শরণার্থী ও মহামারী
বাংলাদেশ থেকে শরণার্থীরা এ-রাজ্যে আসার পর আমাদের জনস্বাস্থ্য এক বিরাট সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের জনস্বাস্থ্য রক্ষার ব্যবস্থা এমন কিছু প্রশংসনীয় নয়। কোনাে মহামারী দেখা দিলে তটস্থ হয়ে উঠতে হয়। শরণার্থীরা লাখে লাখে এ-পারে চলে আসায় তাদের আশ্রয়দানের সুব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। তার ফলে এরা যে অবস্থায় থাকতে বাধ্য হচ্ছেন তাতে রােগের প্রাদুর্ভাব হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। হয়েছেও তাই সীমান্তবর্তী কয়েকটি এলাকায় কলেরা রােগ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে: তার সঙ্গে রয়েছে উদর-ঘটিত ব্যাধি এবং শিশুদের ডিপথেরিয়া রােগ। আমাদের স্বাস্থ্য দপ্তর ঠিক করতে পারছেন না, কীভাবে এইসব মহামারী রােধ করা যায়। অবশ্য চেষ্টায় ত্রুটিও যে করছেন তা নয়।
সমস্যার জটিলতা এবং ব্যাপকতা অনুভব করে বিভিন্ন দেশে খাদ্য এবং ওষুধ পাঠাতে শুরু করেছেন। আন্তর্জাতিক কয়েকটি সংস্থা ওষুধপত্র দিয়ে সাহায্য ছাড়াও সেবার কাজকর্ম চালাবার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছেন। কিন্তু প্রয়ােজনের তুলনায় তা হয়ত তেমন বেশি কিছু নয়।
এমন অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গ ও পাশাপাশি রাজ্যগুলির জনস্বাস্থ্য রক্ষা করতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়ােজন শরণার্থীদের চাপ থেকে শিবির এবং সীমান্তবর্তী এলাকাগুলিকে রক্ষা করা। পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা যেখানে প্রায় সাড়ে চার কোটি সেখানে তাকে ইতিমধ্যেই প্রায় পঁয়তাল্লিশ পঞ্চাশ লক্ষ শরণার্থীকে আশ্রয় দিতে হয়েছে। আরও হয়ত পঞ্চাশ লক্ষ বর্ষার মধ্যে এসে পড়বে। এই রাজ্যে এক কোটি উদ্বাস্তুর স্থান সংকুলান হতে পারে না-অন্তত যেভাবে হচ্ছে এ-ভাবে নয়। মহামারী যেভাবে দেখা দিয়েছে ইতিমধ্যে তাতে আশঙ্কা হচ্ছে-খুব দ্রুত এর প্রসার ঘটতে পারে।
মহামারী এ-রাজ্য থেকে পার্শ্ববর্তী রাজ্যে ছড়িয়ে পড়বে। এই রাজ্য এবং অন্যান্য রাজ্যগুলিকে বাঁচাতে হলে তাই সর্বাগ্রে প্রয়ােজন এখান থেকে দ্রুত বেশ কিছু শরণার্থী সরিয়ে নেওয়া। কেন্দ্রীয় সরকার পঁচিশ লক্ষ শরণার্থীকে সরাতেও রাজী হয়েছেন। তার কাজও শুরু হয়েছিল-কিন্তু প্রথমেই বাধা পড়েছে। প্রথম দফায় যে তিন লক্ষ শরণার্থীকে সরানাের ব্যবস্থা করা হচ্ছিল, তার মাত্র একটি অংশকে অন্যত্র পাঠাতে গিয়েই এক বিপত্তি দেখা দিয়েছে। গত কয়েকদিনে যে হাজার সাতেক শরণার্থীকে রেলে করে নানা শিবিরে পাঠানাের ব্যবস্থা করা হয়েছিল-তার মধ্যে বেশির ভাগই ট্রেন থেকে নেমে পালিয়ে গিয়েছেন। খুবই আশ্চর্যের কথা একটি ট্রেনে এক হাজার শরণার্থীকে পাঠানাে হচ্ছিল, তার মধ্যে আটশাে জনই দু এক স্টেশনের পর নেমে পড়ে পালিয়ে যান। এ-রকম হবার কারণ, একশ্রেণীর স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক দল শরণার্থীদের মধ্যে নানা ধরনের গুজব ও প্রচার চালিয়ে তাঁদের ভীত ও সন্ত্রস্ত করে তুলছেন। এই রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্য হল, পশ্চিমবঙ্গের জনজীবনকে আরও ভয়াবহ করে তােলা, সরকারী ব্যবস্থাকে বানচাল করা, বর্তমান রাজ্য সরকারকে বিপদগ্রস্ত করা, কেন্দ্রীয় সরকারকে উদ্বিগ্ন করে তােলা। যে রাজনৈতিক দল ওই ধরনের অমানবিক, জঘন্য কাজ করছে তার বিরুদ্ধে আমাদের সকলেই আজ ধিক্কার জানাতে হবে। সেই সঙ্গে জননেতা, অন্যান্য রাজনৈতিক দল এবং সরকারকে একটি বড় কাজ করতেই হবে। শরণার্থীদের বােঝাতে হবে যে , তাদের কান ভাঙিয়ে যারা আজ ওঁদের অন্যত্র যেতে দিচ্ছেন না—আসলে তারা ওই শরণার্থীকুলকে রােগে, অনাহারে, আশ্রয়হীন করে বিপদে ফেলতে চায়। তাতে ওইদলের স্বার্থ রক্ষা পাবে বটে–কিন্তু হতভাগা শরণার্থীরা রক্ষা পাবেন না।
সূত্র: দেশ ॥ ৪ আষাঢ় ১৩৭৮। শনিবার। ১৯ জুন ১৯৭১