You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.07 | প্রশ্ন-তিন মহান রাষ্ট্রকে- ওঁরা অস্ত্র দিয়েছিলেন কেন, গণতন্ত্রের জন্য, না গণহত্যার জন্য? | আনন্দবাজার - সংগ্রামের নোটবুক

প্রশ্ন-তিন মহান রাষ্ট্রকে
ওঁরা অস্ত্র দিয়েছিলেন কেন, গণতন্ত্রের জন্য, না গণহত্যার জন্য?
মনােজ বসু

ঢাকা বেতার কেন্দ্র ধরেই শুনতে পেতাম প্রাণঢালা দেশাত্মবােধক সঙ্গীত। বক্তব্য তার মধ্যে একটাই বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’- নানা সুরে ছন্দে কথায় ঝঙ্কৃত হত। ২৬ মার্চ সকাল বেলা সঙ্গীতমূৰ্ছনা নিস্তব্ধ। ঘােষিকার বাষ্পকুল কণ্ঠ কানে এলাে : পশ্চিম পাকিস্তানি ফৌজ বর্বর হত্যাকাণ্ডে নেমেছে, এ কোরবানি আমরা ভুলব না। গানের বদলে বলদর্পী সামরিক শাসকরা হুকুমের পর হুকুম ছাড়ছেন। শেখ মুজিবর রহমান রাষ্ট্রদ্রোহী, শাস্তি তাকে পেতেই হবে-‘ বললেন ইয়াহিয়া খা, গণতান্ত্রিক বা নৈতিক অধিকার তিলেক মাত্র যার নেই। বলছেন তিনি মুজিবরের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জন-গণ-মন-অধিনায়ক যিনি, সাম্প্রতিক নির্বাচনে গণমানুষ যার শিরে সর্ব পাকিস্তানের শিরােপা চড়িয়ে দিয়েছে।
নিখুত আয়ােজন। কড়া সেন্সর ব্যবস্থায় প্রেসের মুখ আষ্টেপিষ্টে বেঁধে ফেলা হল। কয়েকটি সংবাদপত্রের ঘরবাড়ি ও ছাপাখানা চূর্ণবিচূর্ণ করে সাহস ও সত্য ভাষণের পরিণাম দেখানাে হল অন্যদের। বিদেশী সাংবাদিকরা বড় আশায় ঢাকায় এসে জমেছিলেন পাকিস্তানে গণতন্ত্র চালু হবার বিবরণ বিশ্বজনের কাছে তুলে ধরবেন বলে, ভদ্রলােকদের গরু ভেড়ার মতন তাড়িয়ে প্লেনে তুলে করাচিতে নামিয়ে দিয়ে এলাে। কীর্তিকাহিনী কোন রকমে বাইরে চাউর না হয়, নিচ্ছিদ্র ব্যবস্থা তার।
সতেরজন বাঘা বাঘা জেনারেলের নেতৃত্বে রক্তপিপাসা, ফৌজের দল বাংলাদেশের উপর ঝাপিয়ে পড়ল। সর্বাধিক মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত- স্থলে ট্যাঙ্ক, জ্বলে ফৌজি বহর অন্তরীক্ষে বােমারু, বিমান। অপর পক্ষ সেখানে প্রায় শূন্যহস্ত, সম্বল আদর্শনিষ্ঠা ও বাংলা প্রেম। নির্বিচারে গণহত্যা চলেছে- ইতিহাসে নৃশংসতম। বৃদ্ধ শিশু, স্ত্রীলােক হাসপাতালের রােগীদের পর্যন্ত রেহাই নেই। গৃহবধু ও কন্যাদের ধরে ধরে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাচ্ছে, ধর্ষণের পর হত্যা করে ছুঁড়ে দিচ্ছে রাস্তায়, অথবা তারা নিজেরাই আত্মহত্যা করছেন। বড় বড় শহরগুলাে পুড়িয়ে গুড়িয়ে ধ্বংস করছে। নিরীহ নিরাপরাধ মানুষের মৃত্যুদেহে পা ফেলবার জায়গা মেলে না। লক্ষ ছাড়িয়ে ইতিমধ্যে অনেক লক্ষে পৌছে গেছে। নিখিল-পাকিস্তানের মধ্যে সংখ্যাগুরু বলে বাংলাদেশ বড় অসুবিধা ঘটাচ্ছিল- মেরে মেরে এইবারে তাদের সংখ্যালঘু বানিয়ে দেবে, হয়তাে বা সেই মতলব। দুনিয়ার মাতব্বর শক্তিগুলাে নির্বাক দর্শক- এক রাশিয়াই এখন অবধি ইয়াহিয়া খাঁর প্রতি কিঞ্চিৎ হিতােপদেশ ছেড়েছেন। বিশ্ব-বিবেকের মৃত্যু ঘটেছে বলে সন্দেহ করি।
অন্ধকারের জীব ওরা-শিক্ষা-সংস্কৃতি প্রজ্ঞা-পাণ্ডিত্য শিল্প-সাহিত্য সইতে পারে না। হিটলারের আমলে ঠিক এমনি হয়েছিল- বুদ্ধিজীবী ও লেখক, শিল্পীরা প্রাণ দিলেন অথবা প্রাণ নিয়ে পালালেন। স্পেনে ফ্রাঙ্কোর আমলে তাই। এবং বাংলাদেশের ব্যাপারেও হুবহু সেই জিনিস। ঢাকা ও রাজশাহীর মহিমামণ্ডিত সুপ্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় নিশ্চিহ্ন করেছে, লাইব্রেরি পুড়িয়েছে, জিন্না হল, ইকবাল হল, সলিমুল্লা হল, রােকেয়া হল আর নেই। ছাত্রছাত্রীদেরও কবর হয়েছে, ছাত্রী অনেকের আরও কিছু বেশি। জ্ঞানতপস্বী অধ্যাপকদের গুলি করে মেরেছে। ইতিহাস বিভাগের প্রধান ডক্টর হবিবুল্লাহ পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ডক্টর জীনত আলি, ইংরেজি বিভাগের প্রধান ডক্টর সারওয়ার খুরশিদ, দর্শন বিভাগের প্রধান ডক্টর গােবিন্দচন্দ্র দেব, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ডক্টর মুফাজ্জল হায়দার চৌধুরি, সংখ্যাতত্ত্ব বিভাগের প্রধান ডক্টর মনিরুজ্জমান। বঙ্গ ভাষা ও বাংলা সাহিত্যের জন্য নিবেদিতপ্রাণ বাংলা একাডেমির ডিরেক্টর ডক্টর কবির চৌধুরিও গুলির মুখে গেছেন। এবং ডক্টর এ শরাফ, ডক্টর রসিদ। বেগম জহিরউদ্দিন আগুন-ঢালা কবিতা লিখেছিলেন, গুলিতে সপরিবারে তাই প্রাণ দিতে হল। কবি আনিসুজ্জান খান ও কবি মৌলানা তমিজুদ্দিনকেও হত্যা করেছে বলে শােনা যাচ্ছে। প্রাণ দিয়ে বুদ্ধিজীবী আরও বহুজনকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছে, খবরের পর খবর আসছে। তবু এখনাে প্রতিবাদের ঝড় উঠল না- দুনিয়ার দিকপালেরা ধ্যানীবুদ্ধবৎ নিশ্চুপ।
বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনীর তবু বজ্ৰদৃঢ় সংকল্প। করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে। বিদ্যুদ্দীপ্তির মতাে বেগম রােশেনারার আত্মদান। ফার্স্ট ইয়ারের মেয়ে বয়স ষােল-সতেরাে। মুজিব-ইয়াহিয়ার বিলম্বিত আলােচনায় রােশেনারা অধীর হয়ে উঠেছিল। বলত কথাবার্তা ঢের হয়েছে- বাজিয়ে দিই আমরা এবার। সবুর সবুর! ভাই মকবুল রাজনৈতিক কর্মী বােনকে আর থামিয়ে রাখতে পারেন না। বলত, গুলির মুখে মরব না আমি, দেখাে। প্যাটন ট্যাঙ্ক নেমে পড়ে ঢাকার রাস্তায় ধুন্দুমার বাধিয়েছে। নিজের বুকে মাইন বেঁধে অগ্নিকন্যা জীবন্ত মাইন হয়ে গেল। লক্ষাভ্রষ্ট হবার ভয় নেই- ঝাপিয়ে পড়ল সে ট্যাঙ্কের উপর। ট্যাঙ্ক বিধ্বস্ত মেয়েও ছিন্নভিন্ন হয়ে ছাড়িয়ে পড়ল ছিটিয়ে পড়ল চারিদিকে। শামসুদ্দিন গবর্নর হাউসের পরিচারক, তার হাতে টিক্কা খায়ের মৃত্যু- সেও এক বিচিত্র কাহিনী। মুজিবর বন্দী, খবর ছড়িয়ে দিয়েছে। পঁচিশ হাজার মানুষ অমনি খায়ের আস্তানা ঘিরে ফেলল। নিরুপায় টিক্কা খা গুলি চালায়। প্রথম বলি জাহিরা বেগম, শামসুদ্দিনের সহােদরা। এবং নুরুল নামে এক বালক। টিক্কার রিভলবার কেড়ে শামসুদ্দিন তাকেই গুলি করল। নার্সিং হােমে পরের দিন মৃত্যু। সুইসাইড স্কোয়াডের ছেলেমেয়েদের আরও এক তাজ্জব কাহিনী শুনছি। লেখা হয়ে যাবে কোন একদিন- পাঠকের চোখে অশ্রু নয়, আগুন ধ্বকধ্বক করবে।
১৯৫২ অব্দ, আজ থেকে উনিশ বছর আগে। পিকিঙের শান্তি সম্মেলনে সাঁইত্রিশটা দেশের মানুষ জমায়েত হয়েছিলাম। শেখ মুজিব তেত্রিশ বছরের যুবা, নেতা তখনই। পাকিস্তান দলের মধ্যে আছেন তিনি আমি ভারতীয় দলে। পিকিঙ হােটেলের পাশাপাশি ঘরে আমাদের অধিষ্ঠান, দিনে রাত্রে সর্বক্ষণ দেখাসাক্ষাৎ। কাজ কর্মের শেষে রাত্রিবেলা তিনি আমাদের ঘরে আসতেন, কিম্বা আমি যেতাম তাদের ঘরে। লঘুগুরু কত রকমের আলােচনা, কত হাস্যপরিহাস। সৌজন্যবশে তিনি আমাকে দাদা বলতেন। বলতেন, দাদা ভারতে গিয়ে জনে জনের পায়ে ধরব, কেন তারা হক্কের জায়গা ত্যাগ করে চলে গেলেন। অনেক কাল আগেকার কথাগুলাে স্পষ্ট এখনাে আমার মনে ভাসছে, সােভিয়েতে প্রতিনিধিরাও ছিলেন। চীন ও সােভিয়েত, ধরতে গেলে, সম্মেলনের আসল কেষ্টবিষ্ট। সম্মেলন শেষে সাইত্রিশটা দেশ আমরা মিলিতভাবে প্রতিজ্ঞা নিলাম : মানুষের রক্তে পৃথিবী আর কখনাে কলঙ্কিত হতে দেবাে না কিছুতেই না। এর পরে সােভিয়েত দেশে গিয়ে সেখানেও সর্বত্র ঐ প্রতিজ্ঞার প্রতিধ্বনি শুনে এসেছি। আটলান্টিক পেরিয়ে মার্কিন ভূমিতে পা ছোঁয়ানাের মুখেই সুবিশাল সিবার্টি মূর্তি, মার্কিন জাতি গণতন্ত্রের পরম সুহৃৎ, মূর্তি আকাশ জুড়ে সেই ঘােষণা করছে। অথচ, কী আশ্চর্য, পাক জঙ্গীফৌজ গণতন্ত্রের কবর খুঁড়ছে তার অস্ত্রশস্ত্র ও সাজসরঞ্জামের বেশির ভাগ সরবরাহ ঐ তিন মহান রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রয়ের মধ্যে মতবিরােধের অন্ত নেই- মারণাস্ত্রগুলির কিন্তু নির্বিরােধ সহাবস্থান, একে অন্যের পরিপূরক হয়ে বর্বর গণহত্যায় মেতেছে। অস্ত্র দিয়েছিলেন ওঁরা প্রতিরক্ষার প্রয়ােজনে, গণতন্ত্র নিধনের জন্য নিশ্চয় নয়। নিষ্ঠুর পাশবিকতার নিমিত্তভাগী না হয়ে ওঁরা সব অস্ত্র কেড়ে নেবেন, এবং উনিশ বছর আগেকার সেই প্রতিজ্ঞা নতুন করে আবার গ্রহণ করবেন, শান্তি ও মৈত্রীর প্রয়াসী আমি লেখক ঘােষণা শুনবার জন্য উত্তর্ণ হয়ে আছি।

সূত্র: আনন্দ বাজার : ৭.৪.১৯৭১