You dont have javascript enabled! Please enable it! 1964.10.16 | বলিষ্ঠ কণ্ঠ মাদারে মিল্লাত কর্তৃক আগামী নির্বাচনে দেশবাসীর কর্তব্য ব্যাখ্যা | ইত্তেফাক - সংগ্রামের নোটবুক

ইত্তেফাক
১৬ই অক্টোবর ১৯৬৪

উত্তাল-উদ্দাম বিশাল জনসমুদ্রে জনগণের জয়যাত্রার শুভসঙ্কেত
দ্রুত অধিকার ছিনাইয়া আনার জন্য নেতৃবৃন্দের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলাইয়া
অযুত মানুষের বজ্র শপথ
বলিষ্ঠ কণ্ঠ মাদারে মিল্লাত কর্তৃক আগামী নির্বাচনে দেশবাসীর কর্তব্য ব্যাখ্যা

(ষ্টাফ রিপাের্টার)
আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুবের প্রতিদ্বন্দ্বী সম্মিলিত বিরােধীদলীয় প্রার্থী মােহতারেমা মিস ফাতেমা জিন্নার পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচনী সফরের উদ্বোধনী পর্যায়ে গতকল্য (বৃহস্পতিবার) ঢাকার বিরাট বিস্তীর্ণ আউটার ষ্টেডিয়ামে তিল ধারণের স্থান না থাকায় পশ্চাদবর্তী সাবেক পল্টন ময়দান, ষ্টেডিয়ামের দ্বিতল ত্রিতল ও সম্মুখবর্তী জিন্না এভিন্যু জুড়িয়া যে অবিশ্বাস্য জনসমুদ্রের সৃষ্টি হয়, একদিকে তাহা যেমন রাজধানীর ইতিহাসে নজীরবিহীন, অন্যদিকে তেম্নি ভাষায় তাহার বর্ণনা দেওয়াও সম্পূর্ণ অসম্ভব।
পূর্ব হইতেই অবস্থা আঁচ করিতে পারিয়া সভার উদ্যোক্তাগণ এই দিনের মঞ্চটি আউটার ষ্টেডিয়ামের পূর্ব উত্তর কোণ ঘেসিয়া নির্মাণ করিলেও জনতার চাপ এমনই প্রচণ্ড পর্যায়ে পৌঁছে যে, এক পর্যায়ে সাংবাদিকদের জন্য সুসংরক্ষিত বেষ্টনীটিও ভাঙ্গিয়া পড়ে। এবং আধা বিধ্বস্ত টেবিল চেয়ারের স্কুপের মধ্যে দাঁড়াইয়া সাংবাদিকগণ সভার বিবরণ লিপিবদ্ধ করার কাজ ছাড়িয়া ‘আত্মরক্ষার কাজে ব্যাপৃত হইতে বাধ্য হন। দুই একজন সাংবাদিক কোনক্রমে মঞ্চের গােড়ায় গিয়া নেতৃবৃন্দের বক্তৃতার নােট নেন।
মাদার মিল্লাতের উপস্থিতির পূর্বেই সম্মিলিত বিরােধী দলের বিভিন্ন অঙ্গদলের পক্ষ হইতে নেতৃবৃন্দ যখন তেজোদ্দীপ্ত ভাষায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে বর্তমান সরকারের কথা ও কাজের সমালােচনা করিয়া আগামী দিনের কর্তব্য ব্যাখ্যা করিতে থাকেন, সমগ্র জনসমুদ্র তখন একাত্ম হইয়া মুহুর্মুহু হস্তোত্তলনপূর্বক গম্ভীর গর্জনে প্রতিটি প্রশ্নে তাঁহাদের সুস্পষ্ট রায় জানাইয়া দিতে থাকে। এক পর্যায়ে সম্মিলিত বিরােধী দলের অন্যতম অঙ্গদল আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক শাখার সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান যেকোন ত্যাগ স্বীকারের প্রশ্নে উপস্থিত জনসমুদ্রের মতামত যাচাই করিয়া উধাকাশে হস্তত্তোলিত জনতার দিকে মােহতারেমা মিস ফাতেমা জিন্নার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া তুমুল করতালির মধ্যে মাদারে মিল্লাতকে পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের পক্ষ হইতে আশ্বাস দিয়া বলেন, “ঐ দেখুন মাদারে মিল্লাত। বাংলার বিপ্লবী ছেলেরা আপনার যে কোন ত্যাগ স্বীকারে হাসিমুখে জেল-জুলুম বরণ করিতে, গােলাগুলীর সামনে বুক পাতিয়া দিতে প্রস্তুত। জনসভায় জাতীয় পরিষদ সদস্য জনাব ফরিদ আহমদ (নেজামে ইসলাম) ডেপুটি স্পীকার জনাব আবুল কাসেম (মুসলিম লীগ), অধ্যাপক গােলাম আজম (জামাতে ইসলামী), শেখ মুজিবর রহমান (আওয়ামী লীগ), জনাব মাহমুদুল হক ওসমানী (ন্যাপ), সাবেক গভর্নর জেনারেল আজম খান প্রমুখের তেজোদ্দীপ্ত বক্তৃতায় অভিভূত হইয়া সভার প্রধান বক্তা মাদারে মিল্লাত তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে বক্তৃতা করিতে উঠেন।
মাদারে মিল্লাত মিস ফাতেমা জিন্না আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন প্রসঙ্গে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুবের সাম্প্রতিক মন্তব্যাবলীর চুলচেরা সমালােচনা করিয়া আগামী নির্বাচনের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করিয়া দৃপ্তকণ্ঠে ঘােষণা করেন ? এবারকার নির্বাচন ব্যক্তি বনাম ব্যক্তির নির্বাচন নয়। এবারকার নির্বাচন দুইটী স্বতন্ত্র জীবনধারার মধ্যে একটী বাছাইয়ের নির্বাচন। এই দুইটি জীবনধারায় একদিকে ডিক্টেটরশীপ ও অন্যদিকে জনগণের স্বাধীনতা ও মানব মর্যাদা, একদিকে আপনাদের ভাগ্য ব্যক্তিবিশেষের পকেটে, অন্যদিকে আপনাদের ভাগ্য আপনাদেরই নিজেদের হাতে। এই দুই বিকল্পের মধ্যে একটী আপনাদিগকে বাছিয়া লইতে হইবে।”
তুমুল করতালি ও জিন্দাবাদ ধ্বনির মধ্যে মাদারে মিল্লাত ঘােষণা করেনঃ ‘প্রেসিডেন্ট আইয়ুব ভাবিয়াছেন, তাঁহার হাতে লাঠি আছে, কার সাধ্য এই লাঠির সামনে মাথা তােলে! আমি বলি, আমাদের হাতেও লাঠি আছে, তবে সেই লাঠির আস্ফালন নাই। সে লাঠি দেশবাসী আপামর জনসাধারণের ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ আর আল্লার অপরিসীম মেহেরবাণী।
মিস্ জিন্নার বক্তৃতার পর তাঁহার লিখিত বক্তৃতার বাংলা তর্জমা করেন আওয়ামী লীগ নেতা শাহ আজিজুর রহমান। মিস জিন্নার বক্তৃতার পর সভার সমাপ্তি ঘােষণার আগে সম্মিলিত বিরােধী দলের পক্ষে এই দিনের জনসভার সভাপতি, প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ সম্পাদক, মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ নাতিদীর্ঘ বক্তৃতার পর জুলুমের হাত হইতে পাকিস্তানের ১০ কোটি মানুষের মুক্তির কামনা করিয়া মােনাজাত করেন।
এই দিন মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট বেষ্টনীর মধ্যে বহু মহিলা ও শিশুকে অধীর আগ্রহে নেতৃবৃন্দের বক্তৃতা শুনিতে দেখা যায়। জনৈক বিদেশী সাংবাদিকের মতে গতকল্যকার জনসভায় কেবল আউটার স্টেডিয়ামেই তিন লক্ষের মত লােক-সমাবেশ ছিল।

শেখ মুজিবর রহমান
বিরাট জনতার মুহুর্মুহু করতালির ধ্বনির মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান পূর্ব পাকিস্তানীদের পক্ষ হইতে মাদারে মিল্লাতকে আশ্বাস দিয়া বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানীরা তাহাদের সংগ্রামী ঐতিহ্যের ঝাণ্ডা সমুন্নত রাখিয়া স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে মাদারে মিল্লাতকে জয়যুক্ত করিবে। বৃদ্ধবয়সে মাদারে মিল্লাত নির্বাচনে অবতীর্ণ হইয়া আজ জনতার দাবী লইয়া যে দুর্বার সংগ্রাম করিতেছেন, তজ্জন্য শেখ মুজিবর পূর্ব পাকিস্তানীদের পক্ষ হইতে মাদারে মিল্লাতকে আন্তরিক মােবারকবাদ জ্ঞাপন করেন। পল্টনের জনসমুদ্রকে উদ্দেশ করিয়া আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, দেশময় আজ যে সগ্রাম শুরু হইয়াছে, সেই সংগ্রাম অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম, মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের সগ্রাম, জবরদখলকারীদের বিরুদ্ধে সত্যিকারের মালিকদের অধিকারের সংগ্রাম, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের সংগ্রাম।
তিনি ঘােষণা করেন যে, বর্তমান ক্ষমতাসীনরা যদি নিয়মতান্ত্রিকভাবেও দেশবাসীর হাতে রাষ্ট্রীয় অধিকার ছাড়িয়া না দেয়, তবে জোর করিয়া দেশবাসী ক্ষমতা দখল করিবে এবং দেশে পূর্ণ গণতন্ত্র কায়েম করিবে।
শ্ৰোতৃমণ্ডলীর তুমুল করতালি ও জিন্দাবাদ ধ্বনির মধ্যে শেখ মুজিব ঘােষণা করেন যে, ক্ষমতাসীনরা যদি আজও দেশবাসীর হৃত অধিকার ফিরাইয়া দিতে অস্বীকার করে এবং যদি নির্বাচন বানচাল করার অভিসন্ধি লইয়া সরকারী কর্তারা আজ কোনরূপ ফন্দি আঁটেন, তবে আজিকার দুর্জয় ও দুর্বার গণআন্দোলনের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসাবে ক্ষমতাসীনদের দেশত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইতে হইবে। তিনি বলেন যে, বর্তমান সরকারী কর্তারা পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাস জানেন না এবং ইতিহাস জানেন না বলিয়াই তাহারা আজও সরকারী অর্থপুষ্ট দালালদের কথা বিশ্বাস করেন। তারা জানেন না যে, ‘বাঙালের মা’র দুনিয়ার বার। এই বাংলা ১৯৪৬ সালে পাকিস্তান ইস্যুর নির্বাচনে ইতিহাস রচনা করিয়াছে, ১৯৫৪ সালে সরকারী দলকে পরাজিত করিয়া ইতিহাস রচনা করিয়াছে আর এইবারও স্বৈরাচারী শাসকদের খতম করিয়া দিয়া নূতন ইতিহাস রচনা করিবে।
এই পর্যায়ে শেখ মুজিব বিরাট জনসমুদ্রকে বলেন, আপনারা হাত তুলিয়া ওয়াদা করুন যে, মাদারে মিল্লাতের প্রতি আপনাদের আস্থা আছে। মুহূর্ত মধ্যে লক্ষ লক্ষ উত্তোলিত হস্ত ও জিন্দাবাদ ধ্বনি ঘােষণা করে যে, মাদারে মিল্লাতের প্রতি তাহাদের অটুট আস্থা আছে। শেখ মুজিব তখন জিজ্ঞাসা করেন, সরকারী প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর প্রতি কোন আস্থা আপনাদের আছে? লক্ষ কণ্ঠে আওয়াজ উঠিলঃ নাই নাই নাই।
শেখ মুজিব অতঃপর সরকারকে হুঁশিয়ার করিয়া দিয়া বলেন যে, আসন্ন। পরাজয়ের নিশ্চিত আশঙ্কার মুখে যদি সরকার সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনা না করেন তবে লক্ষ লক্ষ সংগ্রামী জনসাধারণ দুর্বার সংগ্রামে ঝাপাইয়া পড়িবে, সরকারী কারাগার প্লাবিত করিয়া ফেলিবে, একের পর এক ফাঁসিকাষ্ঠে গলা বাড়াইয়া দিতে আগাইয়া যাইবে। ভাইরা আমার জাতির সামনে যদি আরও দুর্দিন ঘনাইয়া আসে তবে কি আপনারা জেল খাটিতে প্রস্তুত আছেন? লক্ষ কণ্ঠে আওয়াজ উঠিল, আমরা জেল খাটিতে প্রস্তুত। শেখ মুজিব এই পর্যায়ে মাদারে মিল্লাতের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া বলেন, দেখুন মাদারে মিল্লাত, বাংলার অগণিত জনতা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে কারাবরণ করিতে প্রস্তুত। তিনি দৃপ্ত কণ্ঠে ঘােষণা করেন, প্রয়ােজন যদি হয় তবে এই বাংলার বাঙ্গালীরা বুক পাতিয়া স্বৈরাচারী সরকারের গুলী বরণ করিয়া লইবে, পথে পথে জীবন দান করিবে তবু দেশে তাহারা গণতন্ত্র কায়েম করিবেই করিবে।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব