রাজ্য-রাজনীতি
কিসের আশায় জঙ্গী চক্র এই লড়াই চালাচ্ছে?
বরুণ সেনগুপ্ত
বহুদিন পরে এই একটা ইস্যু এসেছে আমাদের সামনে, যে ইস্যুতে সব বাঙালি একমত। আমরা সবাই মনে প্রাণে বাংলাদেশের মুক্তিসেনাদের পক্ষে, আমরা সবাই পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে। আমরা যারা এপারের, তাঁরা সবাই বাঙলাদেশের মুক্তিসেনাদের সাহায্য করতে ব্যস্ত। যে যেভাবে পারি। এ পারের বেশ কিছু ছেলে গিয়েছেন ওপারে লড়াই করতে। তারা বাঙলাদেশের মুক্তিসেনাদের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে লড়াই করছেন। তারা অনেকেই ইতিমধ্যে বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন। তারা গিয়েছেন সব দল থেকে। তারা গিয়েছেন সব শ্রেণী থেকে। তাদের একমাত্র লক্ষ্য পাকিস্তানী সেনা বাহিনীকে খতম করা- যে প্রতিজ্ঞা এবং সংকল্পে বাঙলাদেশেরও প্রায় সাড়ে সাত কোটি মানুষ অটল।
যাঁরা বাঙলাদেশে ইয়াহিয়া খাঁর অনুচরদের ক্রিয়াকলাপ দেখেছেন, যাঁরা পূর্ববঙ্গলায় পাক সেনাবাহিনীর পাশবিক তাণ্ডবলীলার কাহিনী শুনেছেন তারা সকলেই বাঙলাদেশের মানুষের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন। যারা রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক স্বার্থে অন্ধ তাদের কথা অবশ্য ভিন্ন। তারা সব দেখে এবং শুনেও ইয়াহিয়ার সমর্থক হতে পারেন। তারা কেউ কেউ প্রকাশ্যেও পাক সেনাবাহিনীর পক্ষে কথা বলছেন।
কিন্তু গত দশ-বারদিনে আমি কলকাতায় বহু বিদেশী সাংবাদিক এবং পূর্ববঙ্গ থেকে পালিয়ে আসা বহু আমেরিকান, ইউরােপীয় ও অস্ট্রেলিয়ানের সঙ্গে কথা বলেছি। পাক সেনাবাহিনীর নারকীয় ক্রিয়া-কলাপ দেখে তারা সবাই স্তম্ভিত। তারা কেউ কেউ হিটলারের সেনাবাহিনীকেও দেখেছেন। তারা সবাই স্বীকার করেছেন, নাজি নাৎসী সেনারাও পাক সেনাদের তুলনায় শিশু। তাঁরা সবাই বলেছেন, নিরস্ত্র শান্তিপ্রিয় মানুষের উপর এভাবে যে কেউ মেসিনগান চালাতে পারে তা কল্পনাও করা যায় না।
ইয়াহিয়া খাঁ যেমন বিশ্ববাসীর কাছে তাঁর নগ্ন রূপ উদ্মানিত করেছেন, ইয়াহিয়া খাঁ তেমনি পূর্ববাংলার গােটা বাঙ্গালি জাতিকে এক করে দিয়েছেন। এ লড়াইয়ের আগেও গােটা পূর্ববাঙলার কিছু কিছু ভিন্ন মতাবলম্বী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ পাক সামরিক কর্তৃপক্ষের অনুগ্রহ লাভের লােভে পাক শাসকদের সঙ্গে সহযােগিতাও করে চলতেন। কিন্তু এখন এরাও তাদের শত্রু। কারণ, পাক সেনাবাহিনী তাদেরও ছাড়েনি বাঙালি মাত্ৰকেই তারা শেষ করতে এগিয়ে গিয়েছে। বাঙালি দেখলেই তাকে গুলি করেছে। কোনও বাঙালিকেই ছাড়ছে না। সে বাঙালি হিন্দু না মুসলমান, বৌদ্ধ খৃষ্টান- সে বিচার পাক সেনারা করছে না। যে বাঙালি সেই তাদের শত্রু তাকেই তারা গুলি করে মারছে। তাই, গােটা পূর্ববাঙলায় বাঙালি আজ এক জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতায় বাঙলাদেশের ধনী-দরিদ্র, হিন্দু-মুসলমান সব বাঙালিই আজ পাক সরকারের শত্রু।
যে জিনিস শেখ মুজিবর রহমান পারেননি, সেই কাজ ইয়াহিয়া খা করে দিয়েছেন।
এইটা বাঙলাদেশের বর্তমান লড়াইয়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক।
* * *
এই লড়াইয়ের আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে। সে দিকটাও ভুলে গেলে চলবে না। সেই সত্যটা হল যে, বাঙলাদেশের এই লড়াইয়ে চট করে জয়-পরাজয়ের নিস্পত্তি হতে পারে না। পাক সেনাবাহিনী বিপর্যস্ত, পাক সেনাবাহিনীর জীবন বাঙলাদেশে ক্রমেই দুর্বিষহ, পাক সেনাবাহিনী সব জেলা-শহরকেও সব সময় নিজের দখলে রাখতে পারছে না। কিন্তু তা বলে কেউ যদি আশা করে থাকেন যে মুক্তিসেনারা নিজ শক্তিতে দুতিন মাসের মধ্যেই গােটা বাঙলাদেশ থেকে পাক সেনাবাহিনীকে হটিয়ে দিতে পারবেন তাহলে তিনি ভুল করবেন। আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত কোনও শিক্ষিত সেনাবাহিনীকে কিছু আধা সামরিক মানুষ হাল্কা ও সীমিত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অত সহজে পর্যুদস্ত করতে পারে না। পাক সেনাবাহিনী ও পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের পক্ষে আর কোনও দিন গােটা বাঙলাদেশে শাসন ও শােষণ চালান অসম্ভব। কিন্তু তা বলে এটা ধরে নেওয়া ভুল হবে যে, ওরা চট করে পূর্ববাঙলা ছেড়ে চলে যাবে, ওরা কোনও শহরেই থাকতে পারবে না এবং ওদের জেট বিমানগুলি পূর্ববাঙলার পূর্ববাঙলার গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলিতে বােমা বর্ষণ চালিয়ে যাবে না। পাক সামরিক কর্তৃপক্ষ এত চট করে বাঙলাদেশ ছেড়ে দেবে না।
বিদেশী সাহায্যও তারা পাবে। একাধিক বড় রাষ্ট্র তাদের সাহায্য করবে- কেউ গােপনে, কেউ বা প্রকাশ্যে। তারা নিজ নিজ স্বার্থেই এ কাজ করবে। একাধিক বড় রাষ্ট্র চায় বাঙলাদেশের ও লড়াইকে জিইয়ে রাখতে পূর্ব বঙ্গের উপর, ভারতের পূর্বাঞ্চলের উপর সামরিক প্রয়ােজনে দুটি বড় রাষ্ট্রের লােভ আছে। এ লড়াই বেশী দিন চললে তাঁরা সেই লােভ চরিতার্থ করার সুযােগ পেতে পারেন। তাই, এ লড়াইয়ে তারা দু পক্ষকে সাহায্য করলেও আশ্চর্য হব না। কারণ, লড়াই জিইয়ে রাখতে হলে দুপক্ষেরই বাইরের সাহায্য প্রয়ােজন হবে।
ভারত সরকার যদি প্রকাশ্যে মুক্তি সেনাদের পক্ষে নামেন, যদি ভারতীয় সেনা ও বিমানবাহিনী খােলাখুলিভাবে ও লড়াইয়ে সামিল হন তাইলে অবশ্য দুতিন সপ্তাহের মধ্যেই বাংলাদেশ থেকে পাক সেনাবাহিনীকে বিতাড়িত করা যায়। তা হলে দুতিন সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশে স্বাধীন সরকার সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
কিন্তু তাহলে কি পাকিস্তানের বন্ধুরা চুপ করে বসে থাকতে পারবেন? তাহলে কি উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিমভারতের এই তিন সীমান্তেই লড়াই শুরু হওয়ার আশঙ্কা থাকবে না? যে দুটি বড় রাষ্ট্র ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলে দখল চান, ঘটি চান তাঁরা চট করে এই যুদ্ধ শেষ হতে দেবেন কেন? তাহলে যে তাঁদের লক্ষ্যই পূর্ণ হবে না!
তবে, এই যুদ্ধ যদি বেশী দিন চলে, তাহলে নানা বিচারে ভারতের বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের প্রভূত ক্ষতি হতে বাধ্য।
***
ইয়াহিয়া খা কোন্ বুদ্ধিতে এই লড়াইয়ে নেমেছেন কারু পক্ষেই সেটা বােঝা সম্ভব নয়। এই যুদ্ধ চালাতে গেলে যে ঢাকের দায়ে মনসাই বিক্রি হয়ে যাবে! পূর্ববঙ্গে লড়াই চালাতে গিয়ে যে পশ্চিম পাকিস্তানই বিকিয়ে যাবে!
আর, মাসের পর মাস লড়াই চালিয়েও কি তিনি বা তার অনুচররা আর কোনও দিন গােটা পূর্ব বাংলার শাসন ও শােষণ চালাবার অধিকার পাবেন? এর পর আর তা সম্ভব?
তা হলে এই যুদ্ধে তিনি ও তার সমর্থকরা চালাচ্ছেন কিসের আশায়? কেউ বাইরে থেকে তাকে ঠেলে এগিয়ে দিয়েছে? কেউ তাকে ঠকিয়ে এমন জায়গায় নিয়ে গিয়েছে, যেখান থেকে আর ফেরা সম্ভব নয়? বাইরের কেউ আশপাশের লােকদের ঘিরে চাপ সৃষ্টি করেছে, বাঙালি জাতির উপর এইভাবে পশুর মত ঝাপিয়ে পড়তে পাক সেনাদের উত্তেজিত করেছে- যাতে না আর কোনও দিন কোনও মিটমাট হতে পারে?
আমার মনে আরও একটা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে গত আট দশ দিন বাংলাদেশে ঘুরে এবং ওখানের সবটা দেখে। সেই প্রশ্নটা হল- সাংগঠনিক দিক থেকে তেমন কিছুই প্রস্তুত না হয়ে শেখ মুজিবর রহমানই বা এত দূর এগিয়ে গেলেন কেন? পাকিস্তানের সঙ্গে জাতীয় পতাকার সম্পর্কটুকুও ছিন্ন করার পর ঘটনাপ্রবাহ কীভাবে এগােতে পারে, তা কি তিনি এবং তাঁর দল মােটেই বােঝেননি? যদি বুঝে থাকেন, তাহলে সেভাবে প্রস্তুত হননি কেন? কেউ কি একই সঙ্গে এপক্ষকেও ভুল বুঝিয়েছেন, ঠেলে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে?
সূত্র: আনন্দ বাজার : ৯.৪.১৯৭১