চিরবিদ্রোহী বাংলা -পশুপতি খান
কিছুদিন ধরে পূর্ব বাঙলায় দ্রুতগতিতে যে নাটকীয় পটপরিবর্তন হচ্ছে, সেটা বিশ্বজনকে বিস্মিত করেছে। এর শেষ কোথায় কে বলতে পারে? তবে নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে, বাঙলাদেশ’ শেষ পর্যন্ত জয়লাভ করবেই করবে।
ইতিহাস কি বলে? ইতিহাসের ভিতর যাঁরা তত্ত্বানুসন্ধান করেন-অর্থাৎ ফিলসফারস অব হিস্ট্রি তাঁরা দুই দলে বিভক্ত। একদল বলেন, ইতিহাস একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করে না, অন্য পক্ষ বলেন, পৃথিবীর সর্বত্রই ইতিহাস একই প্যাটার্ন বার বার বুনে যাচ্ছে। অবশ্য দেশকালপাত্রভেদে সেগুলােতে কিছু না-কিছু তফাত থাকেই : সেটা বাহ্য হেয়।
এ বিষয়ে আমাদের মনে কণামাত্র সন্দেহ নেই যে বাঙলা দেশ গত সাতশ’ বছর ধরে একই প্যাটার্ন বুনেছে, বুনেছে, বার বার বুনেছে। তার নাম ‘বিদ্রোহ’। তাই পাঠান মােগল উভয়ই তিক্তবিরক্ত হয়ে এই গৌরভূমি লক্ষ্মণাবতীর নামকরণ করেছিল, বল্গাপুর। ফার্সী ভাষাতে বলগা শব্দের অর্থ ‘চিকার কলরােল’ ‘কলহদ্বন্দ্ব’ এবং সেখানে আরেকটা সূক্ষ্ম ইঙ্গিত রয়েছে গৌড়জন (ফার্সীতে বাঙলা দেশের জন্য প্রায়শ গৌড়’ শব্দ ব্যবহৃত হত) কারােরই আদেশ মানতে চায় না। তাই একাধিক বিদেশী ঐতিহাসিক এই ‘কুখ্যাত’ বল্গাপুর নামের অনুবাদ করেছেন ‘দি সিটি অব রেবেলিয়ান।’ অতএব ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ বাঙালি কমিনিস্ট ভায়াদের এমন কিছু হৃদপিণ্ডরক্তদ্রুতগামিনী অভিনব আবিষ্কার নয়। অবশ্য করজোড়ে আমরা এস্থলে একটা বিষয়ে একমত। তাঁরা হলেন ‘অর্থনৈতিক কারণ ভিন্ন কোনাে বিদ্রোহ, কোনাে ঐতিহাসিক যুগ পরিবর্তন হয় না। এস্থলেও তাই। দিল্লী সে এই বিদ্রোহী গৌড়ভূমির বিরুদ্ধে উত্তপ্ত হয়ে কটু নামকরণ করেছিল, তার একমাত্র কারণ বঙাল’ দেশের লােক সে রীতিমত ওক্তমাফিক খাজনা পাঠায় তাই নয়, সুযােগ পেলেই (এবং সুযােগ না পেলেও ব্যাটারা চানস নেয়া ওরা দিল্লীর প্রাপ্য একটা কানাকড়িও পাঠায় না। অথচ ওদেশের কি অর্থের অভাব! স্থূলতম হস্তী (ত্রিপুরা) থেকে সূক্ষ্মতম মুসলিন (ঢাকা) ওরা সুদূর চীন থেকে ফিরিঙ্গি মুলুকে রপ্তানী করে প্রচুর অর্থলাভ করে। দিল্লীর হুজুররা এর কিছুটা পেলে বড়ই আপ্যায়িত হন। যাকে আজকের দিনে ভাষায় বলে ফরেন একসচেনজ। হুজুরদেরও দরকার বিদেশ থেকে এটা-ওটার।
কিন্তু প্রশ্ন এই “বাঙাল গোয়াররা দিল্লীর শাহ-ইন-শাহ বাদশাহ, বাদশাহ-ই-দীন ও দুনিয়া (ধর্ম ও পৃথিবী উভয়ের অধিপতি), জিলুলাহ (ধর-ধামে আল্লাতালার ছায়াবৎ)- এঁকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন করতে কোন সাহসে?
আজ পূর্ববঙ্গে যা হচ্ছে সেটা তারই পুনরাবৃত্তি। সেই প্রাচীন প্যাটার্ন।
(১) এদের ভৌগােলিক পার্থক্যটা আপনি গজনী কান্দাহার তাশক সমরকন্দ যেখান থেকেই বেরােন নাকেন এমন নদনদীর আশ্চর্য প্রাচুর্য এই বাঙলাদেশে না পৌছনাে পর্যন্ত এমন নদনদীর আশ্চর্য অপ্রাচুর্যতা পাবেন না। ব্রহ্মপুত্র পদ্ম যে এদেশকেও রক্ষা করার জন্য কী ব্ৰহ্মদত্ত বর্ম সেটা পাঠান-মােগল তুর্কঔজবেক সবাই জানতাে। তাদের দেশে যে-সব নদী আছে সেগুলাে বর্ষার কলকাতার তিনদিন বরাবর বৃষ্টির পর রাস্তায় যে জল জমে নদনদী সৃষ্টি করে তার কাছেও হার মানবে। পদ্মা মেঘনা বাদ দিন। এদেশ জয় করা অসম্ভব নয়। সেটা তাে আর এমন কিছু নতুন কথা নয়। আজ রাশা বা আমেরিকা, কন্টিনেন্টের বৃহত্তম দেশ জর্মানির উপর গােটা চারেক এটম বম্ ফেলে তাকে পদানত করতে পারে। কিন্তু তার উপর রাজত্ব করা? সে তাে সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার।
আজ সিংহলের; “সহায়তায় পশ্চিম পাকিস্তান প্রাণপণ সৈন্য পাঠাচ্ছে। পাঠাক। তাতে ভীত হবার কী আছে? অবশ্য জানি, আজকের দিনে, পদ্মা-মেঘনা বম্বার ফাইটার ঠেকাতে পারবে না একদা সে রকম বর্ষাকালে দিল্লীর স্বর্গাধিকারপ্রমত্তদের ঠেকিয়ে রাখতে পারতাে। বাঙলাদেশেরই এক ঐতিহাসিক বলেছেন, পদ্মার উত্তাল তরঙ্গ জল দেখামাত্রই কাবুল-দিল্লীর সেনাবাহিনীর ঠোটের জল শুকিয়ে যেত। কিন্তু কাহিনীর শেষ তাে এখানেই নয়। এখানে সে বক্তব্য সর্বাতিশয় গুরুত্বব্যঞ্জক সেটি এই : ভৌগােলিক অবস্থার পরিপূর্ণ সুযােগ নিয়ে, পাঠান মােগলকে (পূর্ববর্তী হিন্দুযুগেও নিশ্চয়ই তাই ছিল; নইলে রাতারাতি তাে কোনাে একটা জাত অকস্মাৎ বীরর্ষভে পরিণত হয় না) যারা যতদূর সম্ভব মাতৃভূমিধর্ষণ থেকে ঠেকিয়ে রেখেছিল, কখনাে হার মেনেছে কখনাে জিতেছে, তারা আপন জানা-অজানাতে বীর বংশের সৃষ্টি করে। আজ পদ্মা-মেঘনা জনাব ইয়াহিয়া খানের কাছে দুর্লঙ্ নয়বােমারু বিমানাদি তার বিস্তর আছে। তারা নদনদীর বাধা মানে না। তিনি হয়তাে কারপেট বম্বিং করে পূর্ব বাঙলাকে ধরাশায়ী করে দেবেন। তাঁর শেষ মরণকামড় দেবেন। কিন্তু ঐ বীরের দেশের উপর তিনি রাজত্ব করতে পারবেন না, রাজত্ব করতে পারবেন না। পূর্ব বাঙলার লােক অধিকাংশ মুসলমান। তবুও তারা দিল্লীর পাঠান-মােঘল যুগের স্বধর্মীয়মুসলিম শাহই-শাহদের বিরুদ্ধে লড়াই দিয়ে স্বধীনতা অর্জন করতে চেয়েছে।
আনন্দবাজার : ২৪.৩.১৯১১
Reference:
গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – মুনতাসীর মামুন