বাংলার বাণী
১৯ই আগস্ট, রোববার, ১৯৭৩, ২রা ভাদ্র, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
দিল্লী বৈঠক সফল হোক
পিন্ডি আলোচনার ব্যর্থতাকে পেছনে ফেলে নতুন উদ্যোগ আর গঠনমূলক মনোভাবকে সম্বল করে ভারত গতকাল আবার দিল্লীতে পাকিস্তানের সাথে বর্তমান পর্যায়ের দ্বিতীয় আলোচনায়ে বসেছে। পাকিস্তানী প্রতিনিধিদলের নেতা মিঃ আজিজ আহমেদ বলেছেন : এটাই হবে চূড়ান্ত আলোচনা। এসপার-ওসপার যা কিছু হয় এতেই হবে। না হয়, যে যার বাড়ী চলে যাবে।
এদিকে এই দ্বিতীয় দফা আলোচনায় বসার আগে ভারতীয় প্রতিনিধি দলের নেতা শ্রী পরমেশ্বর নাথ হাকসার ঢাকায় এসেছেন বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সাথে কথাবার্তা বলতে। কেননা আজকের দিনে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার আলোচনায় বাংলাদেশ অবশ্যই একটা থার্ড পার্টি হিসেবে এসে যায়। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সমঝোতা সৃষ্টির ফলে বাংলাদেশের কোন প্রত্যক্ষ ভূমিকা না থাকলেও এটা যে একটা বিরাট সহায়ক শক্তি—তা আজ আর কোন প্রশ্নের অপেক্ষা রাখে না।
বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের সাথে কথাবার্তা বলে যাবার সময় শ্রী হাকসার বলেছেন, পাকিস্তানী প্রতিনিধিরা যদি গঠনমূলক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসেন, তাহলে এই বৈঠকের ফলাফল সম্পর্কে আশাবাদী হবার কারণ রয়েছে। তিনি কিন্তু আজিজ আহমেদ সাহেবের মতো এটাকে শেষ বা চূড়ান্ত ধরনের কিছু বলেননি। আর বৈঠকে যা যা আলোচিত হবে তা আগ থেকেই সুনির্দিষ্ট করে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও তার পরবর্তীকালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের প্রেক্ষিতে উদ্ভূত মানবিক সমস্যাবলী বিশেষ করে ভারতে আটক পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের প্রত্যার্পণ, পাকিস্তানে আটক বাঙালীদের মুক্তিদান, বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানীদের ফিরিয়ে নেওয়া, ভারত ও পাকিস্তানীদের মধ্যকার অন্যান্য সব নতুন-পুরোনো বিরোধ এবং সর্বোপরি বাংলাদেশ-ভারত যুক্ত ঘোষণার প্রেক্ষিতে এতে আলোচিত হবে।
রাওয়ালপিন্ডি থেকে দিল্লী বিমানবন্দরে পৌঁছে মিঃ আজিজ আহমেদ আরো বলেছেন, মানবিক সমস্যাবলীর সমাধানের ক্ষেত্রে কোন প্রতিবন্ধকতা বা জটিলতা দেখা দিলে বৈঠকেই তা তাঁরা দূর করবেন—তাঁর প্রতিনিধিদল সেই মানসিকতা নিয়েই এসেছে। তিনি সরাসরিভাবে আভাসও দিয়েছেন যে, বৈঠকে তিনি বা তাঁর দল ১৯৫ জন যুদ্ধপরাধী (বাংলাদেশ সরকার যাদের বিচারের ব্যবস্থা করছেন) সম্পর্কে কোন কথা তুলবেন না। মিঃ আজিজ আহমেদের এ উক্তি পাকিস্তানের সমঝোতামূলক মনোভাবেরই পরিচায়ক—গঠনমূলক তৎপরতার প্রমাণ।
পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, মিঃ আজিজ আহমেদ যা বলেছেন, তিনি তাঁর প্রতিনিধিদল, তাঁর সরকার যদি তা সঠিক অর্থেই বলে থাকেন তবে এই বৈঠকে কোনা প্রকারের জটিলতা সৃষ্টি হবার কোন অবকাশ তো নেই-ই, পরন্তু এর মাধ্যমে পাকিস্তানে আটক বাঙালীদের ও বাংলাদেশে আটক পাকিস্তানীদের স্ব স্ব দেশে ফিরে যাওয়া, পাক-যুদ্ধবন্দীদের প্রত্যর্পণ ইত্যাদি প্রশ্নেও আর কোন বিঘ্নের সৃষ্টি হতে পারে না। দিল্লী আলোচনা সফল হতে বাধ্য। আর তারই জের টেনে উপমহাদেশের সাধারণ মানুষের জন্যে শান্তির নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। আমরাও এ ব্যাপারে একই মত পোষণ করি।
কিন্তু এখন কথা হলো, পাকিস্তানী প্রতিনিধিদলের নেতা, তাঁর উক্তির সম্মান কতখানি রাখবেন! বিশ্ববাসীর সেটাই এখন লক্ষণীয়।
সোনালী আঁশের প্রতি অমনোযোগিতা ধ্বংস ডেকে আনবে
স্বয়ং অর্থ ও পাট বিষয়কমন্ত্রী মহোদয়ই বলেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের গাফিলতিতে গত জুলাই মাস পর্যন্ত বিগত চৌদ্দ মাসে পাট রপ্তানীর ক্ষেত্রে ১ লাখ ৩০ হাজার স্টার্লিং গচ্চা দিতে হয়েছে। তিনি এর সঙ্গে শ্রমিকদের কাজে গাফিলতির কথাও উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন এর ফলে ১৯৭২ সালের অক্টোবর-নভেম্বর মাসে কাঁচা পাট রপ্তানীর চুক্তি অনুযায়ী পাট রপ্তানী হয়নি। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বিশ্বের বাজারে এখনো পাটের প্রচুর চাহিদা রয়েছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
এ কথা নির্দ্বিধায় এবং নিঃসন্দেহে সত্য যে, পাট হচ্ছে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান ও প্রথম অর্থকরী ফসল। এবং সে জন্যেই পাট বাংলাদেশের সোনালী আঁশ নামে দীর্ঘদিন থেকে সুপরিচিত। এবং এ কথাও নির্ভুল যে, এক সময় এই বাংলাদেশ (তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান) ছিলো পৃথিবীর সর্বপ্রধান পাট রপ্তানীকারক দেশ।
কিন্তু অতীব দুঃখ এবং পরিতাপের বিষয়, আজ সেই বাংলাদেশেই পাট উৎপাদনে কৃষকদেরকে অনুৎসাহিত হ’তে দেখা যাচ্ছে। তারা নিরুৎসাহ হচ্ছেন পাটের প্রকৃত মূল্য পাচ্ছেন না বলে।
সরকার পাটের নিম্নতম মূল্য বেঁধে দিয়েছেন, পাট ক্রয় কেন্দ্র খুলেছেন, সমাজতান্ত্রিক পদক্ষেপ অনুসারে গোটা পাট শিল্পকে জাতীয়করণ করে নিয়েছেন। অথচ এর ফলে যেখানে পাট চাষীদের উপকৃত হবার কথা সেস্থলে তাঁরা একশ্রেণীর অসৎ ব্যবসায়ী, ফড়িয়া, কালোবাজারী ইত্যাদির জন্যে সরকার ঘোষিত পাটের নিম্নতম মূল্য পর্যন্ত পাচ্ছেন না। উপরন্তু গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে যেসব খবর আসছে তাতে জানা যায়, এখন পর্যন্ত পল্লী এলাকার বড় বড় হাট-বাজারগুলোতে যেখানে দৈনিক শত শত মণ পাট কেনাবেচা হয় সে সব এলাকায় সরকারী পাটক্রয় কেন্দ্র খোলা হয়নি। উপরন্তু সে সব হাট বাজারে নিম্নতম মূল্যে পাট ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে কিনা তা পরিদর্শন করার জন্য প্রেরিত সরকারী পরিদর্শক বড় বড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মোটা অংকের উৎকোচ গ্রহণ করে অবলীলাক্রমে কর্তৃপক্ষের কাছে ‘সঠিক মূল্যে’ পাট ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে বলে রিপোর্ট পেশ করছেন, পাট চাষীদের কাছ থেকে এমন অভিযোগও আসছে। সংশ্লিষ্ট কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের দায়িত্বে গাফিলতি এবং অসৎ পথ অবলম্বনের ফলে সরকারী পাট রপ্তানী লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো যাচ্ছেনা বা যায়নি, সেকথা অর্থ ও পাট বিষয়ক মন্ত্রীর ভাষণ থেকেই সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
সুতরাং আমাদের বক্তব্য, দেশের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকর্মের অন্যতম চাবিকাঠি পাট ব্যবসায়ে এমন অবস্থা চলতে থাকলে দেশের বর্তমান অবস্থার উন্নতি দূরে থাক তা যে কি ভয়াবহ ও মারাত্মক পরিণতি বয়ে আনবে সে কথা নতুন করে বলার অবকাশ নেই। অতএব যে কোন মূল্যে পাট ব্যবসায়ে সকল প্রকার দুর্নীতি ও গাফিলতি দৃঢ়হস্তে দূর করে পাট চাষীদের নিম্নতম মূল্য পাওয়ার সুব্যবস্থা সরকারকে অবশ্যই করতে হবে। এবং সেই সঙ্গে ধানের মূল্য অনুসারে পাটের নিম্নতম মূল্য পর্যালোচনা করে দেখার অবকাশ আছে বলে আমরা মনে করি এবং সে জন্যে গোটা বিষয়টির প্রতি সরকারের ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সয্ত্ন দৃষ্টি জনসাধারণের সঙ্গে আমাদেরও আন্তরিক কাম্য এবং আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস তাহলে সরকার অনুসৃত পাটনীতি অনুসারে পাট রপ্তানীতে আমরা লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে পারবো এবং বাঞ্ছিত বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করা সম্ভব হবে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক