ইয়াহিয়া খান-মুজিব বৈঠক
৭ মার্চ আন্দোলন-সংগ্রামের কর্মসূচির অংশ হিসেবে ১০ দফা নির্দেশ জারি করা হলো-
১। দেশ মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত কেউ খাজনা, ট্যাক্স দেবেন না।
২। সরকারি-আধাসরকারি অফিসসমূহ, হাইকোট জজকোর্ট সব খানে পূর্ণ হরতাল পালন করতে হবে।
৩। রেল চলবে, বন্দরে কাজ চলবে, কিন্তু বাঙালি হত্যার জন্য পাকিস্তানি সৈন্য ও গােলাবারুদ সমরাস্ত্র পরিবহন করা যাবে না।
৪। রেডিও টিভি এবং সংবাদপত্র গুলােতে আওয়ামী লীগের প্রতিবেদন এবং সংগ্রাম আন্দোলনের বিস্তারিত খবর প্রকাশ করতে হবে না করা হলে বাঙালিরা কেউ সেখানে যাবে না।
৫। শুধু আন্তঃ জেলা ও স্থানীয় টেলিযােগাযােগ চালু থাকবে
৬। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
৭। ব্যাংক সমূহ স্টেট ব্যাংকের মাধ্যমে বা যে কোনও উপায়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে টাকা পাঠাতে পারবে না।
৮। প্রতি ঘরে ঘরে কালাে পতাকা ওড়াতে হবে।
৯। প্রতিটি গ্রাম মহল্লার থানা মহকুমা এবং জেলা পর্যায়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে।
বঙ্গবন্ধুর এ নির্দেশে সারাদেশ চলে, সৈন্যদের অত্যাচার বেড়ে যায়, প্রতিদিন গুলিতে সারাদেশে কম করে হলেও ৫৩ জন নিহত এবং আহত প্রায় তিনশত, এটা সরকারি প্রেস নােটের হিসেবে। ছাত্ররা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তােলার ডাক দেয়। পরদিনই ছাত্রলীগ প্রত্যেক মাঠে-মহল্লায় কুচকাওয়াজ শুরু করে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউটিসি (বিএনসিসি)-র ড্যামি রাইফেল দিয়ে ট্রেনিং চলে। ঘরে ঘরে কালাে পতাকা আর জাতীয় পতাকা ওড়ে সকল সিনেমা হলে আমার সােনার বাংলা জাতীয় সঙ্গীতে সুর প্রথমে ও শেষে গাওয়া হয়। উর্দু সিনেমা সকল হলগুলােতে বন্ধ হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু অসহযােগ আন্দোলন সফল করার জন্য সকল রাজনৈতিক দল, এমনকি মওলানা ভাসানীও সকলকে উদাত্ত আহ্বান জানান। টিক্কা খান গভর্নর ও সামরিক প্রধান হয়ে এলেও প্রধান বিচারপতি এ বি সিদ্দিকী ৯ মার্চ পর্যন্ত তাকে শপথবাক্য পড়া অস্বীকৃত হন। ১৪ মার্চ ভুট্টো হঠাৎ দাবি করেন, পূর্ব বাংলায় শেখ মুজিব ও পাকিস্তানে ভুট্রো নিজে প্রধানমন্ত্রী হতে চান। এই অদ্ভুত প্রস্তাব থেকে বােঝা যায় ৭ মার্চ আপনা থেকেই পাকিস্তান দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেছে। এখন বাংলাদেশ আক্রমণ করে যদি সত্যিকারের পরাধীন দেশ হিসেবে পরিগণিত করতে পারে সেই চেষ্টাই চলছে। ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ ঢাকায় আসেন। প্রকৃতপক্ষে এখানে সামরিক বাহিনীকে যথাযথ নির্দেশ ও আক্রমণের বিভিন্ন কলাকৌশল নিশ্চিত করতেই তার আগমন। তার আগমনের পর ব্যাপক হারে পাকিস্তান থেকে অস্ত্র, গােলাবারুদ এবং সৈন্য আসতে শুরু করল। কিন্তু ঘােষণা দেওয়া হল শেখ মুজিবের সঙ্গে আলােচনা করতে তাঁর ঢাকা আগমন।
পরদিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইয়াহিয়া আলােচনার প্রহসন শুরু করেন। বঙ্গবন্ধু গাড়িতে কালাে পতাকা লাগিয়ে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলােচনা করতে যান এবং দীর্ঘ আড়াই ঘণ্টা আলােচনা করে বঙ্গবন্ধু ফিরে এসে তাজউদ্দিনকে বলেন, অর্থহীন। তবু সিদ্ধান্ত হয় আলােচনা চালিয়ে যাওয়া হবে। পরদিন আবার এক ঘণ্টা আলােচনা হয়। বঙ্গবন্ধু অগ্রগতি সম্বন্ধে সাংবাদিকদের কিছু বলতে পারলেন না। শুধু বললেন, আমাদের সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে লক্ষ্যে উপনীত হওয়া পর্যন্ত চলবে। সেদিন এক জনসভায় মওলানা ভাসানী স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘােষণা করেছে, স্বাধীনতা সংগ্রামে সকলে ঝাপিয়ে পড়াে, ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আর কোনও আলােচনা নয়। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নেতারা ঢাকায় আসেন এবং বঙ্গবন্ধুর সাথে একে একে দেখা করেন, কেবল ভুট্টো ছাড়া। অন্যরা ভুট্টোর একগুঁয়েমির নিন্দা করেন। তবু কেন ভুট্টো ঢাকায় এল তার রহস্য খুঁজে পাওয়া গেল না। হয়তােবা ইয়াহিয়া বেফাঁস শেখ মুজিবের কথায় রাজি হয়ে যান তাঁকে টাইট করার উদ্দেশ্যে এসেছিল এবং কড়া নিরাপত্তার ভেতর আবার পাকিস্তানে চলে গেল। এদিকে ঢাকা থেকে জাপান, জার্মান, ব্রিটিশ প্রভৃতি দেশের নাগরিকদের স্বদেশে ফিরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয় জাতিসংঘ। বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উথান্টকে অভিহিত করেন বাংলাদেশে গণহত্যা চলছে, মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, পাকিস্তানিরা এসব করছে; নাগরিকদের ফিরিয়ে নিলে কেবল জাতিসংঘের দায়িত্ব শেষ হবে না। বাংলাদেশের জনগণের জন্য জাতিসংঘের দায়িত্ব আছে। পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে। হরতাল ও অসহযােগ আন্দোলন ব্যাপক ও কঠোর হওয়ায় প্রশাসন থেকে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। কিন্তু সান্ধ্য আইন অর্থহীন, কেউ তা মানার জন্য বসে নেই। দু’দিন বাদে ফের ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠক হচ্ছে, সামরিক বাহিনী সেটা ওপরে ঘােষণা রেখে ভেতরে মতলবের কলাকৌশল পাকাচ্ছে। ২০ মার্চ থেকে উভয় পক্ষে উপদেষ্টা নিয়ে বৈঠকের প্রস্তাব দেওয়া হয়। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সামরিক কর্মকর্তারা আর, মুজিবের সঙ্গে ছিলেন তাজউদ্দিন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ডা. কামাল হােসেন ও কামরুজ্জমান। আলােচনার ফলাফল শূন্য। ২৩ তারিখের বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু বলেন, আলােচনার কিছু অগ্রগতি হয়েছে, কিন্তু ভুট্রো ঢাকা ছেড়ে পালান। বাঙালিরা এক দফার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ; স্বাধীনতা ছাড়া আর কিছুরই আলােচনা চলতে পারে না। ২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তান দিবস, পরম আশ্চর্যের ব্যাপার যে পাকিস্তানে ২৩ মার্চ ১৯৭১-এ দিবস পালন হল না। বরং সামরিক কায়দায় বঙ্গবন্ধুকে এদিন জয়বাংলা বাহিনী, যা ছাত্র-যুবক পনেরাে-ষােল দিন যাবৎ কুচকাওয়াজ ও ট্রেনিং দিয়ে শিখেছে, গার্ড অব অনার প্রদান করল। সবার অলক্ষ্যে ইয়াহিয়া খান ঢাকা ছেড়ে চলে যান। তিনি রাত এগারটায় (পাকিস্তান সময় রাত দশটা) পাকিস্তানে পেীছার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ঢাকা ও সারা বাংলাদেশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ২৫ মার্চের কাল রাতে কেবল ঢাকাতেই প্রায় বিশ হাজার লােককে হত্যা করা হয়।
সূত্র : বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ বিজয় ও বঙ্গবন্ধুর জীবন উৎসর্গ – শামসুল আলম সাঈদ