ভারতবর্ষ-বাংলাদেশের সীমান্তে দাঁড়িয়ে
শামসুর রহমান
পঞ্চান্ন কোটি বাঙালির স্পর্শ-শিহরিত জয়-তিলকে ঝলমল আমার ললাট।
বিদায়ের পূর্বে করমর্দনসহ পঞ্চান্ন কোটি মানুষের মুখ একত্রে দেখার আমি প্রয়াসী। দুই হাত নিঃসাড়। দুই চক্ষু এই ক্ষেত্রে অসহায় অক্ষমতায় বিরাগী, বার বার দৃষ্টিশূন্য।
তাই উদ্দেশ্য সিদ্ধির উপায়ের খোঁজে আমি পরিব্রাজক। আত্মীয়-স্বজনের নৈকট্য-বঞ্চিত বিচ্ছেদব্যথা, নেপথ্যে নয়, সােজাসুজি অভিঘাতে প্রশ্ন তােলে : পথ কোথায়?
ওই হার্দিক বন্ধন আবার এক লহমার ব্যাপার নয়। সেখানে শত শত শতাব্দী ইতিহাসের পাতা অধ্যায়ের পর অধ্যায় উল্টে উল্টে এগিয়ে যায়; যার সমগ্র পাঠ অসম্ভব এই জন্যে সে, দ্রুততা ছাড়াও হাজার হাজার ছায়া-ছবির স্রোতধারা স্বপ্নের মতই নিমেষে যত সচেতন করে, তত অচেতনতার স্বাক্ষর আঁচড়ে আঁচড়ে চলে, যখন দিশেহারা সব উপলব্ধির মধ্যে থাকে দ্বিধা, স্বপ্ন অনিশ্চয়তা। কিন্তু কোথাও অনাত্মীয় কিছুই ঠেকে না। আমি আমার স্বজাত্যের ইশারা পাই সেইখানে। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের কেন্দ্রগামী এবং কেন্দ্ৰাতীত আবর্তনের নাগরদোলায় মহাকাল নিজেই মিথ্যে হয়ে যায়। বিশ্বের রঙ্গমঞ্চে তখন একমাত্র অভিনেতা যেন নির্বস্তকতার প্রবাহ। আমার খােদাই শিলালিপি ভাস্কর্য তার সাক্ষীরূপে দাঁড়িয়ে থাকে। আমার চতুর্দিকে বিরাজমান নানা-মাত্রিক দর্পণের সারি। মনুষ্যত্বের আমল তাঁর সমতলে ভেসে ভেসে ওঠে। সেই অঙ্গরেখা আমারই প্রতিচ্ছায়া।
অথচ বিগত তেইশ বছর এবং তারও পূর্ব দশকে ঝুটো আত্ম পরিচয়-চিহ্নিত, স্বজাত্যবােধহীন আমার আততায়ী মূর্তি কে না দেখেছেন? আদিম প্রবৃত্তির নক্ষত্র আমি, প্রতিবেশীর উপর অকথ্য নির্যাতন মারফৎ হত্যা-উল্লসিত অট্টহাস্যে হেসে উঠেছি। সেই জখমের দাগ আজও কতাে জনপদে নগরে মানবীর দেহে ইতঃক্ষিপ্ত ছড়ানাে রয়েছে। আমি কতাে গৃহদাহ করেছি, তার সংখ্যা গণনা কঠিন। কতাে মা-বােনের ইজ্জৎ লুঠের শরীক আমি তছনছ করেছি বহু শান্তি সুখের আকর, সাগর। আমার হিংস্র ড্রাগন-নিঃশ্বাসে প্রেম প্রীতি প্রেয়বােধ শ্রেয়বােধ পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। সরীসৃপের মত শুধু বর্তমানকে সম্বল করে বাঁচার চেষ্টা পেয়েছি তখন। আমি অন্ধ। কারণ কবন্ধ- যে ক্ষেত্রে চক্ষু থাকার প্রশ্ন অবান্তর। তাই ধর্মের নামে ধর্মান্ধতা ছিল আমার কাছে স্বাভাবিক।
কিন্তু তেইশ বছর পরে যখন আমি বিপন্ন এবং আমার অস্তিত্ব বিলুপ্তির পথে সেই একদা-শত্রু প্রতিবেশী তার সমস্ত অপমান, নির্যাতনের স্মৃতি নিমেষে মুছে ফেলে এগিয়ে এলাে আমার ভস্মীভূত গৃহপ্রাঙ্গণে আমারই পরিবার-পরিজনের ইজ্জৎ আব্র রক্ষার। যে কান থেকে একদিন আমি অকথ্য যন্ত্রণা ছিটিয়ে স্বর্ণালঙ্কার ছিনিয়ে নিয়েছিলাম, সেই কানে আমার বাহিরের আর্তনাদ গিয়ে পৌছল। আমার খােলস খসে যেতে লাগল দুর্বিপাকের হেচকা টানে টানে। আমি দেখতে পেলাম আমার স্বরূপ। আমি জননী বাংলাদেশকে আবিষ্কার করলাম। আমি নিরস্ত্র, অসহায়। কিন্তু বিলম্ব ঘটলে না। শৌর্ষ ত্যাগ নিজ হাতে শত্রু-মােকাবিলার অভীপ্সা সজ্জার আমাকে সাজিয়ে দিলে । শিখ-সন্ত গুরু গােবিন্দ সিংহের ফার্সি কবিতার পংক্তি আমার কণ্ঠে বজ্রনাদ তুললে :
চু কার হামা হিলাতে দূর গুজাস্ত
হালাল আজ বুদা বা শামসীর দাস্ত
সর্ব পথ রুদ্ধ যখন
শ্রেয় হস্তে অস্ত্র গ্রহণ।
কারণ, আমার প্রতিবেশী ছিল। যে আমাকে শুধু আশ্রয় দিয়ে ক্ষ্যান্ত হয়নি, নিজের রক্ত পর্যন্ত ঢেলে দিলে আমার রক্ষাকল্পে। জঘন্য এক জঙ্গীশাহীর দাবানাল যখন আমাকে জন্তুর মত খেদিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল বাংলাদেশের গ্রামগ্রামান্তরে, নগর-জনপদ ভস্মীভূত করে, আমার ঠাই মিলল আমার প্রতিবেশীর বুকে- যেবুকে আমার ছােরার পুরাতন দাগ এখনও চোখে পড়বে। আমি নিরন্ন। প্রতিবেশী তার ভাণ্ডার খুলে দিলে। আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত শুরু হয়েছিল রক্তস্নান মারফৎ। আমি চিনলাম আমার প্রতিবেশীর স্বরূপ। কারণ, পাশাপাশি দাঁড়িয়েছি একই রণক্ষেত্রে। তার মুখ দেখলাম অবিকল আমার মত। অথচ এক দিন মধ্যযুগীয়তার কৃষ্ণপক্ষ আমার কাছে মনে হয়েছিল চন্দন-সৌরভ।
আরাে এক প্রতিবেশীকে দেখলাম। সত্তর কোটি জন-অধ্যুষিত সমাজতন্ত্রী দেশ। তাদের নেতারা তত্ত্বের গর্তে ঢুকলেন। মানুষ তাদের চোখে ঠেকল না। গণহত্যার মত চাচার যেন দৈনন্দিন স্বাভাবিক ব্যাপার। বন্দী শিবির বসনমারফৎ পাছে আত্মহত্যা করে বসে, তাই উলঙ্গ-রক্ষিত ধর্ষিতা রমণীর ফরিয়াদ, আহাজারী তাদের কানে সেঁধােল না এতটুকু। জীবনের অনন্তসবুজ বৃক্ষের দিকে তাদের দৃষ্টি গেল । এইভাবেই আদর্শের অধঃপতন সূচিত হয়। মানুষ তখন সামনে থাকে না সামনে জড়াে হয় শাস্ত্রের খসখসে বুলি এবং তা মার্কসবাদের বুলিও হতে পারে। শুধু তা-ই নয়, সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বাধীনতা-স্পৃহার প্রতি উপহাস হেনে তারা প্রমাণ করলে, মার্কসবাদের আবা-কাবাধারী হলেও তারা বর্ণবিদ্বেষ মুক্ত (রেশিয়াল হেটরেড) নন। সাড়ে সাত কোটি গরু ভেড়া ছাগল বা নিকৃষ্ট শ্রেণীর মানবেতর জীবের দেশ সম্পর্কেই অমন সিদ্ধান্তে আসা যায়। এমন কী, জঙ্গীশাহী টিকে থাকার উদগ্র সংকল্পে যখন চোর গুণ্ডা বদমাশদের হাতে অস্ত্র সঁপে দিয়ে রাজাকার ও ধর্মান্ধ আল-বদর বাহিনী গঠন মারফৎ নিজেদের ঘৃণ্য বীভৎস রূপ প্রকাশ করলে, এবং বিকৃত আকৃতির স্বরূপ সম্পর্কে আর কোন সন্দিহান রাখলে না- তখনও সেই সমাজতন্ত্রী প্রতিবেশী চুপ করে রইল। অন্ধত্বের ভান দৃষ্টিশক্তির সাহায্যে সর্বদা অক্ষম। যদিও নিকট-প্রতিবেশী নয়, তবু আত্মার আত্মীয়-রূপে সােভিয়েট দেশ আমার উদ্ধারকল্পে নৈতিক সমর্থনে এগিয়ে না এলে, মার্কসবাদের মুখ শুধু থুথুতেই ভরে থাকত।
প্রতিবেশীর বুকে আশ্রিত, বিশেষত মহানগরী কলকাতার বুকে আশ্রিত, গত ন’ মাস ধরে ইতিহাসের কল্লোল, বিস্তার-স্পন্দন অনুভব করলাম মর্মে মর্মে। আর বারংবার দেখার সুযােগ পেলাম প্রতিবেশীর মুখ।
জম্ভ হিসেবে মানুষের বাঁচার কতগুলাে শর্ত আছে। তা ন্যূনতম প্রতিপালিত না হলে মানবিক অন্যান্য শ্রেয় দিক আর এগােতে অক্ষম। এমন ক্ষেত্রেও দেখলাম, পঞ্চান্ন কোটির অন্যতম ব্যষ্টিবৃন্দ বুকের কপাট খুলে রেখেছেন। অহােরাত্র, অহর্নিশ। যােদ্ধারও দুদণ্ড বিশ্রাম, আলাপ প্রয়ােজন হয়। নিঃসঙ্গতা লড়ায়ের প্রেরণা নয়। নৈতিক বলের অভাব তেমনই মারাত্মক। কিন্তু সর্বস্তরের মানুষ আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সর্ববিধ হাতিয়ারের ডালা হাতে, যখন যেখানে আমার যা প্রয়ােজন। ব্যক্তিগত কারাে নামােল্লেখ তাঁদের অপমান। কারণ, পঞ্চান্ন কোটি গণ-দেবতার প্রতিনিধি হিসাবে যাদের আত্মপ্রকাশ, তাদের আন্তরিকতা কী পরিমাপ-সাধ্য, না কোন কৃতজ্ঞতার সীমাজালে বন্দী হতে পারে তাদের ব্যক্তিত্ব? তবু মানবিক দুর্বলতায় কতাে জনের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছি বিদায় নিতে। অনেকের কাছে আবার যেতে পারিনি। এখানেও মানবিক দুর্বলতা। দেহের পরিশ্রম-ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। জানি, সামাজিক ক্রটি মনে রাখার মত তারা কেউ নন। নিছক মহানুভবতার তাগিদে যে ভূমিকার সূত্রপাত, সেখানে লৌকিকতার স্থান অতি গৌণ। ভারতবর্ষের সকল নাগরিককে তবু বারংবার নমস্কার।
যুদ্ধে আমার কুচকাওয়াজের রণবাদ্য পর্যন্ত তারাই যুগিয়েছেন, নচেৎ জান-কবুল সংগ্রামের ময়দানে অনুপ্রেরণার এত অনেকান্ত সঞ্জীবনী সুধা আমি কোথায় পেতাম? আমার জাতীয় সঙ্গীতও আমার প্রতিবেশীর দান। আত্মার রাখীবন্ধনের সঙ্গে এই পরম উপহার কে আমাকে দিতে পারত? মহামানবের সাগর-সৈকতে আহ্বানকর্তা ঋষিকল্প সেই সুরস্রষ্টার বাণীর প্রতিধ্বনিই আজ আমার কণ্ঠে নিনাদিত :
মানুষকে গণ্ডীর মধ্যে হারিয়েছি
মিলেছে তার দেখা
দেশ-বিদেশের সকল সীমানা পেরিয়ে।
তাকে বলেছি হাতজোড় করেহে চিরকালের মানুষ,
হে সকল মানুষের মানুষ
পরিত্রাণ করাে
ভেদচিহ্নের তিলক-পরা
সংকীর্ণতার ঔদ্ধতা থেকে।
হে মহান পুরুষ ধনা আমি
দেখেছি তােমাকে
তামসের পরপার হতে
আমি ব্রাত্য, আমি জাতিহারা।- রবীন্দ্রনাথ
আনন্দবাজার : [নির্দিষ্ট তারিখ পাওয়া যায় নি
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ- খন্ড ১৯