You dont have javascript enabled! Please enable it! 1964.07.06 | দশ কোটি মানুষের বাঁচা-মরার এ যুদ্ধে জয় আমাদের অবশ্যম্ভাবী- নারায়ণগঞ্জের কর্মী সম্মেলনে শেখ মুজিবের ঘােষণা | ইত্তেফাক - সংগ্রামের নোটবুক

ইত্তেফাক
৬ই জুলাই ১৯৬৪

সমগ্র বাংলা যদি বিশ্বাসঘাতকতা না করে
দশ কোটি মানুষের বাঁচা-মরার এ যুদ্ধে জয় আমাদের অবশ্যম্ভাবী
নারায়ণগঞ্জের কর্মী সম্মেলনে শেখ মুজিবের ঘােষণা
নেতৃবৃন্দ কর্তৃক দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণ

(ষ্টাফ রিপাের্টার)
‘কে বলে আওয়ামী লীগের নেতা নাই? গণতন্ত্রের অগ্নিসাধক সগ্রামী পুরুষ হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীই আওয়ামী লীগের নেতা। মৃত্যু তাহাকে ছিনাইয়া নিলেও তাঁর রাখিয়া যাওয়া নীতিই আমাদের নেতৃত্ব দিবে। পাকিস্তানের বিচক্ষণ আইনজীবী জনাব ব্রোহীর কণ্ঠে কণ্ঠ মিলাইয়া আমরা বলিব, গাের হইতেই আমাদের নেতা আমাদের নেতৃত্ব দিবেন।’- গতকল্য (রবিবার) নারায়ণগঞ্জের রহমতুল্লা ইনষ্টিটিউটে নরসিংদীর প্রধান আওয়ামী লীগ নেতা জনাব আফসারুদ্দীন সরকারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি ও মহকুমা আওয়ামী লীগ কর্মী সম্মেলনে বক্তৃতা প্রসংগে আওয়ামী লীগ সম্পাদক জনাব শেখ মুজিবর রহমান তুমুল করতালির মধ্যে উপরােক্ত ঘােষণা করেন।
শেখ মুজিবর রহমান জিন্দাবাদ ধ্বনির মধ্যে ঘােষণা করেন যে, আওয়ামী লীগ আজ যে ‘যুদ্ধে’ নামিয়াছে এ ‘যুদ্ধ’ ক্ষমতায় যাওয়ার ‘যুদ্ধ’ নয়। এ ‘যুদ্ধ পাকিস্তানের দশকোটি মানুষের বাঁচা মরার যুদ্ধ। এ যুদ্ধ’ ত্যাগের যুদ্ধ এ যুদ্ধ আমাদের স্বায়ত্তশাসনের ‘যুদ্ধ, অর্থনৈতিক স্বাধীনতার যুদ্ধ, বঞ্চনার অবসান ঘটানাের ‘যুদ্ধ’, এ ‘যুদ্ধ’ স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষ হিসাবে আবার আমরা বিশ্বসমাজে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইতে পারিব কি না তারই ‘যুদ্ধ।
‘ভাগ্যহত’ বাংলার মীরজাফরদের সম্পর্কে হুঁশিয়ার করিয়া দিয়া কর্মী বাহিনীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাইয়া শেখ সাহেব বলেন, স্মরণ রাখিবেন, লিয়াকত সরকার অপেক্ষা আইয়ুব সরকার শক্তিশালী নয়। লিয়াকত সরকারের পিছনে সামরিক বাহিনী ছাড়াও জনগণেরও সমর্থন ছিল। কিন্তু আইয়ুব সরকারের পিছনে একটির সমর্থন আছে, অন্যটির নাই। থাকার মধ্যে ছিল ১০ কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র ৮০ হাজারের সমর্থন, তাহাও আজ আর নাই। আগামী নির্বাচনে যাহাতে জনগণের প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হন, তজ্জন্য এই মুহুর্তে আপনারা ছুটিয়া যান গ্রামে গ্রামে। মরহুম নেতার শেষ আহ্বানে সাড়া দিয়া গ্রামে গ্রামে ইউনিয়নে ইউনিয়নে গণতন্ত্রের দুর্ভেদ্য দুর্গ গড়ে তুলুন, বেশী নয়, ইউনিয়নে মাত্র ১০ জন করিয়া নিঃস্বার্থ কর্মী আমি চাই। ইনশাআল্লাহ কর্মী বাহিনীর সমবেত কর্মোদ্যমকে সম্বল করিয়া একদিন আমরা যেমন প্রবল প্রতাপান্বিত মুসলিম লীগ সরকারের সমাধি রচনা করিয়াছিলাম, তেমনি করিয়াই এবারও ইনশাআল্লাহ আমরা ‘শিকড়হীন আইয়ুব সরকারের ‘অত্যাচারের প্রতিশােধ লইব। শেখ সাহেব তাঁর ৪৫ মিনিটব্যাপী বক্তৃতায় বাংলার প্রতি আইয়ুব সরকারের দরদের’ অন্তঃসারশূন্যতা ব্যাখ্যা করেন। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসনকে ‘বিপ্লব’ বলিয়া অভিহিত করার তীব্র প্রতিবাদ করিয়া তিনি বলেন যে, প্রকৃত প্রস্তাবে উহার পশ্চাতে ছিল এক সুগভীর চক্রান্ত। সে চক্রান্ত আর কিছু নহে, পূর্ব পাকিস্তানের টুটি টিপিয়া শােষণের পথ উন্মুক্ত করাই ছিল সে চক্রান্তের মূল কথা। বিষয়টির বিস্তারিত ব্যাখ্যা দান প্রসঙ্গে শেখ মুজিবর বলেন, আওয়ামী লীগ বিরােধী দল হিসাবেই তখন সগ্রাম করিয়া আসিতেছিল। ক্ষমতায় যাওয়ার কথা আওয়ামী লীগ তখন চিন্তাও করে নাই। এতদসত্বেও আওয়ামী লীগ নেতার নীতিনিষ্ঠা ও অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তাই গণপরিষদে মাত্র ১২ জন। সদস্যের সমর্থনপুষ্ট হইলেও জনাব সােহরাওয়ার্দীকে মন্ত্রিসভা গঠনের আহ্বান জানাইতে হয়। ক্ষমতাসীন হওয়ার পরক্ষণেই সােহরাওয়ার্দী সরকার যখন অবহেলিত পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি কিছুটা সুবিচার করার প্রয়াস পান তখনই কায়েমী স্বার্থীমহলে সৃষ্টি হয় আতঙ্ক। শুরু হয় প্যালেস ক্লিক্। প্রেসিডেন্ট ‘ইস্কেন্দার মির্জার অভিপ্রায়’ অনুসারে তিনি ক্ষমতা ত্যাগ করিয়া নামিয়া আসেন। তৎপর আওয়ামী লীগের সমর্থনপুষ্ট নুন-সরকার কর্তৃক যখন ১৯৫৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচনের ব্যবস্থা প্রায় শেষ করিয়া আনা হয়, তারই মাত্র ৪ মাস আগে ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে ‘দেশ রসাতলে যাওয়ার অজুহাত তুলিয়া অকস্মাৎ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব ক্ষমতা দখল করিয়া বসেন। সামান্য বুদ্ধি যাহার আছে, তাহার বুঝিবার কষ্ট হওয়ার কথা নয় যে, দেশ রসাতলে যাওয়া নয়। বরং ১৯৫৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে জনাব সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে দেশের শাসনভার আওয়ামী লীগের হাতে চলিয়া আসার ষােলআনা সম্ভাবনা থাকার কারণেই দেশের কায়েমী স্বার্থ মহলের যােগসাজশে ‘দেশ রসাতলে যাওয়ার অজুহাত তুলিয়া সেদিন সামরিক শাসন জারি করা হয়। এ প্রসঙ্গে শেখ মুজিব তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের দুঃখজনক ঘটনাটিকেও বিচ্ছিন্ন ঘটনা না বলিয়া দাবী করেন এবং বলেন যে, ডেপুটি স্পীকার জনাব শাহেদ আলী আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন। সুতরাং আওয়ামী লীগারদের পক্ষে তাঁহাকে হত্যা করার প্রশ্নই উঠিতে পারে না। তবু কেন তিনি নিহত হইলেন? কাহারা তাহাকে হত্যা করিল, এ হত্যার পিছনে তদানীন্তন প্যালেস ক্লিকই যে কাজ করে নাই, কে বলিবে?
শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের আসন্ন সগ্রামে ‘সকলকেই আমরা সঙ্গে লইতে রাজী’ বলিয়া মন্তব্য করিয়া বলেন, তবে কারাগারে যাইতে যাহারা প্রস্তুত নন, গরম পানিতে হাত দিতে যাহারা রাজী নন, চোগা চাপকান ছাড়িয়া মাঠে নামিতে যাহারা ইতস্ততঃ করেন, তাহাদিগকে অন্ততঃ বর্তমান পর্যায়ে সঙ্গে লইতে আমরা রাজী নহি। তাহাদের প্রতি অনুরােধ জানাইয়া তিনি বলেন, বিপদ-সংকুল এই সংগ্রামের দিনে তাহারা বিশ্রাম করুন। জেলজুলুম, অত্যাচার, নির্যাতনের ঝক্কি পােহাইয়া যদি আমরা সংগ্রামে জয়যুক্ত হইতে পারি, তখন আপনারা আসিয়া শরিক হইবেন, হাসি মুখে আমরা আপনাদের বরণ করিব।
কিন্তু বর্তমান পর্যায়ে শঙ্কিতমনা কেহ আসিয়া শরিক হইলে সগ্রাম আমাদের ব্যাহত হইতে পারে। তাই অনুরােধ, শঙ্কিতমনারা আপাততঃ বিশ্রাম করুন। উপসংহারে, তিনি ঘােষণা করেন, আমাদের নেতাকে যাহারা অপমান করিয়াছে, সমগ্র বাংলা যদি বিশ্বাসঘাতকতা না করে, তবে সে অপমানের প্রতিশােধ গ্রহণ হইতে কেহই আমাদের বিচ্যুত করিতে পারিবে না।’

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব