You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.10.30 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | কিসিঞ্জারের বাংলাদেশ সফর | ঢাকা-উত্তরাঞ্চল যোগাযোগ | তোতা পাখীর বুলি | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা : ৩০শে অক্টোবর, বুধবার, ১৯৭৪, ১২ই কার্ত্তিক, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ

কিসিঞ্জারের বাংলাদেশ সফর

কিসিঞ্জার আসছেন। আজ তাঁর ঢাকা পৌঁছাবার কথা। উপমহাদেশ সফরের দ্বিতীয় পর্যায়ে তিনি আজ বঙ্গবন্ধু সহ বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন। যতদূর জানা গেছে, হেনরী কিসিঞ্জারের সঙ্গে আমাদের নেতৃবৃন্দের আলোচনায় দু’দেশের সম্পর্ক, মার্কিনী সাহায্য এবং উপমহাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা বিশেষ গুরুত্ব লাভ করবে।
সেপ্টেম্বরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্টের আলোচনার সূত্র ধরেই আজকের আলাপ-আলোচনা অগ্রসর হবে বলে তথ্যাভিজ্ঞ মহলের ধারণা। স্বাধীনতা সংগ্রামকালে বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্কের অবনতি সূচিত হয়েছিল। বাংলাদেশের জনগণের মনে তাদের ন্যায্য সংগ্রামে মার্কিন বিরোধিতা স্বাভাবিকভাবেই বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। মার্কিন প্রশাসনের কিছু প্রভাবশালী কর্মকর্তার বাংলাদেশ সফরের পর সেই অবনতিশীল সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটতে থাকে।
বাংলাদেশের জাতিসংঘে প্রবেশের পটভূমিকায় কারো প্রতি বৈরীতার নীতি অনুসরণ আমাদের পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য নয়। বরং সবার সঙ্গে বন্ধুত্বই আমাদের কাম্য। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে মার্কিনী প্রশাসনের মনোভাব যাই থাকুক না কেন সেখানকার জনসাধারণ আমাদের ন্যায্য অধিকারের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিল। সেজন্য আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। মার্কিনী প্রশাসনও সেদিনেই সেই ভ্রান্ত নীতি উপলব্ধি করতে পেরে অবশেষে আমাদের স্বাধীন সত্তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
আর দশটি দেশের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের সঙ্গেও আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠুক এটা আমাদের পররাষ্ট্রনীতির ঘোষিত লক্ষ্য। আজকের যুগে কেউ কারো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, স্থায়ী বৈরীতার মনোভাব নিয়ে চলতে পারেনা। নতুন বন্ধুদের জন্য পুরাতন মিত্রদের ত্যাগ করার প্রশ্নও আসে না। সবার সহযোগিতা এবং সৎ সম্পর্কের মাধ্যমেই আমরা একটা উন্নত এবং সমৃদ্ধিশালী সমাজ গড়ে তুলতে পারি। এদিক থেকে বঙ্গবন্ধুর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরের পর দু’দেশের সম্পর্কের বাস্তব মূল্যায়নের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
যুদ্ধ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রায় ভেঙে পড়া আমাদের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তোলার জন্য প্রয়োজন রয়েছে বিদেশী এবং আন্তর্জাতিক সাহায্যের। বর্তমান দুর্ভিক্ষাবস্থা মোকাবেলা করার জন্য যেমন প্রয়োজন ত্বড়িৎ খাদ্যশস্য তেমনি দেশের উন্নয়ন তথা শিল্পায়নের জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী ঋণ এবং লগ্নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি বাংলাদেশের দিকে তার বন্ধুত্বপূর্ণ হস্ত আন্তরিকভাবেই সম্প্রসারিত করতে চায় তবে তাকে অবশ্যই উন্নয়নশীল দেশের এই বাস্তব চাহিদার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতে তাকে এ সকল দেশের সমস্যা অনুধাবন করতে শিখতে হবে। দুনিয়ার মোড়লী করার বদখেয়াল ত্যাগ করতে হবে। সাম্রাজ্যবাদের সেই আত্মিক আগ্রাসী প্রবণতা সে ত্যাগ করতে পারবে কি?
কিসিঞ্জার আসছেন। তার এই সফর বাংলাদেশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাস্তব অগ্রযাত্রার সূচনা করবে বলে মার্কিনীদের মতো আমাদেরও বিশ্বাস। কিন্তু একটা বিষয় উল্লেখ না করে আমরা পারছি না। ডঃ হেনরী কিসিঞ্জার শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হলে হয়তো কথাটা উঠতো না। কিন্তু তিনি কুখ্যাত ‘কমিটি অব ফরটির’ও চেয়ারম্যান। চিলিতে আলেন্দে সরকারকে উৎখাতের ব্যাপারে এই কমিটির ভূমিকা এমনকি মার্কিন প্রশাসনও অস্বীকার করতে পারেননি। দেশে দেশে সি.আই.এ-র গোপন দস্যুবৃত্তির চূড়ান্ত অনুমোদন এই কমিটিই দান করে থাকে। মিঃ কিসিঞ্জার মার্কিন প্রশাসনের পছন্দ নয় এমন কোনো সরকারকে উৎখাত করায় খারাপ কিছু দেখেন না। এমতাবস্থায় যে মার্কিন প্রশাসনের বিরোধিতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধুর অভ্যুদয় তারা ‘মুজিব সরকার’কে কতটুকু পছন্দ করবে তা স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহের সৃষ্টি করে। মিঃ কিসিঞ্জার কি এ ব্যাপারে তার সরকারের মনোভাব সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করবেন? বলাবাহুল্য বন্ধুত্ব পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং আন্তরিকতার ভিত্তিতেই কেবল গড়ে উঠতে পারে।

ঢাকা-উত্তরাঞ্চল যোগাযোগ

উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থা চূড়ান্ত রকমে বেসামাল। বিশেষ করে দেশের উত্তর ও পশ্চিম অঞ্চলের দু’টি বিভাগের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও শিল্প বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র রাজশাহীর সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা মর্মান্তিক। রেল, সড়ক বা বিমান কোনো পথেই ঢাকা-রাজশাহীর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ নেই।
রেলপথে অনেক ঘুরে যমুনা নদী পার হয়ে আবার অনেক ঘোরা পথে ঢাকা থেকে রাজশাহী পৌঁছুতে সময় লাগে ২৪ থেকে ২৮ ঘন্টা। সড়ক পথের দূরত্ব যদিও ১৬৮ মাইলের মতো, কিন্তু তবু ফেরী পারাপারের অসুবিধার জন্য ঢাকা-রাজশাহী যাতায়াত করতে নিজস্ব গাড়ীতেও পুরো একটি দিন লেগে যায়। আকাশ পথে ঢাকা-রাজশাহী সরাসরি যোগাযোগ নেই। ঢাকা থেকে বিমানে ঈশ্বরদী নেমে তারপর রাজশাহী যেতে হয় দুই উপায়ে। প্রথমতঃ সড়ক পথে—যার দূরত্ব প্রায় ৬৮ মাইল, যানবাহনের মাধ্যম হিসেবে থাকে বাস ও বেবী ট্যাক্সি। দ্বিতীয়তঃ রেলপথ—যার দূরত্ব প্রায় ৪২ মাইল। রেলের সময় নিশ্চয়তা নেই বলে সে পথেও ‍দুর্ভোগের শেষ থাকে না।
অর্থাৎ যে কোনো উপায়েই হোক না কেন—ঢাকা থেকে রাজশাহী যেতে বা রাজশাহী থেকে ঢাকা আসতে একটি দিনের ধাক্কা। অথচ সড়ক পথে এই দূরত্ব অতিক্রম করা উচিত চিল পাঁচ বা ছয় ঘন্টায় এবং বিমান পথে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ মিনিটে। অর্থাৎ একই দিনে ঢাকা-রাজশাহী এবং রাজশাহী-ঢাকা অনায়াসে আসা-যাওয়া করার কথা। কিন্তু দুঃখের বিষয় এ যাবত যোগাযোগ ব্যবস্থার অতটা উন্নতি করা সম্ভব হয়নি।
সড়ক পথের দূরত্ব কমানোর জন্য বিশেষজ্ঞ মহলের কিছু প্রস্তাব ছিল—যা বাস্তবায়িত করলে রাজশাহী-ঈশ্বরদীর সড়ক দূরত্ব ৬৮ মাইলের পরিবর্তে ৩৮ মাইল দাঁড়াতো, তাও কার্যকরী করা হয়নি। রাজশাহী ও ঈশ্বরদী বিমান বন্দরের দূরত্ব কমানোর জন্য একেবারে নতুন সড়কও তৈরীর প্রয়োজন নেই। মাত্র ১০ মাইল নতুন সড়ক নির্মাণ পরিকল্পনা, জেলা বোর্ডের সড়ক সংস্কার, একটি সেতু এবং কয়েকটি কালভার্ট নির্মাণ করলেই রাজশাহী ও ঈশ্বরদী বিমান বন্দরের দূরত্ব প্রায় অর্ধেক কমে যেতে পারে। এতে খরচের আনুমানিক পরিমাণ এক কোটি টাকা। পরিতাপের বিষয় এই যে, সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও মাত্র এক কোটি টাকার জন্য যাত্রীসাধারণের কষ্ট আর ঘুচছে না। ঢাকা-আরিচা পথে বাস্তব অসুবিধা আছে। সেতুগুলো তৈরী হচ্ছে। কিন্তু ঈশ্বরদী-রাজশাহীর সড়ক দূরত্ব কমানোর চেষ্টা না করা অযৌক্তিক।
ঢাকা-রাজশাহী সরাসরি বিমান পথ চালু করার জন্য নওহাটাতে একটি বড় আকারের বিমান বন্দর নির্মাণের কাজ চলছিল। স্বাধীনতার আগে তাতে বেশ কিছু টাকাও ঢালা হয়েছিল। স্বাধীনতার পরে সেটির কাজ শেষ করে ঢাকা-রাজশাহীর মধ্যে সরাসরি বিমান পথ চালু করা যেতো। তাও হয়ে উঠেনি। স্বাধীনতার আগে একবার ঢাকা-রাজশাহী হেলিকপ্টার সার্ভিস চালু হয়েছিল—তাও বেশি দিন চলেনি। এবং যতদূর জানা যায়, এ পর্যন্ত ঢাকা-রাজশাহীর মধ্যে বিমান পথ খোলার আর কোনো বাস্তব পরিকল্পনা হাতে নেয়াই হয়নি। সে দিকটাও সংশ্লিষ্ট মহলের চিন্তা করা উচিত নয় কি?
আমরা জানি, রাজশাহীতে গ্রীষ্মকালীন ফল বিশেষভাবে আম, জাম, লিচু পর্যাপ্ত হয়। কিন্তু পরিবহনের অভাব এবং দুরবস্থার জন্য তা যথাসময়ে রাজধানীতে পৌঁছুতে পারে না। ফলে সুলভে প্রাপ্তব্য ফলমূল পচে গেলেও তা জনগণের মুখে উঠে না। ফলে তা যে শুধু স্থানীয় ব্যবসায়িক ক্ষতি তাই নয়—এটা জাতীয় অপচয় ব্যবস্থাই সে জন্য দায়ী। আর এ কথাও সত্য যে, জাতীয় অর্থনীতির মঙ্গল কামনা করলে দেশের প্রতিটি অঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থাকে করতে হবে প্রত্যক্ষ এবং দ্রুত। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ব্যবসায়িক এবং আকস্মিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যই তা অপরিহার্য।
পরিশেষে, রাজধানীর সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের সড়ক যোগাযোগের আশু সুবন্দোবস্ত করা হোক এবং দেশের প্রতিটি অঞ্চলের সঙ্গেই রাজধানীর সরাসরি দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করে জনজীবনের ভোগান্তি বিনাশ ও জাতীয় উন্নতির সোপান প্রতিষ্ঠা করা হোক—সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রতি এ-ই আমাদের জোর দাবী।

তোতা পাখীর বুলি

তোতা হচ্ছে সেই জাতীয় পাখী, যে কখনো নিজে থেকে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে কিছু বলে না। তোতা পাখীকে যা শেখানো হবে, তা-ই সে বলবে। শেখানো বুলি আওড়ানোর ব্যাপারে তোতা পাখীর জুড়ি মেলা ভার। দুষ্টু ছেলেদের শেখানো বুলি আওড়াতে গিয়ে ক’দিন আগে বৃটেনের বোলচেষ্টার চিড়িয়াখানার তোতা পাখী এক মজার কান্ড ঘটিয়েছে। কতিপয় স্কুল-পড়ুয়া তরুণী তাদের শিক্ষকের সঙ্গে চিড়িয়াখানায় রকমারী জীবজন্তু দেখার পর যখন তোতা পাখীর খাঁচার সামনে দাঁড়ালো, তখন কয়েক সেকেন্ড যেতে না যেতেই বজ্জাত পাখীগুলো কলকন্ঠ হলো। তোতা পাখীর বুলি শুনে তরুণীরা লজ্জায় রক্তিম হয়ে ছুটে পালিয়ে হাঁফ ছাড়লো। মেয়েদের পালিয়ে যাওয়ার কারণ অবশ্য পরে জানা গেল। তোতা পাখীগুলো নাকি শিখিয়ে দেয়া বুলিতে অশ্লীল ভাষায় তরুণীদের অভ্যর্থনা জানায়। প্রথমাবস্থায় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ তোতা পাখীগুলোর এহেন অপ্রত্যাশিত আচরণের হেতু খুঁজে পায় না। পরে অবশ্য আবিষ্কৃত হয় যে, পার্শ্ববর্তী একটি ছেলেদের স্কুলের ছাত্ররা এসে পাখীগুলোকে এইসব অনভিপ্রেত বুলি শিখিয়ে গেছে। সঙ্গত কারণেই মেয়ে স্কুলের শিক্ষকরা এহেন নাজকু পরিস্থিতিতে ভীষণ নাখোশ হয়েছেন। তোতা পাখী, আমরা জানি, সব সময়ই অন্যের শেখানো বুলি আওড়াতে ওস্তাদ। তারা তা-ই মিষ্টি বুলি মনে করে আওড়িয়েছে। তোতা পাখীর যদি ফাঁস-বেফাঁস জ্ঞান টনটনে থাকতো, তাহলে হয়তো এ ধরনের বুলি ওরা উচ্চারণই করতো না। তাই দোষ তোতা পাখীদের নয়। সমস্ত অনিষ্টের মূলেই ঐ দুষ্টু ছেলেরা।
যাই হোক, চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ। কারণ, তারা তোতা পাখীগুলোকে তড়িঘড়ি শালীন ও সুন্দর বুলি শেখানোর জন্য একজন নতুন শিক্ষিকা নিয়োগ করেছেন। এতে আশা করা যায়, নিকট-ভবিষ্যতে এই চিড়িয়াখার বন্দী তোতা পাখীগুলোর বোল চালে পরিবর্তন সাধিত হবে এবং তখন হয়তো আর তোতা পাখীর বুলি শুনে তরুণীদের লজ্জারাঙ্গা হয়ে ছুটে পালাতে হবে না। তোতা পাখীগুলো মিষ্টি-মধুর বুলি দিয়েই মেয়েদের অভ্যর্থনা জানাবে এটাই সবার প্রত্যাশা।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন