আইয়ুব খানের মার্শাল ল নির্যাতন
পাকিস্তান হল প্রতিক্রিয়াশীল সুযােগ শিকারিদের লীলাক্ষেত্র, গণতন্ত্রের আলাে-ছায়া তবু কতকটা বিরাজ করত প্রাথমিক স্তরে, ১৯৫৬ সালে ইসলামিক প্রজাতান্ত্রিক পাকিস্তান রাষ্ট্র নাম গ্রহণ করেছিল। সামান্য একটু পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক নির্বাচন উকি দিয়েছিল। তাকেও টুটি চেপে ৯২ক ধারা দিয়ে লাঠি পেটান দিল, তারপরও একটা পরােক্ষভাবে নির্বাচিত কেন্দ্রীয় গণপরিষদ দ্বারা দেশে গণতন্ত্র গণতন্ত্র খেলা হচ্ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের। সামরিক ও বেসামরিক স্বার্থবাদীরা তাও সহ্য করল না। বন্দুকের নলের আঘাতে তা উড়িয়ে দিল, পাকিস্তান সেনাপতি আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট ইসকান্দার মির্জাকে এক বস্ত্রে লন্ডনগামী বিমানে তুলে দিয়ে দেশে মার্শাল ল’ জারি করলেন। সংবিধান রহিত করে দিলেন সংবিধান ছাড়া কোনও দেশের শাসন ব্যবস্থা চলতে পারে না। বিচারালয় কি আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত থাকবে না? সামরিক আইন বিচার ব্যবস্থা দখল করবে কি? এটা হতে পারে না। কিন্তু কৃত্রিম রাষ্ট্র পাকিস্তানে তা হল । একটা দেশের প্রেসিডেন্ট শূন্য হাতে লন্ডন গিয়ে কোনও হােটেলের ম্যানেজার হল। অবশ্য এর আগে ইসকান্দার মির্জাকে দিয়ে গণপরিষদ বাতিল করানাে হয়েছিল। প্রেসিডেন্টের শাসন চালু করার একটা স্বপ্ন তাকে দেখানাে হয়েছিল। কিন্তু রাতের আঁধারে তা ধূলিসাৎ হয়ে গেল ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর। আর আইয়ুব খান তার বদলে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়ে বসলেন। আইয়ুব খানের ধুয়া ছিল দুর্নীতিমুক্ত পাকিস্তান বানাতে হবে। দেখা গেল শুরু থেকে দুর্নীতিই হল পাকিস্তানের নীতি কোনও জবাবদিহিতা নেই। কথায় বলে মিলিটারিদের বুদ্ধি হল তাদের হাঁটুতে। তাই যেখানে ইচ্ছা বুটের লাথিতে সব ঠিকঠাক করতে লাগল। প্রথম লাথি লাগল পূর্ব বাংলার ওপর সমস্ত রাজনৈতিক কর্মি ও নেতাদের আটক করা হল। পূর্ব বাংলা থেকে যাবতীয় সম্পদ অবাধে পাচার করা হল পশ্চিম পাকিস্তানে। আইয়ুব খান করাচি থেকে রাজধানী সরিয়ে ইসলামাবাদে স্থানান্তরিত করলেন, তার সিংহভাগ খরচ বহন করল পূর্ব পাকিস্তান। পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দূরে থাক যে কোনও অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হল, যে কোনও রাজনৈতিক মত প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হল। ঘােষণা দিলেন রাজনীতি পাকিস্তানের জন্য নিষিদ্ধ। বস্তাপচা প্রাচীন জিকির শুরু করা হল, পাকিস্তানে ইসলামি শাসন কায়েম করা হবে। ইসলামের নামে শােষণ করা উৎকৃষ্ট শােষণ, আইয়ুব খান তার সদ্ব্যবহার করলেন। তিনি পুনরায় দ্বিজাতিতত্ত্ব পাকিস্তানের জন্য কায়েম করলেন, অথাৎ পাকিস্তানে অমুসলিম কেউ থাকতে পারবে না।
পূর্ব বাংলা থেকে ব্যাপকহারে হিন্দু বিতাড়ন করা হল, সঙ্গে সঙ্গে মৌলবাদের শিকড় দৃঢ় করে দিলেন আইয়ুব খান। সারা পাকিস্তানে, বিশেষত পূর্ব বাংলায় মৃত্যুর মতাে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে যেন লাশ পড়ে আছে, কেউ টু শব্দ করার সাহস করে না। রাস্তাঘাটে, সিনেমার পর্দায় কেবল চি বুটের টুক টুক আওয়াজ, আর সারাদেশ থেকে আইয়ুবের সেলাম গ্রহণ ছাড়া আর রে দৃশ্য নেই। ১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশন গঠন করে এমন একটি কৌশল করা হল যে উচ্চ শিক্ষার নাগাল সকলের জন্য রইল না আর শিক্ষার ব্যয় ভার খুব বাড়িয়ে দেওয়া হল তাতে করে দেশে অনগ্রসর শ্রেণি শিক্ষা বঞ্চিত থাকবে এবং শিক্ষার হার ক্রমে নিচে নেমে গিয়ে অশিক্ষিত জনগােষ্ঠীতে রূপান্তরিত হবে, তারা জীবনের অধিকার সম্বন্ধে কখনও আর সচেতন হতে পারবে না। উচু তলার মানুষ তাদের থেকে সহজে ফায়দা আদায় করে নিতে পারবে। এমনি করে এ জাতি অন্ধ ও বিবেকহীন হয়ে পড়বে। কিন্তু বাংলাদেশের বিপ্লবী ছাত্র সমাজ দেশের মরা লাশের ওপর দাঁড়িয়ে এর বিরুদ্ধে সােচ্চার হল এবং রুখে দাঁড়াল। এই প্রথম বারের মতাে আইয়ুব খানের স্বেচ্ছাচারিতা ধাক্কা খেল। কঠোর হস্তে ছাত্রদের ওপর ডাণ্ডা ঘুরিয়ে দমন করতে গেলেন। বাংলা ভাষার দাবি ও শহীদ স্মৃতি একুশে ফেব্রুয়ারির সকল কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে দিলেন আইয়ুব খান। পুনরায় রবীন্দ্র সঙ্গীতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হল। কিন্তু এটা করতে গিয়ে আইয়ুব খান বাঙালির কলিজার বোঁটা ধরে টান দিলেন। মরার আগে শেষ প্রয়াস দিয়ে বাঙালি তার সে ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিল; আইয়ুবের শিক্ষামন্ত্রী মঞ্জুর কাদির ঢাকা এলে তাকে ছাত্ররা প্রচুর লাঞ্ছনা করে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রবেশ করতে পারলেন না। ছাত্রদের শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন থেকে আইয়ুবের পতনের সূচনা ঘটল।
সূত্র : বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ বিজয় ও বঙ্গবন্ধুর জীবন উৎসর্গ – শামসুল আলম সাঈদ