বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ৫ই আগস্ট, সোমবার, ১৯শে শ্রাবণ, ১৩৮১
ও কিছু নয়— মাত্র কয়েকটি পাওয়ার পাম্প
সর্বগ্রাসী বন্যার অবর্ণনীয়প্রায় অবস্থার সংবাদের পাশাপাশি যে দু’একটি ক্ষয়ক্ষতির খবর আমরা প্রতিবেদনের মারফতে পাই তা বড়ই দুঃখেরও লজ্জার। সম্প্রতি পত্রিকান্তরে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে যে, কাউখালী থানা বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন অফিস সংলগ্ন গোডাউন সমস্ত মাঠের মধ্যে খোলা আকাশের নিচে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত ৯২ টি পাওয়ার পাম্প গত এক বছর ধরে অবহেলায় আজও পড়ে আছে।
প্রতিবেদন সূত্র আরো জানায় যে, এসব মেশিনের প্রতিটির বর্তমান আনুমানিক দাম প্রায় ২২ হাজার টাকা। যদি প্রতিটি মেশিনের ২০ হাজার টাকা দাম ও ধরা যায় তাহলে ৯২টি পাওয়ার পাম্প এর দাম তার আছে ১৮ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা। খোলা আকাশের নিচে পড়ে থেকে থেকে মেশিন গুলো বিবর্ণ হয়েছে এবং কিছু কিছু বিকল হয়ে গেছে। এবং দু-তিন বছর এই অবস্থায় পড়ে থাকলে পাওয়ারপাফ গুলো সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে যাবে। এই স্বতঃসিদ্ধ সত্যকে চোখের উপর দেখেও কোন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক দপ্তরে যোগাযোগ করে নিদেনপক্ষে মেশিন গুলোকে রোদ বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ত্রিপল দিয়ে ঢেকে রাখা বা টিনের চালা করে এগুলোকে রক্ষার ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে কর্পোরেশনের জানান যে, টিনের ছাপড়া বা ত্রিপলের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লেখালেখি করে তাঁরা কোনো ফল পাননি। অর্থাৎ ভাবখানা এই যে-যার বিয়ে তার হুশ নেই, পাড়াপড়শির ঘুম নেই। অথচ আমরা জানি দেশের খাদ্য সমস্যা মোকাবেলার জন্য সবুজ বিপ্লবের ভূমিকা কত গুরুত্বপূর্ণ এবং তা দেশ ও জাতির জীবন-মরনের প্রশ্নের অঙ্গীভূত! প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয় তাদের নিত্যসঙ্গী, তাদের জন্য সামনের পথ বড় কঙ্করাকীর্ণ। তাই প্রতিটি ক্ষেত্রে যথেষ্ট সততা, কর্মনিষ্ঠা আর দূরদৃষ্টি রেখে আমাদের কাজ করা উচিত। কিন্তু তার পরিবর্তে দেখা যায় নিজেদের কাজে আমরা উদাসীন ও দায়িত্বজ্ঞানহীন। ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির প্রশ্নে চূড়ান্তভাবে অদূরদৃষ্টি সম্পন্ন এবং অজ্ঞ! যেন নিজের ভালো মন্দ বোঝার বয়স বা অভিজ্ঞতা আমাদের নেই। কি লজ্জা! যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের সর্বত্রই ক্ষতচিহ্ন। ধ্বংস, শোষণ, পীড়ন, অবদমন, অনুগ্রহের স্পর্শ কাতর ব্যথা নিয়ে দেশ স্বাধীন হলো। তার পরের কাজ ছিল আরও কঠিন। ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগের চেয়েও কঠিনতর। সামনে ছিল দেশ গঠন ও রক্ষার দায়িত্ব। এবং সেই পথে সমৃদ্ধির সোপান উত্তরণের আবশ্যিক তাগিদ। তাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে কর্মপ্রেরণা, নিষ্ঠা, শ্রম, দেশ প্রেম ও জাতির কল্যাণ কামনায় রক্ষাকবচ করে পথচলার দায়িত্ব পড়েছিল আমাদের প্রত্যেকেরই কাঁধে। কিন্তু সেখানে আমরা কি করেছি?
যেদিকেই চাওয়া যায় সেখানে আজ অর্বাচীন কর্মের স্বাক্ষর। যে কোন প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে অন্তরায় এবং তারও পরে লজ্জা বা অনুশোচনার পরিবর্তে কৈফিয়ৎ দানের প্রাণান্ত হাস্যকর প্রচেষ্টা। ৯২টি পাওয়ার পাম্পের দুর্গতি একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এরকম শত শত অনাচার, নৈরাজ্য, দুর্নীতি, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা এবং উদাসীন্যে নজিরে দেশটা আজ পূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রশ্ন জাগে কোন দিক থেকে শুদ্ধি অভিযান চালানো যায়?
দেশে এখন প্রশাসনযন্ত্রকে ত্রুটিমুক্ত করনের কাজ চলছে। অক্ষম কর্মচারী তথা সমাজ ও দেশের শত্রুদের কে দায়িত্বপূর্ণ পদে থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এই কি যথেষ্ট? কারণ প্রশাসনযন্ত্রকে বাস্তবিক অর্থে ত্রুটি মুক্ত করতে হলে শুধু চেয়ার বদল করলেই কার্যসিদ্ধি হবে বলে আমাদের মনে হয় না। তারপরের অধ্যায়ের সমাজের শত্রুদের জন্য শাস্তির বিধান গুলোকে আইনের বর্মে আরো কঠোর করা হয়েছে তাকে বাস্তবায়িত করে দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যক্তিদের মনে ত্রাসের সঞ্চার করা হোক। সবুজ বিপ্লব প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে বহু ঘাপলা রয়েছে-এ প্রতিবেদন ভিত্তিক তথ্য। অতএব সেদিকে সংশ্লিষ্ট মহলের তীক্ষ্ণ নজর পতিত হোক। নৈরাজ্যের অসহ্য আবর্ত থেকে বেরিয়ে এসে খোলা হাওয়ায় আমরা একটু বুক ভরে নিঃশ্বাস নেই।
দুর্গত এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা
ধীরে ধীরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট ও নোয়াখালীর সড়কপথে ঢাকার যোগাযোগ ইতিমধ্যেই বিনষ্ট হয়েছে। এবার উত্তরবঙ্গের পালা। ঢাকাস্থ ‘রোডস্ এন্ড হাইওয়েজ’-এর রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, পাবনা-নগরবাড়ী সড়ক যোগাযোগ যেকোনো সময় বাতিল করা হতে পারে। ফিল্ড অফিসার রা তাদের কাজে সর্বশেষ যে রিপোর্ট দিয়েছে তার উপর ভিত্তি করেই ‘রোডস এন্ড হাইওয়েজের’ এই ঘোষণা।
রেল যদিও চলছে কিন্তু বন্যার বহু পূর্বেই কয়লা এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির এভাবে তার সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। অথচ বন্যার এই ভয়াবহ দিনগুলোতে বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা অপরিহার্য। এ শুধু ঢাকার সঙ্গে বিভিন্ন জেলার এই নয়, বিভিন্ন জেলা সদরের জেলার অভ্যন্তরে এলাকাসমূহের যোগাযোগ রাখারও সমস্যা।
বন্যা দুর্গতদের প্রাথমিক সমস্যা মোকাবেলার জন্য প্রয়োজন তাদের মধ্যে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ। জলবেষ্টিত হয়ে যারা বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন স্থানে আটকে আছে তাদের সরিয়ে আনতে হবে শিবিরে অথবা নিরাপদ স্থানে। বর্তমান অবস্থায় নৌযানেই বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করার কাজে সবচাইতে সহজ ভাবে ব্যবহৃত হতে পারত। কিন্তু কই সে নৌযান? অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল বিভাগের অধীনে নদীপথে চলাচলের জন্য রয়েছে মাত্র ১৩টি যাত্রীবাহী জাহাজ, ১৩টি ফেরি ও ৮টি স্বয়ংক্রিয় মালবাহী বার্জ। বন্যা দুর্গত এলাকায় যদি এর সবকটিই কাজে লাগানো যায় তবুও তা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত স্বল্প বলে বিবেচিত হবে।
যোগাযোগের অভাবে যে ত্রাণ কাজেই বিঘ্ন ঘটবে তাই নয় বিভিন্ন অঞ্চল সমূহের দ্রব্যসামগ্রীর অব্যাহত সরবরাহ না থাকায় জিনিসের দাম বাড়বে, বাড়বে মানুষের দুর্ভোগ। গত পরশু গণভবনে বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে বন্যা মোকাবেলায় যুদ্ধকালীন জরুরী ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ওই সিদ্ধান্তে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে দুর্গত এলাকায় খাদ্যশস্য ও সরবরাহ নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে যথাযথ যানবাহনের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আমরা মনে করি কিছুদিনের জন্য ব্যক্তিমালিকানাধীন যাত্রীবাহী লঞ্চ, সি ট্রাক, আভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন সংস্থার যানবাহনসমূহ প্রভৃতি সরকার দুর্গত এলাকায় যোগাযোগ রক্ষার কাজে ব্যবহার করতে পারেন। রেলপথে ও বিশেষ ব্যবস্থাধীনে ট্রেনের সংখ্যা বাড়াতে হবে। নইলে ত্রাণ সামগ্রী বন্টনের যে শুধু অবস্থা দেখা দেবে তাই নয়, বরং অসৎ ব্যবসায়ীদের ঘাটতির সুযোগ নিয়ে নির্বিবাদে বন্যা দুর্গত মানুষের দুর্গতিকে আরো শতগুণ বাড়িয়ে তুলবে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক