বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২৮শে আগস্ট, বুধবার ১১ই ভাদ্র, ১৩৮১
গিনি-বিসাউঃ সংগ্রামী অভিনন্দন
গিনি বিসাউ মুক্তিসংগ্রামের মহান নেতা এবং আফ্রিকান পার্টি ফর দি ইন্ডিপেন্ডেন্স অফ জিনিয়ার কেপ ভার্দে আইল্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা এমিলকার ক্যারেল বেঁচে নেই। কিন্তু তার স্বপ্ন আজ বাস্তবায়িত হতে চলেছে কালো আফ্রিকায়। গিনি-বিসাউ এর স্বাধীনতা মঞ্জুরের ঐতিহাসিক সনদপত্রে স্বাক্ষরদান করেছেন পর্তুগালের সরকারি কর্মকর্তা।
দীর্ঘ ৯ বছরের সশস্ত্র সংগ্রাম মুক্তির লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যমে সমাপ্ত হলো। শেষ পর্তুগাল সেনাটিও ক’দিনের মধ্যে ফিরে যাবেন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত এদেশ থেকে। পর্তুগাল এর রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এমন একটা সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। দীর্ঘদিনের ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটিয়ে যখন জেনারেল স্পিনোলা ক্ষমতায় এলেন তখন তিনি আফ্রিকার পর্তুগালের উপনিবেশ গুলির স্তরানুক্রমিক স্বাধীনতা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তার এই উপনিবেশ বিরোধী এবং সংস্কারমূলক নীতিমালার প্রতি সমর্থন জানিয়ে সেদিন পর্তুগালের প্রগতিশীল শক্তিসমূহ এগিয়ে এসেছিল। সেখানকার রাজনীতিতে শুরু হয়েছিল পালাবদলের পালা।
১৯৬৫ সালে গিরি বিষয়ের স্বাধীনতার লক্ষ্যকে সামনে রেখে গেরিলা এবং নিয়মিত বাহিনী গঠিত হলেও সেখানকার কালো আফ্রিকানরা বিশ দশকের শুরু থেকেই বিভিন্ন সময় তাদের আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯০৮, ১৯১৬-১৭, ১৯২৫ এবং ১৯৩৬ সালে তীব্র আকার ধারণ করে। কিন্তু উপনিবেশিক শক্তির অত্যাচার, নির্যাতনের মুখে তা সফলতা লাভ করতে পারে না। অবশেষে ১৯৫৬ সালে মহান জাতীয়তাবাদী নেতা এমিলকার ক্যারেল গঠন করেন আফ্রিকান পার্টি ফর দি ইন্ডিপেন্ডেন্স অফ কেপ ভার্দে আইল্যান্ড। শুরু হয় নবতর সংগ্রাম। পর্তুগালের ফ্যাসিস্ট উপনিবেশবাদী শাসকগোষ্ঠী ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তি সংগ্রামীদের উপর।
এমিলকার ক্যারেলের নেতৃত্বে ধীরে ধীরে সংঘটিত হতে থাকে গিনি-বিসাউ এর মুক্তিকামী মানুষ। স্বাধীনতা সংগ্রাম অধিকতর শক্তিশালী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রমাদ গুনতে থাকে পর্তুগালের উপনিবেশিক গোষ্ঠী। তারা মুক্তি আন্দোলনের মহান অধিনায়ক ক্যারেলকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র মেতে ওঠে। গিনি-বিসাউ এর অধিকাংশ ভূখণ্ড তখন মুক্তি সংগ্রামীদের দখলে। প্রস্তুতি চলছে স্বাধীন-সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র হিসেবে গিনি-বিসাউ এর নয়া অস্তিত্ব ঘোষণা এবং নতুন সরকার গঠনের। এমনই ক্রান্তিলগ্নে ১৯৭৩ সালের ২০শে জানুয়ারি গিনি-বিসাউ-এর মুক্তিকামী মানুষের নেতা এমিলকার ক্যারেলকে গুপ্তঘাতক এর মাধ্যমে হত্যা করা হয়।
কেরলের মৃত্যু সেখানকার মুক্তি আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে পারেনি। তার স্বপ্নকে সামনে রেখে স্বাধীন-সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র হিসেবে গিনি-বিসাউকে ঘোষণা করা হয়। দুনিয়ার স্বাধীনতাপ্রেমী মানুষ এই নয়া রাষ্ট্রকে স্বাগত জানায়। বাংলাদেশ সহ অন্যান্য প্রগতিশীল এবং মুক্তিকামী রাষ্ট্র গিনি-বিসাউ কে স্বীকৃতি জানায়।
পর্তুগালের রাজনৈতিক পরিবর্তন গিনি-বিসাউ স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করেছে ঠিকই কিন্তু মুক্তিকামী মানুষের অপ্রতিরোধ্য গতিকে পর্তুগালের ফ্যাসিস্ট জান্তাও স্তব্ধ করতে পারত না। গিনি-বিসাউ সার্বিক স্বাধীনতা লাভ করেছে। সেই চরম দিনটির প্রতীক্ষায় এখনো অপেক্ষামান অ্যাঙ্গোলা এবং মোজাম্বিকের স্বাধীনতা সংগ্রামী লাখো মানুষ। পর্তুগিজ সরকার তাদের স্বাধীনতা প্রদানে অঙ্গীকারাবদ্ধ। এ বিষয় নিয়ে দুটি উপনিবেশের নেতাদের সাথে নয়া পর্তুগিজ সরকারের আলোচনা হয়েছে। এখন দীর্ঘদিনের পরাধীন পর্তুগিজ উপনিবেশ সমূহের স্বাধীনতাপ্রাপ্তি শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র। আফ্রিকার এই নব্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত সংগ্রামী লাখো মানুষকে আমরা অভিনন্দন জানাই। তাদের স্বাধীনতা সংহত করা এবং দেশের পুনর্গঠন সংগ্রামে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতা ও সহানুভূতি অব্যাহত থাকবে। শুধু গিনি-বিসাউ নয় বরং আফ্রিকার মুক্তিকামী সকল মানুষের প্রতিই আমাদের সমর্থন এবং সহানুভূতি রয়েছে। উপনিবেশবাদের অস্তাচলগামী সূর্যের পথ বেয়ে স্বাধীনতার নতূন সূর্য কালো আফ্রিকাকে আলোকিত করুক এই আমার প্রার্থনা।
বীজ ধানের অভাব
বীজ ধানের প্রয়োজন। বানের পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। মরে ও পচে যাওয়া ধানক্ষেতে আবার নতুন করে ফসল বুনতে চাষীদের বীজ ধানের প্রয়োজন। সময় মত ধান বুনতে যদি না পারা যায় এবং বীজ ধানের অভাব যদি সে ক্ষেত্রে একমাত্র অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় এবার তাহলে অনাবাদি রয়ে যাবে। পরিণতিতে সমগ্র দেশকে আগামী বছর ভয়াবহ খাদ্যঘাটতির সম্মুখীন হতে হবে একদিকে, অপরদিকে যাদের জমি অনাবাদি রয়ে যাবে, বাংলাদেশের সর্বহারাদের দলের নেতাদের প্রাণান্ত হবে আরেক ধাপ। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন এর এক নির্ভরযোগ্য তথ্যের উপর ভিত্তি করে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আসন্ন আমন মৌসুমে প্রয়োজনীয় বীজ ধানের অভাবে ৯৪ হাজার ৭শ’ একর জমি অনাবাদি থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। কর্পোরেশন বিভিন্ন জেলা থেকে পাওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে মোটামুটি হিসেবে রয়েছেন ৫৬ হাজার ২শ’ মণ বীজ ধানের প্রয়োজন রয়েছে সারাদেশে, তার মধ্যে সংগৃহীত হয়েছে ৩৭ হাজার ২শ’ ৫৯ মণ। বাদবাকি ১৮ হাজার ৯শ’ ৪১ মণ বীজ ধান সংগ্রহ করা যাচ্ছে না। ফলে ৯৪ হাজার ৭শ’ একর জমি অনাবাদি থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
আমরা আমাদের দীর্ঘ অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে দেখেছি রোগে মারা গেলে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব ইত্যাদির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তর প্রকৃত অবস্থার অনেক অল্প অংশ উল্লেখ করে থাকেন এবং সেক্ষেত্রে ঐ একই প্রবনতার পথ ধরে যদি প্রতিবেদনকারকে কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রদানকারী প্রকৃত অবস্থা গোপন করে থাকেন তাহলে অবস্থা আরও মারাত্মক। আর যদি রিপোর্টারের তথ্য সত্যি হয় তাহলে এই মুহূর্তে ভাবতেও পারা যাচ্ছে না যে, যে দেশকে বর্তমানে ভয়াবহ খাদ্য সমস্যা মাথায় নিয়ে চলতে হচ্ছে তাহলে আগামী বছর খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ আরও কতক্ষণ ভয়াবহ হয়ে দাঁড়াবে? এতে গেল বীজ ধানের অভাবজনিত প্রায় ১ লাখ একর জমি অনাবাদি থাকার সমূহ সম্ভাবনার সমস্যা। গ্রাম-গ্রামান্তরে থেকে খবর এসে পৌঁছাচ্ছে, সরকারের তরফ থেকে ‘সীড গ্ৰাণ্ট’ হিসাবে যে অর্থ বরাদ্দ করা হচ্ছে, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের প্রণীত সে তালিকায় প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্থ চাষীদের স্থান নেই। এছাড়া সরকারের তরফ থেকে যে বীজ ধান সংগ্রহ করা হয়েছে তার প্রায় ৫০ ভাগই নাকি ব্যবহারের অনুপযোগী। আপাততঃ সমস্যা হয় তাহলে আমাদের তিনটে বীজ ধান পাওয়া যাচ্ছে না যে বীজ ধান সংগ্রহ করা হচ্ছে তার অধিকাংশই ব্যবহারের অনুপযোগী এবং ক্ষতিগ্রস্ত চাষিরা সীড গ্রান্ড পাচ্ছেন না। সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ দেশ অথবা বিদেশ থেকে যেভাবেই এবং যেখান থেকেই হোক, চাষীদের বীজ ধানের প্রয়োজন মেটাতে হবে, যাতে করে এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না রয়ে যায়। আর বীজ ধান হিসেবে যে বীজগুলো সংগ্রহ করা হচ্ছে তা যেন ব্যবহার উপযোগী হয়, তা না হলে অনর্থক টাকা-পয়সাও চাষীদের শ্রম নষ্ট করে কোন লাভ হবে না। তৃতীয়তঃ দীর্ঘদিন থেকে আমরা দেখে আসছি যাদের জন্য সাহায্য মঞ্জুর করা হয় তা তারা পায় না কানাকড়িও। সবাই চলে যায় রাঘব বোয়ালদের মুখ গহ্বরে। সুতরাং যেভাবেই হোক, প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্থ প্রতিটি চাষির হাতে যাতে সময়মতো বীজ ধান পৌছাতে পারে সে ব্যাপারে অবিলম্বে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। অন্যথায় খাদ্যমন্ত্রীর ভাষায় ‘সামনের তিনটি মাস খাদ্য সংকটের সময়কেও মিথ্যা প্রতিপন্ন করে আগামী গোটা বছরটাই সারা দেশে চরম খাদ্যসঙ্কট বিরাজ করবে এবং তার সমস্ত দায়-দায়িত্ব সরকারেরই স্কন্ধে যেয়ে পড়বে।’
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক