You dont have javascript enabled! Please enable it! পাক চর-চক্র | দেশ - সংগ্রামের নোটবুক

দৃশ্যপট
পাক চর-চক্র
নবারুণ গুপ্ত

পাকিস্তানী গােয়েন্দা চক্রের কাহিনী নিয়ে যেভাবে দেশব্যাপী হই-চই শুরু হয়েছে এবং যা যা ঘটছে তা দেখে আমি বেশ কিছুটা বিস্মিত।
প্রথমত, সব দেখে শুনে মনে হচ্ছে গােটা জাতি যেন এই প্রথম জানল যে একটা পাকিস্তানী গােয়েন্দা চক্র ভারতে কাজ করে এবং তাতে বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও জড়িত। দ্বিতীয়ত, সরকার যেন কেন কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না যে গােটা ব্যাপরটা নিয়ে ঠিক কী করা উচিত। এবং তৃতীয়, কিছু রাজনৈতিক নেতা এ ব্যাপারে, অনেকটা জেনেও স্রেফ দলগত রাজনৈতিক স্বার্থে দোষীদের সম্পূর্ণ নির্দোষবলে সারটিফিকেট দিতে চাইছেন।
একটা বেশ বড় পাক গােয়েন্দা-চক্র যে কাজ করে এবং তাতে যে বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও জড়িত এ খবর দেশের সবাই না জানুন বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতা এবং বিশিষ্ট ব্যক্তি নিশ্চয়ই জানেন। বহু দিন থেকেই জানেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে এ নিয়ে এ রাজ্যে নানা আলােচনাও হয়েছে। কখনও মন্ত্রীদের মধ্যেসরকারী পর্যায়ে। কখনও বা স্রেফ রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত সংঘর্ষের সময় ভারত রক্ষা আইনে বেশ কিছু লোেক গ্রেফতার হওয়ায় এই ব্যাপারটা নিয়ে হই-চইও হয়েছিল। তখনও রাজনৈতিক নেতারা এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিরা খোঁজ খবর নিয়ে এ ব্যাপারে অনেক কিছু জানতে পেরেছিলেন।
এইখানে দুটো জিনিস বলে রাখা দরকার।
প্রথমত, ভারতে বা পশ্চিমবঙ্গে বিদেশ গুপ্তচর-চক্র বলতে যে শুধু পাক গুপ্তচর চক্র সক্রিয় তা নয়। অন্যান্য সব বড় রাষ্ট্রের মত ভারতেও মারকিন, রুশী, জারমানি, বৃটিশ, চীনা প্রভৃতি গুপ্তচর-চক্র সক্রিয়। তবে, নানা কারণে পূর্ব ও পশ্চিম ভারতে পাক গুপ্তচর-চক্র অন্যান্য বহু রাষ্ট্রের গুপ্তচর-চক্রের চেয়ে বেশি ব্যাপক ও সক্রিয়। তাঁদের গােষ্ঠীতে বহু লােক। এবং এরা প্রায় সবাই নানাক্ষেত্রে বিশিষ্ট ব্যক্তি।
দ্বিতীয়ত, ভারতে যে পাক গুপ্তচর-চক্র কাজ করত এবং করে তাতে শুধু মুসলমানই রয়েছেন তা নয়হিন্দু, খৃষ্টান, বৌদ্ধ, শিখ প্রভৃতিও আছেন। প্রত্যেক বিদেশী গুপ্তচর-চক্র আজকাল বিদেশে দু’রকমের কাজ করে। (এক) গােপনে নানা গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ সংগ্রহ। এবং (দুই) সেই দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ব্যাপারে নানাভাবে হস্তক্ষেপ করতে পাক গুপ্তচর বাহিনীর পরিচালকরা প্রথম কাজটা করেন নানা জাতের লােক দিয়ে। কারণ, তাছাড়া নানা অসুবিধা হয়। এবং দ্বিতীয় কাজটা করেন মূলত মুসলমানদের দিয়ে। ভারতীয় সমাজের নানা স্তরের বিশিষ্ট মুসলমানদের ধর্মীয় দুর্বলতার সুযােগ নিয়ে পাক গুপ্তচর-চক্রের নায়করা তাদের দিয়ে নানা কাজ করিয়ে নেন।
আমাদের অনেকেরই ভুল ধারণা আছে যে শুধুমাত্র মুসলমানরাই পাক গুপ্তচর-চক্রকে সাহায্য করেন। কিন্তু এটা যে কত বড় ভুল ধারণা ইতিমধ্যেই বহুবার তা প্রকাশিত হয়েছে। সরকার পাক গুপ্তচরবৃত্তির অভিযােগে এখনও পর্যন্ত বেশ কিছু হিন্দুকেও ধরেছেন।
তবে, কোনও হিন্দু ধরা পড়লে সেটা নিয়ে রাজনৈতিক নেতারা হই-চই করেন না। যেমন করেন কোনও মুসলমান ধরা পড়লে। কোনও মুসলমান ধরা পড়লেই সেই ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়। সঙ্গে সঙ্গে একটা সাম্প্রদায়িক প্রচার শুরু হয়ে যায়। এবং ভােট লােভাতুর রাজনৈতিক নেতারা ভােটের লােভে সবাই তখন তাদের দরদী সেজে ওঠেন। যেমন ১৯৬৫ সালে হয়েছিল। যেমন এবার হচ্ছে।
প্রধানত এর ফলেই আমাদের গােয়েন্দা দফতরগুলি পাক গুপ্তচর-চক্রের ভারতীয় সহযােগীদের ব্যাপারে কখনও তেমন কিছু করে উঠতে পারেন নি। এবং তার ফলে পাক (গুপ্তচর-চক্র এদেশে, বিশেষ করে পূর্ব ও পশ্চিম ভারতে কার্যত যখন যা খুশি করে, যেতে পেরেছেন। পশ্চিমবঙ্গের ১৯৬৭, ১৯৬৯ এবং ১৯৭১ সালের নির্বাচনে পাক গুপ্তচক্র কী বিরাট ভূমিকা গ্রহণ করেছে যদি কোনও দিন প্রকাশিত হয় তাহলে ভারতবাসী বিস্ময়ে হতবাক হবেন।
গােয়েন্দা দফতরগুলি এর কিছুই শুনতে পারে নি তা নয়। কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের অর্থাৎ সরকারচালকদের ভয়ে অথবা আপত্তিতে তারা কিছুই করতে পারেন না। রাজ্যের নানা রাজনৈতিক দল ভােট সংগ্রহের আগ্রহে বিভিন্ন সময়ে সম্পূর্ণ সন্ধানে পাক গুপ্তচর-চক্রের সাহায্য পেয়েছেন। সেই জন্যই পাক গুপ্তচর-চক্রের কেউ ধরা পড়লে, বিশেষ করে কোনও মুসলমান ধরা পড়লে বিরাট হই-চই শুরু হয়ে যায়।
এ ব্যাপারে গােয়েন্দা দফতরের আর একটা বড় অসুবিধা আছে। সেটা হল আদালতে প্রমাণের অসুবিধা। ভারতীয় সাক্ষ্য আইন অনুসারে গুপ্তচরবৃত্তির বা গুপ্তচর-চক্রের হয়ে কাজ করার অভিযােগে আদালতে কাউকে সাজা দেওয়া অত্যন্ত কঠিন। সাধারণত গুপ্তচর বা এজেন্ট লিখিত পড়িত কোনও প্রমাণ রাখে না। সে যে টাকা নেয় স্বনামে তার কোন রসিদ দেয় না যাদের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করে তারা আদালতে এসে সাক্ষী দেবেন তাও আশা করা যায় না। তাই আমাদের পুলিসের যা কর্মদক্ষতা তা দিয়ে এবং ভারতীয় সাক্ষ্য আইনের আওতায় মামলা চালিয়ে এদেশে গুপ্তচরকে সাজা দেওয়া অত্যন্ত কঠিন।
এবার পাক গুপ্তচর-চক্রের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার যে আচরণ করেছেন তা বিচিত্র।
আশ্চর্যজনকভাবে এবার ভারত সরকারের হাতে কতকগুলি কাগজপত্র এসে যায়। বহু কাগজ। বহু তথ্য। আসে সেই এপরিল মাসে। কাগজপত্রগুলি এ-কর্তা সে-কর্তার হাতে হাতে ঘুরতে থাকে। এবং ঘুরতে ঘুরতে এ সম্পর্কে কিছু কিছু খবর সংবাদপত্রেও বেরিয়ে পড়ে। তা নিয়ে আবার সংসদেও ঝড় শুরু হয়। সঙ্গে সঙ্গে সংবাদপত্রেও চাপ বাড়ে। কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকার দুই-ই তখন মহা মুশকিলে পড়ে যান। কারণ, ততদিনে কেউই মনঃস্থির করে উঠতে পারেন নি এ ব্যাপারে কী করবেন-এগােবেন কিনা এবং এগােলেই বা কীভাবে এগােবেন।
কিন্তু সংসদের এবং খবরের কাগজেও চাপ যখন প্রচণ্ড হয়ে উঠল, তখন কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার দুই-ই দেখলেন একটা কিছু না করলেই আর নয়। দিল্লি থেকে কেন্দ্রীয় গােয়েন্দা দফতরের দুই অফিসার ছুটে এলেন কলকাতায়। রাজ্য সরকারকে অনুরােধ জানালেন, অবিলম্বে একটা কিছু করুন।
সেই মত দুজনকে ঝটপট গ্রেফতার করা হল। তারা রাজনৈতিক নেতা এবং বিশেষ করে মুসলমান। বিরােধ পক্ষভুক্ত।
সঙ্গে সঙ্গে ঝড় উঠল। সরকার কিন্তু এখনও স্থির করে উঠতে পারেন নি তাদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করবেন, না শুধু বিশেষ ক্ষমতাবলে তাদের গ্রেফতার করে বিশেষ বিচারকের কাছে যাবেন। কিন্তু সংসদে এবং সংবাদপত্রে দাবি উঠল প্রকাশ্যে বিচার চাই। ফলে রাজ্য সরকার ঘােষণা করেছেন, প্রকাশ্যেই বিচার হবে।
আসলে কিন্তু এই প্রবন্ধ লেখা পর্যন্ত ব্যাপারে কিছুই পাকা হয়নি।
সরকার যে কাগজপত্র পেয়েছেন সেগুলাে অবশ্য এখন ও বাইরের কাউকে দেখান হয়নি। কিন্তু সরকার যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাগজ পেয়েছেন সেটা বিশিষ্ট ব্যক্তিরা অনেকেই জানেন। সকলের সম্পর্কে হলেও অনেকের সম্পর্কে। এই “অনেক ব্যক্তির অতীত ক্রিয়াকলাপও অনেকেরই জানা। আবার প্রশ্ন, তাহলে রাজনৈতিক নেতারা সবাইকে নির্দোষ বলে সারটিফিকেট দিয়েছেন কী করে?
স্রেফ দলগত রাজীতির স্বার্থ এবং সরকার ও কি দলগত গােষ্ঠীগত রাজনীতির স্বার্থে কিছু নাম চেপে যেতে চাইছেন? আর অফিসাররা চাইছেন কিছু অফিসারকে বাঁচাতে?

সূত্র: দেশ ॥ ৪-৬-৭১। ২৮ জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৮