ছাত্র রাজনীতি ও ভাষা আন্দোলন ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছে ১৯৪৭ সালে পাবিস্তান হাসিলের পর পরই, মুসলমান বাঙালিরাই বলতে গেলে পাকিস্তান আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেছিল। এবং পাকিস্তান সৃষ্টির হওয়া মাত্রই তাদের আশা ভঙ্গ হয়েছে। প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যারা প্রগতিশীল চিন্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন, যেমন মােহাম্মদ তােয়াহা, অলি আহাদ, তাজউদ্দিন আহমেদ, কমর উদ্দিন আহমদ প্রমুখ কয়েকজন ছাত্র-যুবক, গণ আজাদী লীগ’ গঠন করেন সেপ্টেম্বরে ‘৪৭, তাদের ‘আশু দাবি কর্মসূচিতে প্রথম বাংলা’ হবে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এর কারণ হল মূলত ১৯৪৬ সালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে মত প্রকাশ করেন এবং জিন্নাহকে এ প্রস্তাব পাঠান। তখনই বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল, সেপ্টেম্বর ১৫, ১৯৪৭ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী মােতাহের হােসেন এবং ইত্তেহাদ সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদ ভাষা বিষয়ক প্রস্তাবে উর্দু বদলে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বাংলাকে সমর্থন করেন। তারপরই ‘আশু দাবি কর্মসূচি’ এইরূপ প্রস্তাবটি গৃহীত হয়, তা এই
১। বাঙলা ভাষা হবে। ক. পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন। খ, পূর্ব পাকিস্তানের আদালতের ভাষাগ. পূর্ব পাকিস্তানের অফিসাদির ভাষা ২। পাকিস্তনের কেন্দ্রিয় সরকারের ভাষা হবে উর্দু ও বাংলা। ৩ ক, বাংলাই হবে শিক্ষা বিভাগের প্রথম ভাষা। ইহা পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা একশত জনই শিক্ষা করেন। খ, উর্দু হবে দ্বিতীয় ভাষা বা প্রাদেশিক ভাষা। যারা পাকিস্তানের অন্যান্য অংশে চাকুরি ইত্যাদি কাজে লিপ্ত হবেন তারাই শুধু এ ভাষা পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষা করবেন। তাতে এখানে শতকরা ৫ থেকে ১০ ভাগ শিক্ষা হলেই চলবে মাধ্যমিক স্কুলের উচ্চতর শ্রেণিতে এ ভাষা দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে শিক্ষা দেওয়া হবে। গ, ইংরেজি হবে পূর্ব পাকিস্তানের তৃতীয় ভাষা ও আন্তর্জাতিক ভাষা, পাকিস্তানের কর্মচারী হিসাবে যারা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে চাকুরি করেন বা যারা উচ্চতর বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য নিয়ােজিত হবেন তারাই পূর্ণ ইংরেজি শিক্ষা করবেন। তাদের সংখ্যা পূর্ব পাকিস্তানে হাজার করা একজনের বেশি নয়। ঠিক এই নীতি হিসাবে পশ্চিম পাকিস্তান প্রদেশগুলােতে ওখানের ভাষা বাংলা দ্বিতীয় ভাষা আর ইংরেজি তৃতীয় ভাষার স্থানাধিকার পাবে।
ঘ. শাসনকার্য বিজ্ঞান শিক্ষার সুবিধার জন্য আপাতত কয়েক বছরের জন্য ইংরেজি বাংলা ভাষাতে পূর্ব পাকিস্তানের শাসন কার্য চলবে। ইতিমধ্যে প্রয়ােজনানুসারে ভাষার সংস্কার সাধন করতে হবে।
-বদরুদ্দীন ওমর-১ম খণ্ড
ভাষা আন্দোলনকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ উপ্তি মনে করা হয়। আন্দোলন আরম্ভ হয়েছে জিন্নাহর দম্ভভরা ঘােষণা “উর্দু, অনলি উর্দু উইল বি স্টেট লেংগুয়েজ অব দি পাকিস্তান’ বলাতে কায়েদে আজমের মুখের ওপর প্রতিবাদ শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ‘নাে নাে’ উচ্চারণ-মুহূর্ত থেকে। নাে নাে উচ্চারণ করে নিরুদ্বেগে নিস্তার পেয়েছিলেন তাই কিন্তু নয়, পুলিশ আন্দোলনকারী ছাত্রদের অনেককে গ্রেপ্তার করেছিল, শেখ মুজিবকে কিছুদিন আগে, কিন্তু এতে প্রতিবাদ ও আন্দোলন দমে যায় নি, নতুন রাজনৈতিক দল সৃষ্টি হলে ভাষার দাবি তাদের মেনিফেস্টোতে স্থান পায়। এ সময় কুচক্রী মহল ১৯৫১ সালে সারাদেশে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করে দেয়। অবশ্য কলকাতার ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার জের ধরে বিহারে এক ভীষণ দাঙ্গা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানে শিখদের কচু কাটা হয়। বাংলাদেশে পাল্টা রুখে দাঁড়াবার মন-মানসিকতা। কিংবা মনােবল সংখ্যালঘুদের ভেতর ছিল না, তারা শিক্ষিত ও অগ্রসর হলেও ভীরু, এই দুর্বলতার সুযােগে ১৯৫১ সালে সুবিধাবাদীরা তাদের অনেককে ঘরছাড়া করতে পারল সহজে তাছাড়া ভারত তাদের আশ্রয় দেবার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাই বিপুল পরিমাণ বাস্তুহারা ভারতে আশ্রয় নিলেও বাস্তব ক্ষেত্রে আশ্রয় ও ভরণ-পােষণের উপযােগী ব্যবস্থা দিতে পারেনি। পূর্ব বাংলাচ্যুত হিন্দুরা একে বাংলাভাষী, তারা ভারতের অন্য অংশে গিয়ে বাস করতে চায় নি, বাঙালি আচরণ ও সংস্কৃতি নিয়ে বাইরে গিয়ে বাস করা অনেকের পক্ষে কষ্টকর ছিল। ফলে এক কলকাতার শেয়ালদহ রেল স্টেশনেই হাজার হাজার উদ্বাস্তু মানবেতরভাবে পড়ে রইল বছরকে বছর।
এদিকে ঢাকা এবং পূর্ব বাংলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলােতে ভাষা আন্দোলন গতিবেগ পেতে লাগল। কিন্তু উর্দু ভাষার বিরুদ্ধে ছাত্ররা সােচ্চার হলেও এ দেশে উর্দুর শিকড় কেবল নড়বড়ে ছিল না। মাদ্রাসাগুলােতে উর্দুর মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া হত, বিশেষত ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসার আদর্শে বাংলাদেশের সব খারেজি মাদ্রাসায় এ ব্যবস্থাই রয়েছে। কলিকাতার মাদ্রাসা-ই আলিয়ার আদর্শে সরকারি নিয়ম-পদ্ধতির শিক্ষা ব্যবস্থা বাংলা ভাষার অনুপ্রবেশ ছিল না। যে কোনও আলেম মাওলানা উর্দুর তাবেদারি করেন, ওয়াজ-নসিয়ত কিংবা ইসলামি জলসায় যদিবা ভুলভাল বাংলায় উম্মি শিক্ষিতদের হেদায়েত এবং কিছু বয়ান করে থাকেন বিশুদ্ধ উর্দু-ফার্সি তাতেও প্রায় অর্ধেক মেশানো থাকে। বাঙালি মুসলমানরা এমন ব্যক্তিকে শরীফ বা অভিজাত মনে করেন যারা উর্দুতে বাতচিত করতে পারে। বাংলা ইতর চাষাভুষার ভাষা, অনেকেই ‘হিন্দু ডি জবান’ থাকেন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৮৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও বাংলা বিভাগ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানাে শুরু হয় অনেক পরে। ভার্নাকুলার বা হা ল বাংলায় উমি অশিক্ষিতদের তাতেও প্রায় অর্ধেক মেশানাে গত মনে করেন যারা উর্দুতে হিন্দু জি জবান’ বলে নাক সিটকিয়ে থাকেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যাল ১৮৫৭ সালৈ প্রতিষ্ঠিত হলেও বাংলা বিভাগ আলাদা করে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো শুরু হয় অনেক পরে। ভার্নাকুলার বা স্থানীয় ভাষার একটি বিভাগ ছিল যাতে বাংলা, আসামি, উড়িয়া ভাষা সন্নিবেশিত ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২১ সালে।
এ বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রথমে বাংলা বিভাগ ছিল না, ছিল সংস্কৃত বিভাগের অঙ্গ হিসেবে। ১৯৩৫ সালে মুহম্মদ শহীদুল্লাহর প্রয়াসে বাংলা বিভাগ আলাদা হয়ে পূর্ণাঙ্গ বিভাগের মর্যাদা যেন পায়। প্রথমে তিনি বাংলা বিভাগের উন্নতির জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আর্জি পেশ করেও সফল হন নি। ঢাকার নওয়াবদের জবান উর্দু। পূর্ব বাংলায় রাষ্ট্র ভাষা উর্দুর দালালি করেন খাজা নাজিমুদ্দিন। জিন্নাহর মৃত্যুর পর খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল, পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন নুরুল আমিন। নুরুল আমিনের পারিবারিক ভাষা উর্দু ছিল, তবু তিনি ক্ষমতার মােহে পাকিস্তানি কায়েমি স্বার্থবাদীদের দালালি করার জন্য পূর্ব বাংলায় উর্দু ভাষার পক্ষে ছিলেন। পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদে বাংলার পক্ষে একমাত্র ধীরেন্দ্রনাথ দত্তই মত প্রকাশ করেছিলেন। পরিষদের সকল মুসলমান সদস্য উর্দুর পক্ষে ছিলেন, অন্য হিন্দু সদস্যরাও এর বিরােধিতা করেন নি। তাই কার্য বিবরণী থেকে তা এক্সপাঞ্চ করা হয়। ১৯৫২ সালের শুরুতে পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন চলাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে পরিষদে আইন প্রণয়নের জন্য দাবি তােলে, ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনগুলাে সক্রিয় হয়ে ওঠে, ১৩ ফেব্রুয়ারি ভাষা পরিষদ এর জন্য লিফলেট আকারে দাবিগুলাের যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়। ১৭ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি সিদ্ধান্ত-পাল্টা সিদ্ধান্ত হয় যে একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাজপথে মিছিল করা হবে। সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে, ছাত্ররা সরকারি নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করে মিছিল করার সিদ্ধান্ত বহাল রাখে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজের দক্ষিণাংশ, ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গন ডিঙ্গিয়ে বর্তমান মেডিকেল প্রধান গেট অতিক্রম করা কালে পুলিশ মিছিলের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। বরকত নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র গুলিবিদ্ধ হয়ে মেডিকেলের বারান্দায় লুটে পড়েন। বরকত অবশ্য মিছিলে ছিলেন না; তাই পাকিস্তানি কুচক্রী মহল রটিয়েছিল বরকত নাকি পুলিশের চর ছিল।
তাছাড়া সালাম-জব্বার-রফিক প্রমুখরাও গুলিতে প্রাণ হারাল। সে যাই হােক ভাষার জন্য আত্মােৎসর্গ পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম। বরকত যেখানে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন ছাত্ররা সেখানে একটি অস্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ করে ফেলল রাতে রাতেই, কিন্তু পুলিশ সে শহীদ মিনার গুড়িয়ে দেয়। তাতে কিছু লাভ হয় নি। শহীদ মিনার বাঙালি জাতির স্মৃতির মিনার হিসেবে বিশ্বে এখনও অবনত মস্তকে শহীদদের সালাম জানাচ্ছেই। ছাত্ররা রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই দাবি করলেও, বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে দাবি করে নি। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু থাক বা অন্য কোনও ভাষা থাক, বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে হবে এ দাবিই কেবল করেছিল। এটা সম্পূর্ণ যৌক্তিক দাবি ছিল। পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে পাঁচ কোটি, তার ভেতর পূর্ব বাংলার জনসংখ্যা ছিল সাড়ে তিন কোটি। পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যদি দাবি করত বাংলাই হতে হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা তাহলে সে দাবিও অযৌক্তিক ছিল না। দুই-তৃতীয়াংশ অধিবাসীর মুখের ভাষা বাংলা, সেই বাংলার জন্য যদি অন্যতম হিসেবে দাবি করা হয় তবে তার চেয়ে নিরীহ দাবি আর কী হতে পারে? অথচ শাসকগােষ্ঠী এটুকু দাবিও মানতে রাজি ছিল না। নাজিমুদ্দিন সদম্ভে ঘােষণা করে রাষ্ট্রভাষা হতেই হবে। পুলিশের গুলিতে ছাত্রহত্যার জন্য আমরা নুরুল আমিন নিন্দা করি কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে নিন্দা শতগুণ নাজিমুদ্দিনের জন্য তুলে রাখা উচিত। ভাগ্যের কি পরিহাস, নাজিমুদ্দিন এখন জাতীয় নেতার মতাে শহীদ মিনারের জল মাটিতে শুয়ে আছে নুরুল আমিন পাকিস্তানের জাতীয় নেতা হিসেবে পাকিস্তানের মাটিতে রয়েছেন।
সূত্র : বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ বিজয় ও বঙ্গবন্ধুর জীবন উৎসর্গ – শামসুল আলম সাঈদ