You dont have javascript enabled! Please enable it! 1967 | আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা - সংগ্রামের নোটবুক

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা

 

আগরতলা হল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী। এক সময় বাংলাদেশের কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, ঢাকা, নােয়াখালী, চট্টগ্রাম অঞ্চলের বেশ কিছুটা আগরতলা মহারাজের রাজত্বের অধীন ছিল। ব্রিটিশ যুগের বৃহত্তর কুমিল্লা ত্রিপুরা রাজ্যের অধীন ছিল। ত্রিপুরার অধিবাসী দুই-তৃতীয়াংশ বাঙালি, হালে পাহাড়ি ত্রিপুরাজাতি জেগে উঠেছে। তাদের মাতৃভাষা ককবরককে মর্যাদা দেওয়ার দাবি করছে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে ত্রিপুরা রাজশক্তি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছিল। বাংলা ভাষায় রচিত ও মুদ্রিত প্রথম গ্রন্থ হচ্ছে রাজমালা, ত্রিপুরা রাজবংশের বিবরণ। ত্রিপুরা ভৌগােলিক ও জাতিগত দিক থেকে বঙ্গ বা বাংলাদেশের অংশ। ত্রিপুরার সঙ্গে বাংলার সম্পর্ক সুপ্রাচীন। মসনদে আলা ঈশা খাঁ আগরতলার রানির স্তনধােয়া পানি খেয়ে তাকে মা ডেকেছিলেন। সে কারণে সরাইল ও কুমিল্লা পরগনা ঈশা খানকে রানি দান করেন। পাকিস্তানি সামরিক সরকার কিসের গন্ধ পেয়ে ত্রিপুরা তথা ভারতকে জড়িয়ে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ফাঁদেন! মামলার নাম, আগরতলা ষড়যন্ত্র : রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব। মামলায় বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার উদ্দেশ্যে সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে শেখ মুজিব ও তাঁর সঙ্গিরা ঢাকাস্থ ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনের সঙ্গে প্রথমে যােগ স্থাপন করে। পরে তারা আগরতলা গিয়ে লে, কর্নেল মিশ্র, মেজর মেনন প্রভৃতি ভারতীয় সামরিক অফিসারের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এ কাজে পাকিস্তানি সামরিক অফিসারদের মধ্যে লে. কর্নেল আমিন আহমদ মােহাম্মদ, কমান্ডার এসএম হাসান, কেন্দ্রীয় গােয়েন্দা বিভাগের ডিরেক্টর এম আকবর, ইন্টার সাতিল ইন্টেলিজেন্স প্রধান ব্রিগেডিয়ার আকবর প্রমুখ ৩৫ জনকে এই মামলা প্রস্তুতের কালে নিয়ােজিত করা হয়েছিল। এরা সকলেই পাঞ্জাবি, ঘােরতর বাঙালিবিদ্বেষী এর পরিপ্রেক্ষিতে একটা বানােয়াট অপরাধের অবতারণা করে শেখ মুজিবকে ৮ম ১৯৬৬ গ্রেপ্তার করে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে আটক করা হয়  এর প্রতিবাদে ৭ জুন  ৬৬  আওয়ামী লীগ সারাদেশে সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করে। ধর্মঘটে বিপুল সাড়া পড়ে। সাড়ে বারােটায় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে মিছিল বের হয়। মিছিলের ওপর আইয়ুব সরকারের পুলিশ গুলি চালায়। ফলে তরতাজা এগারটি প্রাণ কেড়ে নেওয়া হয়। সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কথা ঘােষণা দেয়। এই মামলায় আসামি করা হয়েছিল তাদের নাম

১। শেখ মুজিবুর রহমান (ফরিদপুর)

২। লে. কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেন (বরিশাল)

৩। স্টুয়ার্ড মুজিবর রহমান (মাদারীপুর)কেড়ে নেওয়া হয়। তারপর হয়। এই মামলায় যাদের যাদের

৪। প্রাক্তন লিডিং সি ম্যান সুলতান উদ্দিন (নােয়াখালি)

৫। প্রাক্তন এবল সি ম্যান নুর মােহাম্মদ (ঢাকা)

৬। আহমদ ফজলুর রহমান সিএসপি (ঢাকা)।

৭। ফ্লাইট সার্জেন্ট মফিজুল্লাহ (নােয়াখালি)

৮। প্রাক্তন কর্পোরেল এবি সামাদ (বরিশাল)

৯। দলিল উদ্দিন (বরিশাল)

১০। রুহুল কুদুস সিএসপি (খুলনা)

১১। ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক (বরিশাল)

১২। ভূপতি ভূষণ চৌধুরী ওরফে মানিক চৌধুরী (চট্টগ্রাম)

১৩। বিধানকৃষ্ণ সেন (চট্টগ্রাম)

১৪। সুবেদার আবদুর রাজ্জাক (কুমিল্লা)

১৫। ইপিআর টিএস ক্লার্ক মুজিবর রহমান (কুমিল্লা)

১৬। সাবেক ফ্লাইট সার্জেন্ট আবদুর রাজ্জাক (কুমিল্লা)

১৭। সার্জেন্ট জহুরুল হক (নোয়াখালি)।

১৮। মােহাম্মদ খুরশিদ (ফরিদপুর)

১৯। খান মােহাম্মদ শামছুর রহমান সিএসপি (ঢাকা)।

২০। রিসালদার শামসুল হক (ঢাকা)

২১। হাবিলদার আজিজুল হক (বরিশাল)

২২। এসএসি মাহফজুল বারি (নােয়াখালি)

২৩। মেজর শামসুল আলম (ঢাকা)

২৪। সার্জেন্ট শামসুল হক (নােয়াখালি)

২৫। ক্যাপ্টেন মােতালিব (ময়মনসিংহ)

২৬। ক্যাপ্টেন শওকত আলী (ফরিদপুর)

২৭। ক্যাপ্টেন খােন্দকার নাজমুল হুদা (বরিশাল)

২৮। ক্যাপ্টেন নুরুজ্জামান (ঢাকা)।

২৯। সার্জেন্ট আবদুল জলিল (ঢাকা)।

৩০। মাহবুবুদ্দিন চৌধুরী (সিলেট)

৩১। লে, এসএম রহমান (যশাের)

৩২। সাবেক সুবেদার তাজুল ইসলাম (বরিশাল)

৩৩। মােহাম্মদ আলী রেজা (কুষ্টিয়া)

৩৪। ক্যাপ্টেন খুরশিদ (ময়মনসিংহ)

৩৫। লে, আবদুর রউফ (ময়মনসিংহ)

আমাদের আগেভাগেই গ্রেফতার করা হয়েছিল।  প্রকৃতপক্ষে এর ভেতর দু’একজনের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের পরিচয় থাকতে পারে। অন্যরা হয়তাে শেখ মুজিবের নামও শোনে নি। এদের কেউ এখন জীবিত আছেন কি-না জানি না। পনেরাে বছর আগে একজনের সঙ্গে কথা হয়েছিল, তিনি এ কথা জানালেন, পরে মুক্তি পেয়ে শেখ মুজিবেরবদের সঙ্গে দেখা করেন।   এদের বেশিরভাগ ব্যক্তি পাঞ্জাবিদের সঙ্গে বাঙালি মানসীকতা উজ্জীবিত হয়ে আচরণ করতেন। এটাই ছিল তাদের অপরাধ। প্রকৃতপক্ষে একজন দুইজন ছাড়া রাজনীতির সঙ্গে তাদের কোনও সম্পর্ক ছিল না। তবে সার্জেন্ট জহুরুলসঙ্গে  হকের মতাে বীর পুরুষ বাঙালির ভেতর কমই জন্মগ্রহণ করেছে। তাকে ক্যান্টমেন্টের জেলখানায় নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়।  হাজার নির্যাতন দিয়ে মিথ্যা ষড়যন্ত্রের কথা বলিয়ে  নিতে পারে নি। তেমনি ছিলেন লে. কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেন, একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে হানাদার বাহিনী তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। আগরতলা ষড়যন্ত্রের মামলা, রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব চলছে। প্রতিদিন পত্রিকায় তাদের কুকীর্তি ফলাও করে প্রকাশ করছে সরকার। যতই কুকীর্তি প্রকাশ করছে জনতা উত্তপ্ত হচ্ছিল। এই বানােনায়াট মিথ্যা মামলা সকলের নিকট প্রতীয়মান হচ্ছিল। ১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি হঠাৎ করে এই তালিকার ৪ জনকে রাজসাক্ষি ঘােষণা করা হয়। তার কিছুদিন পরে আরও ৭ জনকে ক্ষমা প্রদর্শন করে রাজসাক্ষিতে পরিণত করে। অবশ্য তারা এই তালিকার বাইরে। তারাও যে আসামি ছিলেন সে কথা আগে প্রকাশ করা হয় নি।

যাঁরা রাজসাক্ষি হলেন

১। লে. মােয়াজ্জেম হােসেন (ময়মনসিংহ)

২। প্রাক্তন কর্পোরেল আমির হােসেন মিয়া (মাদারীপুর)

৩। সার্জেন্ট শামসুদ্দিন আহমদ (ময়মনসিংহ)

৪। ডা. সৈয়দুর রহমান (চট্টগ্রাম)

৫। মির্জা রমিজ (চট্টগ্রাম)

৬। ক্যাপ্টেন আবদুল জলিল ভূইয়া (কুমিল্লা)

৭। কর্পোরেল জামালউদ্দিন (পাবনা)

৮। কর্পোরেল সিরাজুল ইসলাম (কুমিল্লা)

৯। মােহাম্মদ গােলাম আহমদ (মাদারীপুর)

১০। মােহাম্মদ ইউসুফ (বরিশাল)

১১। সার্জেন্ট আবদুল হালিম (কুমিল্লা)

আসামির তালিকায় হয়তােবা আরও কেউ থাকতে পারে কিন্তু তা প্রকাশ করার আগেই তা  ভুণ্ডল গেল। ক্যান্টনমেন্টে গােলমাল দেখা দিল, সার্জেন্ট জহুরুল হককে হত্যা করার পর ঢাকার রাস্তায় যেন উত্তপ্ত সলিল প্রবাহ বয়ে গেল। জহুরুল হকের কয়েকজন বাঙালি জোয়ানকেও নাকি হত্যা করা হয়েছিল। তাই একটা ভয়াবহ সৃষ্টি হচ্ছে দেখে মামলার শুনানিও পিছিয়ে নিয়ে তারিখ ফেলতে লাগল। একটা বানােয়াট মামলা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সৃষ্টি করা হয়েছে তা কারুর বুঝতে বাকি রইল না।  কল্পিত আসামি সৃষ্টি, কল্পিত ষড়যন্ত্রের কার্যকলাপ এবং তার ব্যক্তি (নির্যাতনের দ্বারা)-কে ছাড়িয়ে নিয়ে রাজসাক্ষি করে তাদের বানোয়াট স্বীকারোক্তি, এর কোনও পারম্পর্য সম্পর্ক ছিল না। যাদের আসামি করা হয়েছিল তাদের ওপর জেলখানায় যে অকথ্য নির্যাতন হয়েছে এবং যে নির্যাতনের দ্বারা স্বীকারােক্তি আদায় করা  হয়েছিল তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।

শেখ মুজিবকে হত্যার জন্য জল্লাদ প্রস্তুত ছিল, তবু তিনি কোনও স্বীকরােক্তি করেন নি, বরঞ্চ পরবর্তীকালে জল্লাদই তা বলেছে। বেআইনিভাবে লােকদের গ্রেফতার করা, গুম করে দেওয়া এবং এ ধরনের স্বীকারােক্তি আদায়ের জন্য নিন্দাও করা হচ্ছিল। মওলানা ভাসানী এতদিন আইয়ুবের বিরুদ্ধে একটি কথাও উচ্চারণ করেন নি, হঠাৎ তিনি ভােল পাল্টিয়ে বিক্ষুব্ধ জনতার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে নিন্দা জানাতে লাগলেন।  মিথ্যা স্বীকারােক্তি আদায়ের জন্য যে কৌশল অবলম্বন করা হয়েছিল পরবর্তীকালে তাদের নিজের মুখ থেকে এসব কথা বলা হয়েছে। ১৯৬৮ সালের ১ জানুয়ারি প্রত্যেক আসামিকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গিয়ে জেরা ও নির্যাতন করা হয়। একটা কক্ষে দুই হাজার ওয়াটের বাল্ব জ্বালিয়ে, গরম স্যাঁক দিয়ে, নাকে-মুখে অনবরত পানি ঢেলে, সারা শরীরে ইলেকট্রিকের অত্যন্ত বেদনাদায়ক স্পর্শ লাগিয়ে, দুই পা ছাদে ঝুলিয়ে রেখে চর্কির মতাে ঘুরিয়ে, পায়ুতে গরম ডিম ঢুকিয়ে, নখে সুচ ঢুকিয়ে যত রকম নির্যাতন সবই চালানাে হয়েছিল। কিন্তু ষড়যন্ত্রের সত্যতা তাে নেই, মিথ্যা স্বীকারােক্তিও একের সঙ্গে অন্যের যথেষ্ট সামঞ্জস্য ছিল না। এই অত্যাচারের ফলে অনেকে ভারসাম্য হারিয়েছেন, অনেকে অল্পদিন পরে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। দেশের জন্য তাদের পরােক্ষ এই অবদান অজ্ঞাতে থেকে যাবে। জেলখানা ভেঙে যখন শেখ মুজিবকে বের করে আনা হল তখন তিনি যে বর্ণনা দেন তা এই, “মিলিটারি আমাকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসে এবং একটা আবদ্ধ কামরায় আটক করে রাখে। আলাে-বাতাস কিছু নেই। একটি মাত্র দরজা এবং একটি মাত্র জানালা, তাও বন্ধ। দিন ও রাত্রি সমান এবং নির্জন অবস্থায় রাখা হয়। প্রকৃতির ডাকের জন্যও বিশেষ কোনও ব্যবস্থা রাখা হয় নি। সেই রুমেই সেরে নিতে হয়। খাবারও আসে এখানে একটা টিনের বাসনে, রুটি-ডাল-সবজি, কোনও সময় একটু মাংস। কারও সঙ্গে দেখা করার কোনও সুযােগ নেই। টিমটিম করে একটা বাল্ব জ্বলে, কোনও সংবাদপত্র পড়তে দেওয়া হয় না। প্রকৃতপক্ষে সুদীর্ঘ পাঁচ মাস যাবৎ দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়। আমাকে সর্বপ্রকার দৈহিক অত্যাচার করা হয়েছে এবং আমার ওপর অসামাজিক মানসিক নির্যাতন চালানাে হয়েছে। উঃ! সে কি মানসিক নির্যাতন! সেটা ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না।

মিলিটারিদের ভেতর একজন তা লক্ষ করে সহ্য করতে পারে নি। তিনি ছিলেন একজন লেফটেন্যান্ট এবং জাতে কাশ্মীরি । তিনি আমাকে গােপনে সতর্ক করে দেন। আমি রুম থেকে বাইরে এলেই আমাকে গুলি করে মেরে ফেলার ফন্দি করেছে ওরা। বললেন, আপনি কখনও রুম থেকে বের হবেন না। আমি তাই রুমে বহু কষ্ট সত্ত্বেও আবদ্ধ থেকেছি, বের হইনি। আমার জান বাঁচল বটে, কিন্তু ওরা কেমন লোক বুঝতে আর বাকি রইল না, হিংস্র হায়েনা থেকেও অধম। সে কাশ্মীরি লেফটেন্যান্ট ভাইটি যে আমার সঙ্গে কথা বলেছে ওরা বােধহয় জানতে পেরেছে তাই ভাইটি আর রক্ষা পেল না, তাকে গুলি করে মেরে এর প্রতিশােধ নিয়েছে। ”বাংলার মাটিকে ভালােবেসে বাংলার নেতাকে ভালােবেসে কাশ্মীরি এই নাম ভাইটির কী অবদান, সেটা কি কেউ ভেবেছে বাংলার স্বাধীনতার জন্য তার এই ত্যাগ, আত্মােৎসর্গ ইতিহাসের নীরব খাতায় লেখা হয়ে আছে। সেদিন যদি সে লেফটেন্যান্ট শেখ মুজিবকে সতর্ক না করতেন অবশ্যই তিনি ক্যান্টনমেন্ট থেকে হয়ে আসতেন, বাংলাদেশও চিরদিনের জন্য তাদের দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে যে আবার শত কি হাজার বছর পরে কোনও এক শেখ মুজিবের জন্ম হলে সে শত বাংলাকে স্বাধীন করত। অথবা করত কি করত না সেটা তর্কের সামগ্রী। বলা হয়ে থাকে শেখ মুজিব মানে বাংলাদেশ। সে কথা বাংলাদেশের জন্য চিরদিনের সত্য। যেমন শেখ মুজিব না হলে বাংলাদেশ হত না, শেখ মুজিবকে হত্যা করে বাংলাদেশের অগ্রগতি ঘুরিয়ে একশ’ বছর পেছনে নেওয়া হয়েছে। পৃথিবীর সর্বনিকৃষ্ট দেশে পরিণত করা হয়েছে। যতদিন শেখ মুজিবের আদর্শ ফের বাংলাদেশে প্রবর্তিত না হবে, বাংলাদেশের অস্তিত্ব নিকৃষ্টই থাকবে। আশা করা যায় তার কন্যা এখন দেশের হাল ধরেছেন। পিতার আদর্শকে জীবিত করে অচিরে বাংলাদেশকে বিশ্বের সম্মানিত স্থানে নিয়ে যাবেন! শেখ মুজিব আগরতলা ষড়যন্ত্র করে পাকিস্তানের ক্ষতি করেছেন- কোনও বাঙালি এ কথা বিশ্বাস করেনি। প্রতিদিন গােয়েবলসীয় রীতিতে মামলার বিবরণ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠা জুড়ে ছিল। গােয়েবলস ছিলেন হিটলারের প্রচারমন্ত্রী, তাঁর নীতি ছিল যে কোনও মিথ্যা দশ বার সত্য বলে প্রচার করা হলে সে মিথ্যা সত্য বলে প্রতিপন্ন হয়। কিন্তু বাঙালিরা গােয়েবলসকে জানে আর জানে আইয়ুব খানকে এবং পরবর্তীকালে তার দোসরদেরও। শেখ মুজিবকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে মিছিল হয়, পুলিশ মিছিলে লাঠি চালায়, কিন্তু ছত্রভঙ্গ করতে না পেরে গুলি করে অনেককেই হতাহত করল।

এতে করে গণঅভুথান শুরু হয়। মওলানা ভাসানী মাঠে নামেন, একমাত্র মােনায়েম এবং নুরুল আমিন ছাড়া বাংলার সকল রাজনৈতিক নেতাকর্মী হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করে। অভ্যুথান শুধু ঢাকাতে সীমাবদ্ধ থাকে না, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, ময়মনসিংহ, সিলেট সর্বত্র দাবানলের মতাে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। সর্বত্র পুলিশের গুলিতে দুই একজন করে প্রাণ হারায়। শত শত নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। ক্রমে এই দমননীতি উল্টো ফল দিতে শুরু করে। পুলিশ নির্দেশ পেয়েও গুলি চালায় না। সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত হরতাল আহ্বান করলে পুরােপুরি হরতাল পালন করে। গণঅভ্যুথান উত্তরোত্তর আরও কঠোর এবং ব্যাপক বেগে সারাদেশে সঞ্চারিত হতে থাকে। মুজিব হত্যার পরে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র তার চরিত্র হনন নিয়ে ফের গােয়েবলসায় প্রচারনীতি শুরু করে। আগরতলা ষড়যন্ত্র আবার পত্রিকার পৃষ্ঠায় দেখা গেল, ভাড়াটে বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকদের তথাকথিত জানা প্রতিবেদন বের হল। আবার বলা হতে লাগলো শেখ মুজিব সত্যি সত্যি আগরতলায় অনুপ্রবেশ করেছিলেন।

১৯৬৩ সালে তৎকালীন এিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহ তাকে এ কাজে সাহায্য করেন এবং মন্ত্রীর ভাগ্নির বাড়িতে শেখ মুজিবকে রেখে এ কাজ হয়েছে। শচীন্দ্রলাল প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহেরুর সঙ্গে যােগাযােগ করেন। নেহেরু সম্মত হন নি বিধায় সে যাত্রা বিফল  মনে  করার পর শেখ মুজিবকে ফিরে আসতে হয়। শচীন্দ্রলালের উক্তি উদ্ধৃত করে তথাকথিত সমপন্থি মুজিববিরােধী ফয়েজ আহমেদ এক কেতাবও কেঁদেছেন এ কারণে যে আগরতলা ষড়যন্ত্র এবং আর যন্ত্র মুজিবের ছিল। কে নাকি কলকাতা থেকে লিখেছে মজিবকে পুশব্যাক করা হয়েছিল। এ কথা দেখা হল না ১৯৬৩ সালের বেশিরভাগ সময় শেখ মুজিব তাঁর বাসস্থান ‘ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারেই’ ছিলেন, বাকি সময়টা পাকিস্তানি গােয়েন্দা ও পুলিশের নজরে নজরে ছিলেন। কী করে আগরতলা গেলেন? সে গােয়েন্দারাই হয়তােবা এ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিল।   অন্য একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, করাচি থেকে নাকি এ ষড়যন্ত্রের সুত্রপাত। সােহরাওয়ার্দী তনয়া বেগম আকতার সােলেমানের বাসভবনে অভিযুক্ত সেনা কর্তাদের সঙ্গে বসে শেখ মুজিব এ কাজ করেছেন। বেগম আকতার সােলেমানের কোনও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া কখনও জানা যায় নি, নামও শােনা যায় নি। তিনি কখনও ঢাকা আসেন নি, শেখ মুজিব সােহরাওয়ার্দীর সাথে তার বাসভবনে কখনও যেতে পারেন কিন্তু এ কাজে সােহরাওয়ার্দী বা বেগম আকতার তাকে সাহায্য করেছেন এ কথা মােটেই বিশ্বাসযােগ্য হতে পারে না।

সূত্র : বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ বিজয় ও বঙ্গবন্ধুর জীবন উৎসর্গ – শামসুল আলম সাঈদ