You dont have javascript enabled! Please enable it! 1964.04.11 | দমন নীতির পরিণাম সম্পর্কে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের কঠোর হুঁশিয়ারি | ইত্তেফাক - সংগ্রামের নোটবুক

ইত্তেফাক
১১ই এপ্রিল ১৯৬৪

বন্দর শহর চট্টগ্রামের ঐক্যবদ্ধ আওয়াজঃ
প্রত্যক্ষ নির্বাচনের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম অব্যাহত রাখিব
দমন নীতির পরিণাম সম্পর্কে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের কঠোর হুঁশিয়ারি

(ইত্তেফাকের ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি)
চট্টগ্রাম, ১০ই এপ্রিল- অদ্য স্থানীয় লালদীঘি ময়দানে কর্মচঞ্চল বন্দর-শহর চট্টগ্রামের কর্মচারী, ব্যবসায়ী, শ্রমিক, কৃষক প্রভৃতি সর্বশ্রেণীর লােকের এক বিপুল সমাবেশে প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে সর্বস্তরের জন্য প্রত্যক্ষ নির্বাচনের যে ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ সাগরের কূলে আশ্রিত পাহাড়পর্বতে ঘেরা চট্টগ্রামের আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে, তাহাতে পুনর্বার পূর্ব পাকিস্তানের নগরে-বন্দরে, পল্লীতে-প্রান্তরে হাটে-মাঠে বর্তমান গণবিরােধী সরকারের নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে আপামর দেশবাসীর ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদের বলিষ্ঠতায় এ কথাই প্রতীয়মান হয় যে, ভােটাধিকারের সার্বজনীন দাবী আদায়ে দেশের গােটা জনসাধারণ বদ্ধপরিকর। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের আহ্বানে লালদীঘি ময়দানে জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি জনাব মােজাফফর আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই বিরাট জনসভার প্রতিটি লােক ‘দাবীর হস্ত’ উত্তোলন করিয়া সরকারকে জানাইয়া দেয়, সার্বজনীন ভােটাধিকার তাহাদের দিতেই হইবে এবং এই ভােটাধিকার আদায়ের সংগ্রামে তাহারা সকল প্রকার জেল-জুলুম, অত্যাচার-উৎপীড়নের মােকাবিলা করার জন্য সর্বদাই প্রস্তুত।
শেখ মুজিবর রহমান
লালদীঘির ময়দানের বিরাট জনসমুদ্রকে লক্ষ্য করিয়া পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান বলেনঃ এদেশের সমাজব্যবস্থা ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে, অর্থনীতি পঙ্গু হইয়া পড়িয়াছে, মানুষের মুখের হাসি মিলাইয়া গিয়াছে, দেশের ঘরে ঘরে আজ উদ্বেগ আর শংকার আকুলতায় মানুষের জীবন দুর্বিষহ হইয়া পড়িয়াছে, পূর্ব বাংলার মাটিতে আজ মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করিয়া মহাকালের সর্বনাশ ডাকিয়া আনিয়া দেশকে ধ্বংসের মুখে ঠেলিয়া দেওয়া হইয়াছে। আজ দেশে অশান্তি-অন্যায়, অত্যাচার-নির্যাতন ও নিপীড়নে দেশের মানুষের ভাগ্যাকাশ এক মহা অশুভ মেঘে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিয়াছে। আর এই প্রাণান্তকর অবস্থার হাত হইতে দেশ ও দেশবাসীকে উদ্ধার করার জন্যই আওয়ামী লীগ সংগ্রামে অবতীর্ণ হইয়াছে।
শেখ মুজিবর বলেন যে, অতীতে মুসলিম লীগের শাসনামলেও দেশে এইরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হইয়াছিল এবং উহা হইতে দেশকে মুক্ত করার বলিষ্ঠ শপথ লইয়াই আওয়ামী লীগের জন্ম হইয়াছিল। তাই আজও আওয়ামী লীগ দেশ ও দেশবাসীকে এই প্রাণান্তকর পরিস্থিতির কবল হইতে রক্ষা করার জন্য অবিরাম সংগ্রাম চালাইয়া যাইবে। শেখ মুজিবর বলেন যে, সরকারের যে আইন দেশবাসীর মঙ্গল করে না, সে আইনের প্রতি দেশবাসীর শ্রদ্ধাও থাকিতে পারে না এবং প্রয়ােজনবােধে ভবিষ্যতে জনসাধারণ সেই ধরনের আইনের প্রতি সরাসরি অনাস্থা প্রকাশ করিতে পারে। আওয়ামী লীগ সম্পাদক দৃপ্ত কণ্ঠে ঘােষণা করেন যে, এই দেশের জনসাধারণ সংগ্রামের ইতিহাস জানে, সংগ্রামীদের ত্যাগের ইতিহাস জানে এবং তাহাদের কামিয়াবীর ইতিহাসও জানে- এই অভিজ্ঞতা প্রসূত জ্ঞানবর্তিকা হস্তে দেশবাসী যে সংগ্রাম শুরু করিয়াছে সেই দুর্বার সংগ্রাম দাবাইয়া দেওয়ার কোন শক্তি বিশ্বে নাই। প্রদেশব্যাপী দলননীতি ও গ্রেফতারের বিবরণ দান করিয়া তিনি বলেন যে, এই সকল নির্যাতন ও গ্রেফতারের পিছনে একটি গভীর ষড়যন্ত্র আছে এবং সেই ষড়যন্ত্র জনসাধারণকে উপলব্ধি করিতে হইবে। আঞ্চলিক বৈষম্যের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দান করিয়া রাজধানী স্থানান্তর সম্পর্কে শেখ মুজিবর বলেন যে, যে দেশে বন্যায়, ঝড়ে, তুফানে ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষ অসহায় শৃগাল-কুকুরের মত মরিয়া থাকে, সেই দেশে ব্যক্তিবিশেষের খেয়াল-খুশী চরিতার্থ করার জন্য ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নয়া রাজধানী নির্মাণ প্রচেষ্টাকে রােধ করা ছাড়া জনগণের কোন গত্যন্তর নাই। তিনি আরও বলেন যে, সরকার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবিচার ও অত্যাচার চালাইতেছে; উহা প্রতিরােধকল্পে যে দুর্বার আন্দোলন গড়িয়া উঠিবে; তাহাতে ইসলামাবাদ হইতে ঢাকায় রাজধানী আনয়ন করিতে বাধ্য হইবে।
তিনি বলেন যে, গত ১৬ বৎসর যাবৎ করাচীকে উন্নত করার জন্য যে অর্থ ব্যয় হইয়াছে, উহার শতকরা ৭৫ ভাগ পূর্ব পাকিস্তানের নিকট হইতে আদায় করা হইয়াছে এবং উক্ত অর্থ ব্যয়ে উন্নীত করাচী হইতে এখন বৎসরে ৬০ কোটি টাকা আয় হয়। অথচ উহা এখন পশ্চিম পাকিস্তানের দখলে দেওয়া হইয়াছে।
তাহাদের প্রতি কোনরূপ বিদ্বেষ নাই। যে সকল ব্যবসায়ী এদেশকে শােষণ করিয়া অর্থ আয় করিয়া লইয়া যায়, শেখ মুজিব তাহাদের প্রতি সতর্ক বাণী উচ্চারণ করেন। অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিষয়ে তদন্ত করার জন্য গঠিত কমিশনে রিপাের্ট প্রকাশের দাবী জানাইয়া শেখ মুজিবর বলেন যে, ওয়ার্ক প্রােগ্রামের টাকা কোথা হইতে আসে এবং উহার কত পরিমাণ টাকা পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় হয় উহাও প্রকাশ করিতে হইবে। এদেশের লােক সামরিক বাহিনীতে দক্ষ ভূমিকা গ্রহণে অপারগ বলিয়া যে অপবাদ দেওয়া হয়, উহার তীব্র প্রতিবাদ করিয়া তিনি বলেন যে, যে বাঙ্গালী বাঘ-ভাল্লুকের সহিত লড়াই করিয়া টিকিয়া আছে তাহাদের বিরুদ্ধে উক্ত অপবাদ মােটেই টিকে না। তিনি পূর্ব পাকিস্তানকে দেশরক্ষা ব্যবস্থায় স্বয়ং সম্পূর্ণ করার জন্য জোর দাবী জানান। তিনি বলেন যে, শাসনতন্ত্রে আগামী ২০ বৎসর পর্যন্ত কোন এক লেঃ জেনারেলকে দেশরক্ষা মন্ত্রী পদে নিয়ােগের ব্যবস্থা রাখা হইয়াছে। শাসনতন্ত্রের উক্ত ব্যবস্থার দ্বারা দেশরক্ষা মন্ত্রীপদ গ্রহণ হইতে পূর্ব পাকিস্তানীদের বঞ্চিত করা হইয়াছে।
আবেগ জড়িতকণ্ঠে শেখ মুজিবর বলেন যে, জনাব সােহরাওয়ার্দী বৈরুতের এক নির্জন হােটেলকক্ষে প্রাণত্যাগ করিয়াছেন। কিন্তু তার পবিত্র আত্মা এদেশের প্রতিটি কর্মী, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ নাগরিকের নিকট যান ও শুধু এই মিনতিই করেন যে, তােমরা এদেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করিও না, এদেশবাসীর দাবী আদায়ের জন্য তােমরা আত্মনিয়ােগ কর। জনাব সােহরাওয়ার্দীর বিদেহী আত্মার আকুল মিনতিতে সাড়া দিয়া তাঁহার আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য সংঘবদ্ধভাবে সগ্রাম করার জন্য শেখ সাহেব আহ্বান জানান।
এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ সম্পাদক জনতাকে লক্ষ্য করিয়া কর্মীরা কারাগারে চলিয়া গেলে আপনারা কি করবেন” জিজ্ঞাসা করিলে উপস্থিত জনতা একযােগে হাত তুলিয়া সংগ্রাম চালাইয়া যাওয়ার সংকল্প প্রকাশ করেন। শেখ মুজিবর রহমান বিশ্বাসঘাতক ও প্রতিক্রিয়াশীলদের দালালদের চিনিয়া রাখিয়া তাহাদের যথাযােগ্য সাজাদানের জন্য আহ্বান জানান। পরিশেষে শেখ মুজিবর বলেন যে, প্রতিনিধিত্ব ছাড়া কর নয়’ ভিত্তিতে আমেরিকার মুক্তি আন্দোলন শুরু হয়। অতএব অনুরূপ আন্দোলন এখানে শুরু হইলে যে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হইবে উহা সম্পর্কে তিনি সরকারকে হুঁশিয়ার করিয়া দেন।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব