You dont have javascript enabled! Please enable it! 1962.10.16 | দেশব্যাপী প্রথম সাধারণ নির্বাচনের মাত্র ৪ মাস পূৰ্বেই গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়: সােহরাওয়ার্দী | সংবাদ - সংগ্রামের নোটবুক

সংবাদ
১৬ই অক্টোবর ১৯৬২

ঐতিহাসিক সমাবেশে নেতৃবৃন্দের ঘােষণা
দেশব্যাপী প্রথম সাধারণ নির্বাচনের মাত্র ৪ মাস
পূৰ্বেই গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয় ঃ সােহরাওয়ার্দী

(নিজস্ব প্রতিনিধির তার)
রাজশাহী, ১৫ই অক্টোবর।- অদ্য অপরাহ্বে স্থানীয় ঈদগাহ ময়দানে এক লক্ষ লােকের এক ঐতিহাসিক জনসমাবেশে জাতীয় ফ্রন্ট নেতা জনাব হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী উদাত্ত কণ্ঠে ঘােষণা করেন, দেশব্যাপী প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাত্র ৪ মাস আগে ১৯৫৮ সনের অক্টোবর মাসে সামরিক আইন জারী করিয়া গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়। গণতন্ত্র এদেশে অচল একথা অর্থহীন কারণ কোন সময়েই গণতন্ত্র বিকাশের সুযােগ দেওয়া হয় নাই। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন সাবেক মুখ্য মন্ত্রী জনাব আবু হােসেন সরকার। জনসভায় জাতীয় ফ্রন্টের বিভিন্ন নেতা বক্তৃতা করেন।
প্রায় এক লক্ষ লােকের সমাবেশে জনাব সােহরাওয়ার্দী বলেন, আমি যখন প্রধান মন্ত্রী ছিলাম তখন একবার রাজশাহীতে আসিয়াছিলাম। কিন্তু অদ্যকার এই জনসভা সেদিনের সমাবেশের চেয়ে অনেক গুণ বেশী, কারণ জনগণ প্রধানমন্ত্রীকে লইয়া মাথা ঘামায় না জনসাধারণ চাহে গণতন্ত্র, তাহারা কোন ব্যক্তি বিশেষকে লইয়া মাথা ঘামাইতে চায় না। তিনি রাজশাহীর ছাত্রদের সংগ্রামের প্রশংসা করিয়া ছাত্রনেতা কাজী শহীদের শাস্তিকে বর্বরােচিত ও অমানুষিক বলিয়া আখ্যায়িত করেন।
জনাব সােহরাওয়ার্দী বলেন, বর্তমানে একজনের শাসন কায়েম রহিয়াছে। এই ব্যক্তি জনসাধারণকে মুগ্ধ বলিয়া আখ্যায়িত করেন। উক্ত ব্যক্তির আদেশকে কোর্ট পৰ্য্যন্ত চ্যালেঞ্জ করিতে পারে না। জনাব সােহরাওয়ার্দী বলেন যে, উক্ত ব্যক্তি মধ্যে মধ্যে গণতন্ত্রের কথা উল্লেখ করিয়া থাকেন; কিন্তু শাসনতন্ত্রে গণতন্ত্র বলিয়া কোন পদার্থ নাই।
তিনি বলেন যে, পাকিস্তানে কোন সময়ই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়। নাই। সুতরাং এদেশে গণতন্ত্র অচল বলিয়া প্রচার করা অর্থহীন। ১৯৫৬ সালের গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রও কার্যকরী করা হয় নাই।
জনাব সােহরাওয়ার্দী বলেন যে, কেন্দ্রে পূর্ব পাকিস্তানের একজন মন্ত্রী ব্যতীত বাকি সকল পূর্ব পাকিস্তানীই এবং পশ্চিম পাকিস্তানেও সর্বাধিক সংখ্যক লােক জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টকে সমর্থন করে।
জনাব সােহরাওয়ার্দী গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র ও জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে জনসাধারণের বৃহত্তর ত্যাগ স্বীকারের আহ্বান জানান। তিনি বলেন যে, এই সংগ্রামে আপনাদিগকে কারা বরণ করিতে প্রস্তুত হইতে হইবে।
বক্তৃতার উপসংহারে জনাব শহীদ সােহরাওয়ার্দী জনসাধারণকে পুরাতন দলীয় স্বার্থের কথা ভুলিয়া ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান এবং জনগণের হৃত স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের আহ্বান জানান। জনাব সােহরাওয়ার্দী জনতার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞাসা করেন, আপনারা কি আপনাদের মৌলিক অধিকার ফিরিয়া পাইতে চান? প্রায় এক লক্ষ লােকের জনতা হস্ত উর্দ্ধে উত্তোলন করিয়া জাতীয় ফ্রন্ট নেতার প্রশ্নের সমর্থনসূচক জবাব দান করেন।
রাজশাহীর সাবেক মুসলিম লীগ নেতা জনাব মাদার বক্স জনসভায় প্রথম বক্তৃতা করেন। তিনি বলেন যে, রাজশাহীর জনসাধারণ জাতীয় ফ্রন্টের পশ্চাতে রহিয়াছে। তিনি বলেন যে, গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের সংগ্রামে রাজশাহীর জনসাধারণ অটুট ঐক্যবদ্ধ পথে সংগ্রাম করিয়া যাইবেন। তিনি তাহার বক্তৃতায় চার বৎসরের একনায়কত্বের নিন্দা করেন।
সােলায়মান
সাবেক কে এস পি নেতা জনাব সােলায়মান বলেন যে, জাতীয় ফ্রন্টের পশ্চাতে আজ দেশের সকল রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ হইয়া এক ঐতিহাসিক রাজনৈতিক ঘটনার সৃষ্টি করিয়াছে। গণতন্ত্রের জন্য এই ঐক্যজোট বৃটিশের বিরুদ্ধে আমাদের আজাদী সংগ্রামের সময়েও দেখা যায় নাই।
জনাব সােলায়মান একনায়কত্বের নিন্দা করিয়া বলেন যে, জনাব লিয়াকত আলীর সময়ও এইরূপ অগণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র প্রদান করা হয় নাই। তিনি দেশের জনসাধারণকে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।
হাকিম আজমল আলী
করাচীর সাবেক আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী হাকিম আজমল আলী বলেন যে, গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের সংগ্রামে পূর্ব পাকিস্তানবাসীর আগ্রহ প্রশংসার ভাষা নাই। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের জাতীয় ফ্রন্ট ও জনাব সােহরাওয়ার্দীর প্রতি পূর্ণ…।
বেগম রােকেয়া আনােয়ার তাঁহার বক্তৃতায় বলেন যে, আজ আর সুখ নিদ্রার সময় নাই। আজ ঐক্যবদ্ধভাবে গণতন্ত্রের সংগ্রাম করিতে হইবে। মৌলিক অধিকার না থাকিলে কৃষক শ্রমিক ও ছাত্রদের দাবীর সংগ্রাম করা যাইবে না।
মাহমুদ আলী
সাবেক ন্যাপ নেতা জনাব মাহমুদ আলী বলেন যে, গত ১৯৫২ সালে আমরা একবার রাজশাহী আসিয়াছিলাম সার্বজনীন ভােটাধিকার ও মৌলিক অধিকার আদায়ের দাবী লইয়া এবং আজ আপনাদের সম্মুখে আসিয়াছি, সেই একই দাবী লইয়া। তবে আজ গােটা জাতি সেই একই অধিকার আদায়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ হইয়াছেন। ইহা আজ আমাদের গর্ববােধ হইয়াছে।
জনাব মাহমুদ আলী বলেন যে, যদিও আমরা বৃটিশের বিরুদ্ধে কঠোর ও দীর্ঘ সংগ্রামের পর স্বাধীনতা লাভ করি আজ তাহার আস্বাদন হইতে আমরা বঞ্চিত- আমাদের স্বাধীনতা অপহৃত হইয়াছে। কিন্তু কাহারও সাধ্য নাই জনগণের অধিকার হরণ করে, কারণ আজ জনগণ জাগ্রত।
তিনি বলে যে, কোয়েটা হইতে শুরু করিয়া চাটগাঁও পর্যন্ত গােটা দেশবাসী আজ ঐকবদ্ধ ও জাগ্রত। তিনি জনসাধারণের উদ্দেশে আরও সুদৃঢ়রূপে ঐক্যবদ্ধ হইয়া আন্দোলন চালাইয়া যাওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন যে, এই পথে আমাদের অধিকার সুনিশ্চিতভাবে প্রতিষ্ঠীত হইবে এবং বর্তমান একনায়কত্বের অবসান ঘটিবে।
আতাউর রহমান
জনাব আতাউর রহমান বলেন যে, গত ১৯৫৮ সালের ৭ই অক্টোবর রাত্রে শুনিতে পাইলাম যে, আমি আর প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রী নহি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি নহি। বন্দুকের আগায় জনসাধারণের অধিকার অস্বীকার করা হইল। জনগণের অজ্ঞাতে দেশের শাসন ক্ষমতা কাড়িয়া লওয়া হইল।
তিনি বলেন যে, বর্তমানে এক ব্যক্তির শাসন চলিতেছে। এই ব্যক্তিটি জনসাধারণের উপর বিশ্বাস নাই। তিনি বলেন যে, বর্তমানের প্রাদেশিক পরিষদ তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হইয়াছে। তথাপি এই পরিষদ কর্তৃক গৃহীত সকল রাজবন্দীর বিনাশর্তে মুক্তিদানের সর্বসম্মত প্রস্তাবকেও একনায়কত্বের সরকার অগ্রাহ্য করিয়াছে।
জনাব আতাউর রহমান আরও বলেন যে, আমাদের অস্ত্র নাই, কামান বন্দুক নাই; কিন্তু গণঐক্যের দুর্বার শক্তি আছে। তিনি বর্তমান অগণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র বাতিল করিয়া সাৰ্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত নয়া পরিষদ কর্তৃক নয়া শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দাবী জানান।
শেখ মুজিবর রহমান
জনাব শেখ মুজিবর রহমান বলেন যে, গত চারি বৎসরে দেশে দুর্নীতি দ্বিগুণ বৃদ্ধি পাইয়াছে।
তিনি বলেন, মওলানা ভাসানীসহ সকল দেশপ্রেমিক কারাগারের অভ্যন্তরে রাখা হয়, জনাব ওলি আহাদ এখন রাজশাহীর কারাগারে বন্দী রহিয়াছেন।
জনাব মুজিবর রহমান বলেন যে, কেবল মাত্র জনসভার মাধ্যমে দাবী আদায়ের সাফল্য হয়ত আসিবে না। বৃহত্তর ত্যাগ স্বীকারের জন্য আমাদিগকে প্রস্তুত হইতে হইবে। তিনি বলেন যে, আজ আর মুসলিম লীগ, কে এস পি বা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বলিয়া কোন দল নাই- সকল দল আজ ঐক্যবদ্ধ হইয়া গণতন্ত্র, ভােটাধিকার, মৌলিক অধিকারের সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ হইয়াছে।
সভায় গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র আদায়ের জন্য নেতৃবৃন্দের পরামর্শ মত পরিকল্পনা ও কার্যসূচী নির্ধারণের সঙ্কল্প প্রকাশ, জাতীয় ফ্রন্টের প্রতি আস্থা জ্ঞাপন, মওলানা ভাসানীসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি দাবী এবং ছাত্রদের উপর গুলী বর্ষণের নিন্দা জ্ঞাপন করিয়া কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব গৃহীত হয়।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় খণ্ড: ষাটের দশক ॥ প্রথম পর্ব