বাংলার বাণী
১১ই আগস্ট, শনিবার, ১৯৭৩, ২৬শে শ্রাবণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
শিক্ষক ধর্মঘট অব্যাহত
বেসরকারী মাধ্যমিক শিক্ষকরা ধর্মঘট শুরু করেছিলেন ৬ই জুলাই। আজও সে ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়নি। সরকার প্রেসনোট দিয়ে অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। এদিকে এসএসসি পরীক্ষা শুরু হবার নির্ধারিত ছিল ছিলো ১৬ই আগস্ট। সব কিছু মিলিয়ে কেমন একটা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। শিক্ষকরা দাবী জানাচ্ছেন, সরকার নীতিগতভাবে সে দাবী মেনে নিয়েছেন বলে জানাচ্ছেন। সরকার বলছেন নীতিগতভাবে সরকার দাবীগুলো মেনে নিলেও এর বাস্তবায়নে সময়ের প্রয়োজন। শিক্ষকরা সে বাস্তব অবস্থাও উপলব্ধি করছেন, বলছেন সেটাও আমরা বুঝি। সব কিছু মেনে নেয়ার পরও স্কুলের তালা খুলছেনা। ছাত্ররা শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছেনা।
এটাই সবচাইতে দুঃখজনক ঘটনা। সরকারের আশ্বাসে শিক্ষকরা আশ্বস্ত হতে পারছেন না। তারা বলছেন তাদের দাবী-দাওয়া পূরণে কি ব্যবস্থা, কি কি কর্মসূচী গৃহীত হচ্ছে তা তাদের জানতে দিতে হবে, তাদের সাথে আলোচনা করেই সে সকল কর্মসূচী প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে হাত দিতে হবে। এতদিন প্রায় নির্লিপ্ত থাকার পর সরকারও নাকি এ পথে এক-পা দু-পা করে এগিয়ে আসছেন।
আমরা বক্তব্য রেখেছি এই ধর্মঘট শুরু হবার কাল থেকেই। বলেছি সরকারকে আলোচনায় বসতে। বাংলাদেশের এই শিক্ষক সম্প্রদায় আমাদের সংগ্রামের সাথী হিসাবে দীর্ঘদিন নির্যাতন সহ্য করেছেন। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের ছিলো গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। স্বাধীনতাত্তোরকালে দেশের সার্বিক পুনর্গঠন এবং সমৃদ্ধির কাজে তাদের যত সুন্দরভাবে লাগানো যেতো তা হয়নি। এখন ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার বিলোপ সাধনে যখন তারা দাবী তুলেছেন এবং সরকার নিজেও যখন সে দাবীর প্রতি নীতিগতভাবে একাত্মতা ঘোষণা করছেন তখন তাদের সঙ্গে খোলা-দিলে সরাসরিভাবে আলোচনায় বসতে অসুবিধেটা কি আমরা বুঝতে পারিনা।
এমনিতেই অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে ইতিমধ্যেই যে ক্ষতি সাধিত হয়েছে তা পূরণ করা সম্ভব নয়। সংশ্লিষ্ট সকলে সত্যিকার আন্তরিকতার সঙ্গে অগ্রসর হলে অন্ততঃ ভবিষ্যত ক্ষতি থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের রক্ষা করা যেতে পারে। কাবাবে হাড্ডি হয়ে যারা অনর্থক ‘ইস্যুটাকে’ জটিল করে তুলছেন তারা দয়া করে কি একবার এদিকটা ভেবে দেখবেন?
যমুনার উপর সেতু নির্মাণ
যমুনা নদীর উপর সেতু নির্মাণকল্পে নিযুক্ত জাপানী বিশেষজ্ঞ দলটি গত বৃহস্পতিবার যোগাযোগমন্ত্রীর কাছে তাদের প্রাথমিক জরিপের রিপোর্ট পেশ করেছেন। এই রিপোর্ট পেশকালে বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানী রাষ্ট্রদূতও উপস্থিত ছিলেন। যোগাযোগমন্ত্রী সেতু নির্মাণের ব্যাপারটি ত্বরান্বিত করার জন্যে জাপানী বিশেষজ্ঞ দলটির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। আর তাঁর আহ্বানের জবাবে জাপানী রাষ্ট্রদূত বলেছেন, যমুনার উপর সেতু নির্মাণের ব্যাপারে জাপান সরকার এবং জাপানী বিশেষজ্ঞরা বেশ আগ্রহী। তাই নদী ও সেতু সংক্রান্ত তাঁদের দেশের সেরা সেরা ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়ে এই বিশেষজ্ঞ দলটি গঠিত হয়েছে এবং জাপান সরকারের সার্বিক সহানুভূতি নিয়েই এই দলটি তাঁদের কাজ চালিয়ে যাবেন।
বস্তুতঃ যমুনার উপর সেতু নির্মাণ বাংলাদেশের জনগণের বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের জনগণের একটি অতি পুরনো এবং অন্যতম প্রধান দাবী। কেননা এই সেতু নির্মাণের উপরই অনেকাংশে নির্ভর করছে উত্তরাঞ্চলের সামগ্রিক উন্নয়ন। উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা—মালপত্র পরিবহন থেকে শুরু করে রাজধানী ঢাকা নগরী সহ দেশের দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলের সাথে দৈনন্দিন সামান্যতম যোগসূত্র রক্ষা করতে হলেও এই সেতুর প্রয়োজনীয়তা যে কত বেশী তা উত্তরাঞ্চলের জনগণ তো বটেই সারাদেশর মানুষও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারেন। উপলব্ধি করতে পারেন এই সেতু ছাড়া সারাদেশের উন্নয়ন কর্মসূচীও সার্বিক বাস্তবায়িত হবেনা—হতে পারেনা। সেহেতু যমুনার উপর সেতু নির্মাণ তাই আজ উত্তরাঞ্চলে প্রাণ সঞ্চারণেরই শামিল।
পাকিস্তানী উপনিবেশবাদী ও শোষণবাদী আমলে অথচ এ বিরাট গুরুত্বপূর্ণ দিকটির প্রতি বার বারই অবহেলা প্রদর্শন করা হয়েছে। পাকিস্তানী আমলে প্রণীত চারটি পাঁচসালা পরিকল্পনার মধ্যে প্রথম তিনটিতে এর নামোল্লেখ পর্যন্ত করা হয়নি—তথাকথিত চতুর্থ পরিকল্পনায় এটার প্রয়োজনীয়তাকেই স্বীকার করা হয়েছিলো মাত্র। ব্যস আর কিছু নয়।
দেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠিত সরকার যমুনার উপর সেতু নির্মাণকল্পে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। উল্লেখযোগ্য যে, দেশ স্বাধীন হবার আগেও বঙ্গবন্ধু তাঁর বহু জনসভায় ভাষণদানকালে এই সেতু নির্মাণের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।
বাংলাদেশের প্রথম বাজেটে যমুনার উপর সেতু নির্মাণের ব্যাপারে জরিপ রিপোর্ট প্রণয়নকল্পে প্রথম অর্থ বরাদ্দ করা হয়। তারপরই সরকার জাপান সরকারের সহযোগিতা লাভ করতে সমর্থ হন। বাংলাদেশের অন্যতম বিশিষ্ট বন্ধুরাষ্ট্র জাপান বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম প্রধান অন্তরায় এই যমুনা নদীকে জয় করার জন্য এগিয়ে এসেছেন। দেশের দ্বিতীয় বাজেটে এবং বার্ষিক পরিকল্পনা কর্মসূচীতে যমুনার উপর সেতু নির্মাণ প্রকল্পটি যথার্থ গুরুত্বের সাথে স্থান পেয়েছে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক