠোর পরিশ্রমের পর স্বেচ্ছাসেবকগণ শ্রোতাদের শান্ত করেন।
সভারম্ভের সময় জেনারেল আজম খান মঞ্চে আরােহণকালে আগ্রহশীল শ্রোতৃবর্গ তাঁহাকে বিপুলভাবে সম্বৰ্ধনা জ্ঞাপন করেন।
গতকল্যকার জনসভায় বক্তৃতার মাধ্যমে মিস ফাতেমা জিন্নাহ পূৰ্ব্ব পাকিস্তানে তাহার প্রথম নির্বাচনী প্রচার আরম্ভ করেন। লক্ষ লক্ষ শ্রোতার উৎসাহ ও উদ্দীপনা লক্ষ্য করিয়া তিনি বক্তৃতার শেষের দিকে বলেন, জনাব আইয়ুবের পক্ষে লাঠি থাকিতে পারে, সেই হাতিয়ারের কোন আওয়াজ নাই, কিন্তু আমার হাতেও লাঠি আছে, তাহা হইতেছে জনগণের ঐক্যবদ্ধ গর্জন অত্যাচরের বিরুদ্ধে হুঙ্কার। সভায় সর্বক্ষণ জিন্দাবাদ ধ্বনি ও গণতন্ত্রের পক্ষে মুহুর্মুহুঃ শ্লোগান জনগণের ঐক্যবদ্ধ গর্জনেরই যেন প্রতিধ্বনি করিতেছিল।
বিরাট পল্টন ময়দানে তিলধারণের বিন্দুমাত্র স্থান ছিল না। সভায় অংশ গ্রহণকারীদের চাপ বিকাল পাঁচটার দিকে এত বৃদ্ধি পাইতে থাকে যে, বহু সহস্র আগ্রহী শ্রোতাকে দাড়াইবার স্থানাভাবে বিফল মনােরথ হইয়া গৃহে ফিরিয়া যাইতে হয়। জিন্নাহ এভেন্যু, মতিঝিল এলাকার সমস্ত ইমারত ও ষ্টেডিয়ামের উপর উঠিয়া সহস্র সহস্র লােক জনসভার বক্তৃতা শ্রবণের চেষ্টা করে। নিকটবর্তী বহু বৃক্ষে ও মসজিদের মিনারের উপরও দর্শকদের দেখা যায়।
এই নিৰ্বাচন যে দুই ব্যক্তি বিশেষের মধ্যে প্রতিযােগিতা নহে, বরঞ্চ দুইটি দৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যে উহা আমাদের বিরােধীদল হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিয়াছেন দেখিয়া আমি খুশী হইয়াছি।
একদিকে একনায়কত্ব এবং অপরদিকে আজাদী এবং মানবিক মর্যাদা।
একদিকে একজন ব্যক্তি বিশেষের হস্তে আপনাদের ভবিষ্যৎ তুলিয়া দিতে হইবে, অপরদিকে আপনারাই নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের অধিকারী হইবেন। এই দুইটি ব্যবস্থার মধ্যে আপনাদের যে কোন একটি বাছিয়া লইতে হইবে।
সংবাদপত্রে আমি পাঠ করিয়াছি যে, জনাব মােহাম্মদ আইয়ুব খান তাঁহার নিৰ্বাচনী প্রচারণা শুরু করিয়াছেন। দুইদিন পূৰ্ব্বে পেশােয়ারে উহা শুরু হইয়াছে।
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব