দৈনিক পয়গাম
২৪শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯
গুলি ও বেয়োনেটের সম্মুখে বুক পাতিয়া রক্তের বিনিময়ে আমাকে যাহারা মুক্ত করিয়াছে তাহাদের সহিত কখনও বিশ্বাসঘাতকতা করিব না :
মুজিব জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব চাই
(ষ্টাফ রিপোর্টার)
গতকল্য (রবিবার) রাজধানী ঢাকা নগরী ছিল বিশাল রেসকোর্স ময়দানে, কেননা জনতার নেতা শেখ মুজিবের বক্তৃতা শ্রবণের জন্য প্রতিটি নাগরিকই গত কয়দিন ধরিয়া যে গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করিতেছিল, গতকল্য তাহাদের সেই তৃষ্ণা কিছুটা নিবারিত হয়।
বলা বাহুল্য, সুদীর্ঘ তিন বৎসর পর প্রিয় নেতা বক্তৃতার মাঝে নাগরিকগণ তাহাদের আশা-আকাংখা, দাবী দাওয়া ও অভাব অভিযোগেরই সুর প্রতিধ্বনি হইতে শুনিয়াছে।
রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিব উপস্থিত হইয়াছিলেন দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব কর্তৃক আহূত গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করা না করা সম্পর্কে ম্যান্টেট গ্রহণ করিতে, জনতার রায় শ্রবণ করিতে। জনতার রায় প্রদত্ত হইয়াছে তাঁহার বৈঠকে যোগদানের স্বপক্ষে। শেখ মুজিব স্মরণকালের বৃহত্তম শ্রমিক, কৃষান-গণ- ছাত্র সমাবেশে বক্তৃতা দান করিতে উঠিয়া দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করিতেছেন যে, পূর্ব পাকিস্তানীদের যে আস্থা তাঁহার প্রতি রহিয়াছে উহার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা তিনি কোনদিন করিবেন না। তিনি বলেন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের নির্যাতীত জনগণের প্রতিনিধি হিসাবে তিনি বৈঠকে যোগদান করিতে যাইতেছেন; তাহাদের দাবী-দাওয়া সম্মেলনে তুলিয়া ধরাই তাঁহার মহান দায়িত্ব। জনগণের দাবী আদায় করিতে না পারিলে তিনি অবশ্যই সম্মেলন বর্জন করিয়া আসিবেন। লক্ষ লক্ষ লোকের সাগ্রহ দৃষ্টির সম্মুখে তাহাদের “নয়ম মনি” বলিয়া মর্যাদা ভূষিত এবং তাহাদের দ্বারা বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গ-শার্দুল বলিয়া আখ্যায়িত শেখ মুজিব আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, যাহারা আমার মুক্তির জন্য উদ্যত ব্যায়নেট আর নৃশংস বুলেটের সম্মুখে বুক পাতিয়া দিয়াছে, যাহাদের পবিত্র রক্তে আমার ও আমার অন্যান্য সহযোগী বন্ধুদের মুক্তির পথ সুগম হইয়াছে তাহাদের ঋণ আমি কোন দিন শোধ করিতে পারিব না-তাহাদের প্রতি আমি কোন দিনই বিশ্বাসঘাতকতা করিতে পারিব না।
তিনি বলেন, “আমার ছাত্র বন্ধুরা আমাকের প্রশ্ন করে যে, আমি ১১- দফা মানি কি না। তদুত্তরে আমি তাহাদের বলিয়াছি যে, আজ আমার চাইতে খুশী ও সুখী আর কেহই হইতে পারে না। কেননা, যে ৬-দফা দাবী পেশ করিয়া অতীতে আমি শাসকচক্রের কোপ দৃষ্টিতে পড়িয়াছিলাম সেই ছয় দফা সম্পূর্ণরূপে আমার ছাত্র ভাইদের ১১ দফার মধ্যে প্রতিভাত। কাজেই, আমি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করিতে পারি যে, তাহাদের ১১-দফা দাবীর প্রতি আমার পূর্ণ আস্থা ও সমর্থন রহিয়াছে। যতদুর দৃষ্টি যায় ততদুর পর্যন্ত এবং নিকটবর্তী বৃক্ষশীর্ষ ও ক্লাব ভবনগুলির ছাদে (এখানে উল্লেখযোগ্য যে, জনতার ভারে জামখানা ক্লাবের একটি টালির ঘরের ছাদ গতকল্য ভাঙ্গিয়া পড়ে) অপেক্ষমান লক্ষ লক্ষ লোকের গগন বিদারী ধ্বনি এবং সেই সঙ্গে চতুর্দিক হইতে ফুলের পাপড়ির বৃষ্টির মধ্যে শেখ মুজিব গতকালকার এই ঐতিহাসিক জনসভায় ঘোষণা করেন যে, এখন আর সংখ্যা সাম্যের প্রশ্ন নহে, বরঞ্চ জনসংখ্যার ভিত্তিতেই পূর্ব পাকিস্তানের দাবী আদায়ের প্রশ্ন উত্থাপন করিতে হইবে এবং এই মর্মেই নয়া শাসনতন্ত্র এই প্রদেশের প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা থাকিতে হইবে। তিনি বলেন যে, অতীতে সংখ্যা সাম্যের প্রস্তাব মানিয়া লইয়া পূর্ব পাকিস্তানীরা সর্বত্রই ঠকিয়াছে।
তিনি প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত একটি সার্বভৌম পার্লামেন্টকে দেশের আইন প্রণয়নের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী প্রতিষ্ঠানরূপে গঠনের দাবী জানান।
শেখ মুজিবর রহমান অপরাহ্ন ৪.২৩ মিনিটের সময় বক্তৃতা শুরু করেন এবং ৫.১০ মিনিটে শেষ করেন। শেখ সাহেব বক্তৃতা দেওয়ার জন্য দন্ডায়মান হইলে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ তাঁহাকে মাল্যভূষিত করেন। স্বভাবসিদ্ধ গম্ভীর কণ্ঠে শেখ সাহেব ‘আমার বন্ধুরা’ সংগ্রামী ছাত্র বন্ধুরা! আমার ভায়েরা, আমার বোনেরা, আমার মজদুর-কিষাণ ভায়েরা! আমার সংগ্রামী অভিনন্দন গ্রহণ করুন” বলিয়া তাঁহার বক্তৃতা শুরু করেন।
এই বিশাল জনসভায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা জনাব তোফায়েল আহমদ সভাপতিত্ব করেন।
শেখ মুজিব ঘোষণা করেন যে, বর্তমান সরকার জনগণের সব দাবী পূরণ করিয়া লইলে তিনি রাজনীতি হইতে অবসর গ্রহণে প্রস্তুত রহিয়াছেন। সব দাবী পূরণ করিতে যাইয়া প্রয়োজনবোধে যে কোন ত্যাগ স্বীকার করিতে প্রস্তুত রহিয়াছেন।
তিনি স্নেহভরে ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমদের মাথা চাপরাইয়া মৃদু হাসিয়া বলেন যে, যদি পুনরায় আমি জেলে যাই—ইহারাই দুর্বার সংগ্রাম পরিচালনা করিয়া আমাকে মুক্ত করিবে।
শেখ সাহেব বলেন যে, তিনি ন্যাপপ্রধান মওলানা ভাসানীকেও রাজনৈতিক আলোচনায় যোগ দানের জন্য অনুরোধ করিয়াছেন।
তিনি বলেন যে, ছয়-দফার ভিত্তিতে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং পশ্চিম পাকিস্তানে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন সহ সাব-ফেডারেশন গঠনের দাবী জানাইবেন।
শেখ সাহেব পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট বাতিলের প্রশ্নটি জনগণের ভোট দ্বারা মীমাংসা করিবার প্রস্তাব করেন।
তিনি বলেন যে, পাঞ্জাব, সিন্ধু বেলুচিন্তান এবং উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মজলুম ও নির্যাতিত জনগণের প্রতি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অপরিসীম মমতা রহিয়াছে। আমাদের সংগ্রাম শোষণের বিরুদ্ধে এবং সেই শোষকদের সদর দফতর হইতেছে পশ্চিম পাকিস্তানে।
বিচ্ছিন্নতা:
পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হইতে চায় বলিয়া অভিযোগ হাস্যাস্পদ বলিয়া উল্লেখ করিয়া শেখ মুজিব বলেন যে, পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ ভাগ অধিবাসী অধ্যুষিত পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ কেন বিচ্ছিন্ন হইবে। কাহারও ভাল না লাগলে তাহারা আমাদের নিকট হইতে বিদায় লইতে পারে।
শেখ মুজিব তাঁহার ৬ দফা দাবী বিশ্লেষণ করিয়া বলেন যে, ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর যুদ্ধের অভিজ্ঞতায় তিনি বুঝিতে পারিয়াছেন যে, প্রদেশের সকল সমস্যার একমাত্র সমাধান হইতেছে সকল পর্যায়ের পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন এবং সকল ক্ষেত্রে স্বয়ং সম্পূর্ণতা।
শেখ মুজিব তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে ইহার পর হইতে ইসলামাবাদ ষড়যন্ত্র মামলা বলিয়া অভিহিত করিবার জন্য জনগণকে অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, আমি ষড়যন্ত্রে বিশ্বাসী নই। কোনরূপ ভয়ভীতি দ্বারা আমাকে দমান যাইবে না। এক আল্লাহ ছাড়া আর কাহারও কাছে আমি আমার মস্তক অবনত করিব না। শেখ মুজিব বলেন, দীর্ঘ দিনেও এই দেশের ছাত্র, কৃষক, মধ্যবিত্ত, শ্রমিকসহ নির্যাতিত জনতা তাহাদের অধিকার পায় নাই। জালেমের পর জালেম এই দেশের শাসন ক্ষমতায় আসিয়াছে। কিন্তু জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন কিছুই হয় নাই।
তিনি সাম্প্রতিক গণআন্দোলনে নিহত ও আহতদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ করিয়া বলেন যে, আমি আমার দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনেও সাম্প্রতিক আন্দোলনের মত এত প্রচণ্ড গণঅভ্যুত্থানের কথা শুনি নাই। জাতি এক ইতিহাস সৃষ্টি করিয়াছে। আন্দোলনের মাধ্যমে দুই প্রদেশের জনগণ একে অপরকে হৃদয়ের অনেক কাছাকাছি পৌঁছিতে সমর্থ হইয়াছে।
তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের বেসামরিক এবং সামরিক চাকরীতে পূর্ব পাকিস্তানীদের সংখ্যাস্বল্পতার বিষয়ে উল্লেখ করিয়া সরকারি নীতির তীব্র সমালোচনা করেন।
ছয় দফা ও ১১ দফা
আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিব ছাত্রদের ১১ দফার প্রতি পূর্ণ সমর্থন প্রকাশ করিয়া বলেন যে, আমার ছয় দফাও এই ১১ দফায় স্থান পাইয়াছে। ১১ দফার জন্য আমি সক্রিয় আন্দোলন চালাইব।
প্রেস ট্রাষ্ট
তিনি সাংবাদিক নির্যাতন এবং সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধের তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি প্রেস ট্রাষ্টকে “সরকারি চিপাকল” বলিয়া উল্লেখ করেন।
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করিয়া তিনি বলেন যে, আমাদের সংগ্রাম সমগ্র জাতির জন্য কোন গোষ্ঠীর জন্য নয়।
রিলিফ কমিটি
শেখ সাহেব সাম্প্রতিক গণআন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে নিহত ও আহত ব্যক্তিদের পরিবার পরিজনদের সাহায্যের জন্য একটি সাহায্য কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেন। এই তহবিলের জন্য আমরা প্রত্যেকেই চাঁদা সংগ্রহ করিব। তাহাদের সাহায্য করা আমাদের কর্তব্য। তিনি বলেন যে, সরকারকে অবশ্যই এইসব ব্যক্তিদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হইবে।
কমিশন
তিনি পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর গুলিবর্ষণ সম্পর্কে তদন্তের জন্য উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বিচার বিভাগীয় কমিশন নিয়োগের দাবী জানান। তিনি এই সময় অন্যায়ভাবে ক্ষমতার অপব্যবহারকারীদের উপযুক্ত শাস্তি বিধানেরও দাবী জানান।
তিনি সার্জেন্ট জহুরুল হক, ডঃ জোহা এবং আসাদুজ্জামানসহ অনেক মূল্যবান জীবনকে হত্যার তীব্র নিন্দা করেন এবং বলেন আমাদের সহ্যের সীমা আছে।
হুলিয়া
তিনি রাজনৈতিক কর্মীদের উপর হইতে অবিলম্বে হুলিয়া ও রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারের দাবী জানান।
স্বায়ত্তশাসন
শেখ সাহেব পশ্চিম পাকিস্তানীদের পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবীর প্রতি সমর্থনের অনুরোধ জানান। আমাদের দাবীর প্রতি সমর্থন জানাইলে আমিও তাহাদের দাবী আদায়ের সংগ্রামে শরীক হইব।
গভর্ণর
শেখ মুজিবর রহমান সুতীব্র ও কঠোর ভাষায় প্রাদেশিক গভর্ণর মোনয়েম খানের সমালোচনা করেন।
সুত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: পঞ্চম খণ্ড ॥ ষাটের দশক ॥ চতুর্থ পর্ব ॥ ১৯৬৯