বাংলার বাণী
ঢাকা : ১লা ডিসেম্বর, রোববার, ১৯৭৪, ১৫ই অগ্রহায়ণ, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ
তরা সেতু উদ্বোধন : অতঃপর (!)
আজ থেকে তরা সেতু চালু হচ্ছে। ঢাকা-আরিচা সড়ক পথে বাংলাদেশের দক্ষিণ বা উত্তরাঞ্চলে যারা যাতায়াত করে থাকেন, তরা সেতু উদ্বোধনের খবর তাদের কাছে নিঃসন্দেহে যুগপৎভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও আনন্দের। মিরপুরে বৃটিশ আমলের তৈরী সরু হালকা এবং বিপদজনক সেতু পার হওয়ার জন্য দীর্ঘ লাইন, এরপর নয়ারহাট ও তরাঘাটে খেয়া পারাপারে সুদীর্ঘ প্রতীক্ষা এবং কম করে হলেও এর জন্য অযথা সাত-আট ঘন্টা সময় ব্যয়—তাই আজ থেকে এই পথে যাতায়াতকারী মানুষের সর্বশেষ বাঁধাটিও অপসারিত হলো। এ বছরের গোড়ার দিকে মিরপুরের নতুন সেতু চালু, সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে নয়ারহাটের বংশী সেতু উদ্বোধন এবং আজ তরা সেতু চালুর মধ্য দিয়ে সাধারণভাবে ভাবতে শুরু করা যায়—রাজধানীর সাথে দেশের উত্তর বা দক্ষিণাঞ্চলের সড়ক পথের দূরত্ব সময়ের দিক দিয়ে অনেকখানি কমে গেল। সরকার তথা যোগাযোগ দপ্তর জনগণের দুর্দশা লাঘবের জন্য প্রশংসার দাবীদার এবং আমরা সরকারকে এ জন্য আন্তরিকভাবে অভিনন্দিত করছি।
কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই যেন এ সম্পর্ক একটি বিরাট জিজ্ঞাসা থেকে যাচ্ছে এবং তার হলো : জনগণের পথের ক্লান্তি আর দুর্দশা লাঘবের জন্য সরকারের সপ্রশংস প্রচেষ্টার ফসল এ পথের যাত্রীরা সহজে লাভ করতে পারবে কি? এ কথা অবশ্যই ঠিক যে, মিরপুর, নয়ারহাট এবং আজকের তরা সেতু উদ্বোধনের পূর্ব পর্যন্ত মিরপুরের সরু ও হালকা ব্রীজে গাড়ী পারাপার, নয়ারহাট ও তরাতে খেয়া পারাপারের সামগ্রিক দীর্ঘ সময়টা খন্ড খন্ডভাবে এ তিন জায়গাতেই ব্যয় হতো। ফলে আরিচা ঘাটের উপর এক সঙ্গে অনেকগুলো গাড়ীর চাপ বাহ্যতঃ না পড়ারই কথা ছিল। কিন্তু যেহেতু আরিচা-নগরবাড়ী এবং আরিচা-গোয়ালন্দ পথে চলাচলকারী ফেরীর সংখ্যা কোনোদিনই তিনটির বেশী করা হয়নি সেজন্য বরাবরই আরিচাতে যেয়ে অধিকাংশ যাত্রী ও মালবাহী ট্রাকগুলোকে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে অনিশ্চিত প্রহর গুণতে হয়েছে। রাস্তার এক ধারে ট্রাকগুলো দীর্ঘ লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে ; থাকা-খাওয়ার উপযুক্ত ব্যবস্থার অভাবে অসংখ্য নারী-পুরুষ ও শিশুকে প্রতিদিন অশেষ হয়রানি ভোগ করতে হয়েছে।
সুতরাং তথ্যাভিজ্ঞ মহলের কাছে আজ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, খন্ড খন্ডভাবে তিন জায়গাতে যে সময়টা ব্যয় হতো, তাতে করে স্বাভাবিকভাবেই আরিচার উপর একসাথে বহুসংখ্যক গাড়ীর চাপ প্রতিহত হয়েছে। কিন্তু আজ থেকে যে নতুন সমস্যা সৃষ্টি হতে চলেছে সরকার বা সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা তা কতখানি ভেবে দেখেছেন জানি না। কারণ ইতিপূর্বে স্বাভাবিকভাবে গাড়ীর চাপ নিয়ন্ত্রণের পরও আরিচাঘাটে মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখ দুর্দশা ফেরীর অভাবে সমানে রয়েছে দিনের পর দিন। আজ তরা সেতু উদ্বোধনের পর রাজধানী থেকে দক্ষিণ ও উত্তরাঞ্চলগামী স্বাভাবিক গাড়ীর স্রোতের সাথে তাল রাখতে ঐ ৩টি ফেরীর সামর্থ কতটুকু? এতে করে আরিচাঘাটে অসহায় যাত্রীদের দুর্দশার অবসান হবে, না অনিশ্চিত প্রতীক্ষার প্রহরগুলো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে, সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের কাছে আজ সেই প্রশ্ন।
আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি নিষিদ্ধ প্রসঙ্গে
আইরিশ রিপাবলিকান আর্মিকে বেআইনী ঘোষণা করে বৃটেনে একটি আইন পাশ হয়েছে। আইরিশ সন্ত্রাসীদের মোকাবেলার জন্য এ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এই নতুন আইনের দ্বারা গ্রেফতার, আটক, তল্লাশী ও সন্দেহজনক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। এবং সকল প্রকার তৎপরতার উপর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বলবৎ করা হবে। আইনে বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে যে, সন্দেহজনক সন্ত্রাসবাদীদের ও তাদের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের বৃটেন হতে বহিষ্কার করা হবে। আইরিশ রিপাবলিকান আর্মিতে যোগদান, চাঁদা গ্রহণ বা প্রদান, সভা আহ্বান কিংবা সভায় যোগদানও ঐ আইনে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আইন অমান্য করলে পাঁচ বছর কারাদন্ড ও অনির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জরিমানা করার ব্যবস্থা রয়েছে। আইরিশ রিপাবলিকান আর্মিকে বৃটেন সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে যে সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন তা নিঃসন্দেহে প্রণিধানযোগ্য বিষয়। আইরিশদের উপর বৃটিশ কর্তৃত্ব আরো জোরদার করার মানসে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বি.বি.সি’র মতে শান্তিকালীন অবস্থায় বৃটেনে এ জাতীয় আইন প্রণয়ন এক নজিরবিহীন ঘটনা। বিলটি পরিষদে উত্থাপন করেছেন বৃটেনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি পার্লামেন্টে বিলটি উত্থাপনের সময় বলেছেন—‘নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি এই বিলটি পরিষদে পেশ করছি। এই বিলটিতে আমাকে এবং পুলিশকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তাতে চিরাচরিত মৌলিক অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ বলে মনে করা যেতে পারে।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উল্লেখিত এ উক্তি থেকেই বোঝা যায়—বিলটি বৃটেনের জনগণের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে একটি মারাত্মক আঘাতস্বরূপ। যদিও বৃটেনের ক্ষমতাসীন সরকারের বিরোধীরাও বিলটির স্বপক্ষে মতপোষণ করেছেন। বস্তুতঃ উত্তর আয়ারল্যান্ডের মানুষের বহুদিনের দাবী তাদের স্বাধিকারের স্বপক্ষে। বৃটিশ সাম্রাজ্যের ক্ষয়িষ্ণু দাপট আজও আইরিশদের উপর বহাল রয়েছে। মানবতাবিরোধী এই হীন স্বার্থের বিরুদ্ধে আইরিশরা বহুকাল ধরে সংগ্রাম করে আসছে। গত ১৯৬৯-৭০ সালের দিকে বিষয়টি আরো প্রকট হয়ে দেখা দেয়। ইংরেজ জাতির বহুকালের পুরনো ধর্মীয় সমস্যার জের আজো আয়ারল্যান্ডে বহাল রয়েছে। এবং বৃটিশ নেতৃত্ব তাদের উদ্দেশ্য চরিতার্থের জন্য ধর্মীয় সমস্যাটি জিইয়ে রেখেছে। বৃট্শি উপনিবেশগুলোতে সর্বদাই বৃটিশ শাসকরা তাদের নিজেদের স্বার্থে ধর্মকে একটি হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছে। গত ১৯৭০ সালের পর অধিকাংশ আইরিশ ক্যাথলিকদের দাবীর প্রশ্নে বৃট্শি কর্তৃপক্ষ একটি আপোষের চেষ্টা নিয়েছিল, কিন্তু তা ছিল নিতান্তই মূল সমস্যা এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল। এরপর আইরিশরা তাদের পূর্ণ স্বাধীনতা দাবী করে এবং সেইসাথে সংগঠিত হতে থাকে। সশস্ত্র লড়াইয়েরও সূচনা হয়। আইরিশ বিদ্রোহীদের একাংশ সন্ত্রাস বা বোমাবাজির মাধ্যমে যে তৎপরতা শুরু করে তাও গোটা আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করতে পারেনি। বৃটিশ সরকার তার ঔপনিবেশিক ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার নিমিত্তে আই.আর.এ-কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। কিন্তু আমরা মনে করি, এই পদক্ষেপ দ্বারা আইরিশদের স্বাধীনতা সংগ্রাম স্তব্ধ করা যাবে না। সমস্যার সমাধানও হবে না। সাম্রাজ্যবাদী নীতি পরিহার করে আইরিশদের দাবী-দাওয়ার প্রতি ন্যায়সঙ্গত সম্মান প্রদর্শন করাই হবে যুক্তিযুক্ত কাজ। অন্যথায় আইন পাশ করে আই.আর.এ-কে নিষিদ্ধ করে দিলে সমস্যা আরো ঘোলাটেই হবে—সংকট তীব্রই হবে।
ওজনের হেরফের
ভাঙা ও ফুটো ছাদযুক্ত ওয়াগনে লবণ আমদানী করার জন্য ওজনের হেরফের হয়েছে বলে পত্রিকান্তরের প্রতিবেদন সূত্র জানাচ্ছে। ১২০০ শত টন (৩২ হাজার ১৪৬ মণ) লবণ আমদানী করার ব্যাপারে যে ৬০টি রেল ওয়াগন ব্যবহার করা হয়েছিল তার মধ্যে ৩০টিরও বেশী ছিল ভাঙা ও ফুটো। ফলে বৃষ্টির পানিতে ভিজে অনেক লবণ গলে নষ্ট হয় এবং কোনো কোনো বস্তায় সোয়া মণ কিংবা তারও কম লবণ পাওয়া যায়।
নিঃসন্দেহে দুঃখজনক সংবাদ। আমদানীকৃত লবণের ওজন হ্রাসের কথা ছাড়াও দেশের অভ্যন্তরে কেনা বেচায় ওজনের কারচুপিও ব্যাপকহারে জনজীবনকে আজ বিপর্যস্ত ও বিপদগ্রস্ত করে তুলেছে। বাজার হাটের সওদায় কমতি থাকবেই, পাইকারী ক্রেতাকে ওজনগত কারণে লোকসান দিতেই হবে, ছোটখাটো দোকানদারও কম যায় না, আর রেশনের দোকানী তো ওজনে মারার মহারাজা। প্রতিদিন প্রতিটি দ্রব্যের ওজন ঠকিয়ে তারা প্রচুর উদ্বৃত্ত মালের অধিকারী হচ্ছে এবং ফাঁকিবাজি ও জুয়াচুরির টাকায় লাল হয়ে উঠছে।
বহুসূত্রের এবং বহুমুখের অভিযোগে জানা যায়—অনেক রেশন দোকানদার চিনি ও লবণে পানি মিশিয়ে ওজন ভারী করে। তারা পাল্লা ঝুঁকিয়ে গম ও চালের ওজনও মেরে দেয়। এসব ওজন সের প্রতি তোলা বা ছটাকে মারা হয় না—এর পরিমাণ অনেক বেশী। কীর্তিমান বিক্রেতারা তো ১০ সের গমের ওজনে চুরি করে রাখতে পারে দুই সের বা আড়াই সের পর্যন্ত। কিন্তু কিছুই বলবার জো নেই। অভিযোগকারীরা বলে থাকেন, উঁচু তলায় নালিশ করেও হয় না কোনো লাভ। কারণ মন্দ লোকে বলে—লাভের অংশ নাকি অনেক তলাতেই যায়।
একেতো আমাদের দেশে এখনো ওজনের মাপ সর্বত্র এক রকমের নয়। ৬০ তোলা বা ৮০ তোলায় সেরের কাঁচা-পাকা মাপ তো আছেই—এছাড়াও আছে গ্রামাঞ্চলের ১০০ তোলা বা ১১০ তোলায় সেরের মাপ। সেইটেরও একটা বিহীত করা এবং সারাদেশে একই মাপের ওজন চালু করা অবশ্য প্রয়োজন।
আমরা জানি, সাধারণতঃ মানুষ পরিচালিত হয় ধর্মবোধ, ন্যায়নীতি বা বিবেকবুদ্ধির দ্বারা। মহামানবদের কথা নয়—সাধারণ মানুষের বেলায় তো ঐগুলোই প্রযোজ্য এবং ওজনে মেরে দেয়াটা ঐ সমস্ত দৃষ্টিকোণ থেকে গর্হিত অন্যায় বলেই বিবেচিত। তাই আমদানীকৃত মালে কিংবা সাধারণ জীবনের নৈত্য-নৈমিত্তিক কেনা বেচায় এই যে ওজনের ঘৃণ্য কারচুপির প্রকাশ্য প্রচার এতে মানুষ ও জাতি হিসেবে আমাদের গৌরব বর্ধিত হবার কথা নয়। অতএব ধর্মবোধ, ন্যায়নীতি বা বিবেকবুদ্ধির যে কোনো একটির দোহাই মেনে হলেও ওজন চুরির একটা কড়া নিষ্পত্তি চাই আমরা।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক