গবর্নরদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পূর্ণ বিবরণ
বুধবার বঙ্গভবনে গবর্নর প্রশিক্ষণ সম্মেলনে বাকশাল সেক্রেটারী জেনারেল এবং প্রধানমন্ত্রী জনাব এম মনসুর আলী বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহাসিক পটভূমি এবং তৎকালীন আওয়ামী লীগের ভূমিকা প্রসঙ্গে যে ভাষণ দেন তার পূর্ণ বিবরণ:
বন্ধুগণ,
আজকের আলােচনার বিষয়বস্তু, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহাসিক পটভূমি এবং তকালীন আওয়ামী লীগের ভূমিকা বাঙালি জাতির ইতিহাস, বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস, বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর দল আওয়ামী লীগের ইতিহাস এক এবং অভিন্ন। এর কোন একটাকে অন্য একটা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না। কেননা আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছিল ক্ষমতা দখলের জন্য নয়, বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের সার্বিক রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের জন্য। একদিক দিয়ে সাধারণত রাজনৈতিক দলের ভূমিকা ক্ষমতা দখল কিন্তু আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছিল বাংলার মানুষের সার্বিক রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য ক্ষমতা দখলের জন্য নয়।
তৎকালীন পাকিস্তানী শাসকগােষ্ঠী ষড়যন্ত্র করেছিল, সেই ষড়যন্ত্রের প্রত্যেক পর্যায়ে আমরা লক্ষ করেছি, বাঙালি জাতিকে চিরদিনের জন্য গােলাম করে রাখার জন্য চেষ্টা করা হয়েছিল। তারা ষড়যন্ত্র করেছিল বাংলাকে একটা কলােনী হিসাবে ব্যবহার করার জন্য। সেই ষড়যন্ত্র বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন এবং তখন থেকে আওয়ামী লীগের জন্ম হয় এই ষড়যন্ত্রকে মােকাবিলা করার জন্য। তাদের ষড়যন্ত্র আমরা বুঝতে পারি। প্রথম তাদের ষড়যন্ত্র হয় একমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য। কিন্তু প্রত্যেকে আপনারা জানেন যে যদি কোন জাতিকে গােলাম করে রাখতে হয় কোন জাতিকে যদি নিশ্চিহ্ন করে দিতে হয় জাতির পরিচয়কে বিলুপ্ত করতে হয়, তা হলে তার ভাষা কেড়ে নিতে হবে, কৃষ্টি কেড়ে নিতে হয়। ঠিক তারা সেইরকম সূক্ষ্মভাবে কাজ আরম্ভ করেছিল। আগে এদের ভাষা কেড়ে নাও, এদের কৃষ্টি কেড়ে নাও, তাহলে ধীরে ধীরে এরা কলােনীতে পরিণত হবে, গােলাম হবে। এই ছিল তাদের প্রথম প্রচেষ্টা এবং তাকে বাধা দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ প্রথম রাজনৈতিক দল হিসেবে তার বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলে।
প্রথম প্রতিরােধ হয় ১৯৪৮ সালে। আওয়ামী লীগের জন্মের আগেই, বঙ্গবন্ধু ছাত্র জীবনেই প্রতিরােধ আন্দোলনের গােড়াপত্তন হয়। আওয়ামী লীগের জন্ম হয় ১৯৪৮ সনে। ১৯৫২ সনে যে ভাষা আন্দোলন হয় আপনারা জানেন, তাতে প্রত্যেক জেলা ও মহকুমায় উল্লেখযােগ্য বহু নেতাকে কারাবরণ করতে হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের ছাত্রদের সঙ্গে। এবং তখন থেকে আন্দোলন চলতে থাকে। সেই আন্দোলন শুধু ভাষার জন্য আন্দোলন নয়, বাঙালি জাতিকে রক্ষা করার জন্য। ষড়যন্ত্রের সহাত থেকে রক্ষা করার জন্য ছিল এই আন্দোলন। সেই আন্দোলন শক্তি অর্জন করতে করতে ১৯৫৪ সনে সাধারণ নির্বাচন হয়। সাধারণ নির্বাচন তারা দিতে চায় নাই, বাংলা ভাষার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে, আন্দোলনের চাপে, তাদের সাধারণ নির্বাচন দিতে হয়েছিল এবং আমি বলব যে ১৯৫৪ সনে আওয়ামী লীগই ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগ এককভাবে সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু জাতীয় ঐক্য গড়ে তােলার জন্য যুক্তফ্রন্ট করা হয় সেখানে ছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মৌলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু। এটা শুধু নির্বাচনে জয়লাভ করার জন্য নয়, এটা ছিল জাতীয় ঐক্য গড়ে তােলার জন্য তাদের ষড়যন্ত্র প্রতিরােধ করার জন্য। সমস্ত জাতীয় অভ্যুত্থান হয় তাদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে। এই অভ্যুত্থানে এইভাবে নির্বাচনে জয়লাভ করলেই চলবে না বাঙালি নেতৃবৃন্দ সেটা বুঝতে পারে। শাসকগােষ্ঠী সেটা যখন বুঝতে পারে তখন তারা সেই নির্বাচন বানচাল করে দেওয়ার চেষ্টা চালায়। ৯২-ক ধারা জারি করে ক্ষমতা হস্তান্তর তাে দূরের কথা, তারা তখন অকথ্য অত্যাচার আরম্ভ করে এবং সেই অত্যাচারের টার্গেট ছিল আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ এবং কর্মীবৃন্দ। বঙ্গবন্ধুকে জেলখানায় নিয়ে যায় এবং তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্নরকম মিথ্যা মােকদ্দমা পেশ করে। পরবর্তীকালে গণআন্দোলনের চাপে তারা নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় সামগ্রিকভাবে। এবং ১৯৫৬ সালের শেষ দিকে এই অঞ্চলে একটা মন্ত্রিসভা গঠিত হয় আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভা। ১৯৫৫ সালে সামরিক শাসন জারি করে এই মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দেওয়া হয়। এটা একটা ষড়যন্ত্র, এমন কোন পরিস্থিতির উদ্ভব হয় নাই যাতে মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে সামরিক শাসন জারি করতে হবে।
এটাও ষড়যন্ত্রের আর একটা পর্যায়। কেননা তখন দেশব্যাপী একটা সাধারণ নির্বাচনের কথা চলছিল। প্রস্তুতি চলছিল কয়েক মাস পরে সাধারণ নির্বাচন হবে। তারা যখন বুঝতে পারল যে বাংলাদেশে পুনরায় এইরকম অভ্যুত্থান হবে, পুনরায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে সমস্ত দেশের শাসন ক্ষমতা তারা গ্রহণ করতে পারে, এটা বানচাল করার জন্য সামরিক শাসন জারী করা হয় এবং অকথ্য অত্যাচার চলে। এমন কোন আওয়ামী লীগ নেতা, আওয়ামী লীগ কর্মী ছিল না, যার প্রতি অত্যাচার হয় নাই। বঙ্গবন্ধুকে দীর্ঘকাল জেলখানায় আবদ্ধ করে রাখা হয়। তারপর কিছুদিন সমস্ত রাজনৈতিক দলের কার্যকলাপ বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৯৬৬ সালে আবার আন্দোলন আরম্ভ হয় এবং আইয়ুব গবর্নমেন্টের বিরুদ্ধে আন্দোলন আরম্ভ করে আওয়ামী লীগ। সঙ্গে সঙ্গে তাদের ষড়যন্ত্রও আরাে গভীর হয়। ১৯৬৬ সনে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা দিলেন। তিনি ঐতিহাসিক ছয় দফা দেশের সামনে পেশ করেন। সমস্ত দেশে এই ছয় দফার আন্দোলন আরম্ভ হয় এবং বাংলাদেশের সমস্ত মানুষ একবাক্যে এই ছয় দফা গ্রহণ করে। বাংলার মানুষ একে মুক্তির সনদ হিসাবে গ্রহণ করে সমস্ত দেশে একটা অপূর্ব জাগরণ দেখা দেয়। তারা বুঝতে পারে তাদের প্রাণের দাবী এই ছয় দফায় তাদের মুক্তি নিহিত। এতে শাসকগােষ্ঠী আতঙ্কগ্রস্থ হয় এবং আতঙ্কগ্রস্থ হবার পরে তারা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে একটা নয় দুইটা নয় ছয় দফার জন্য ১৩টি মােকদ্দমা দায়ের করে। এ ধরনের অত্যাচারের নজীর ইতিহাসে নাই। তিনি যেখানে গিয়েছেন বক্তৃতা দেওয়ার পরই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জামিনে মুক্তি পাবার পর আবার যেখানে তিনি বক্তৃতা দিয়েছেন সেখানেই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু এতেও তিনি থামেন নাই, মাথা নত করেন নাই। তার গতি অব্যাহত হয়েছে তিনি চলেছেন জনগণের সেই অপূর্ব সমর্থন ও জাগরণ নিয়ে। সেই জাগরণকে সামনে নিয়ে তিনি অগ্রসর হয়েছেন। কিন্তু অত্যাচারের স্টীম রােলার জনগণের সেই অত্যাচার গতিকে স্তব্ধ করতে পারে নাই। তিনি চলেছেন তার পর তাকে জেলখানায় আবদ্ধ করা হয়। জেলখানার আবদ্ধ করেই তারা ক্ষান্ত হয় নাই। আমরা তখন জেলখানায় আমি তখন পাবনা জেলে ছিলাম। সেই জেলের মধ্যে থেকেই জানতে পারলাম বঙ্গবন্ধুকে রাত্রিতে নিজে যায় এবং তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মােকদ্দমা দায়ের করা হয়েছে। এই ষড়যন্ত্রের মােকদ্দমার ইতিহাস আপনারা জানেন। এই মােকদ্দমা ছিল সমস্ত বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে। এই মােকদ্দমা জাতির বিরুদ্ধে। এই মােকদ্দমা সমস্ত বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে এক ষড়যন্ত্র মােকদ্দমা। প্রত্যেকে ঘরে ঘরে এই অনুভূতি প্রত্যেক মানুষের অন্তরে এই অনুভূতি দেখা দেয়। তখন তৃণমূল আন্দোলন আরম্ভ হয়। ১৯৬৯ সালে সেই আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নেয়। আপনারা জানেন, সেই আন্দোলনে আইয়ুব খান সেই মােকদ্দমা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। এবং বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধা হয়। আমরাও তখন মুক্তি পাই এবং এক সাথে সেই রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সে আমরা সবাই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গিয়েছিলাম। সেই রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সে বঙ্গবন্ধু যেভাবে বাংলার দাবি উত্থাপন করেছিলেন তার তুলনা হয় না। আপনারা জানেন, রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স বানচাল হয়ে যায়। সেটাও ছিল একটি ছল মাত্র। বঙ্গবন্ধুকে কেমন করে অন্য পথে নেয়া যাবে সেই জন্য এই ষড়যন্ত্র ছিল। বঙ্গবন্ধুকে তখন প্রধানমন্ত্রী করা হবে এই বলে আইয়ুব খান প্রস্তাব দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর সােজা উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অংশ, আমার যৌবন এইভাবে প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য জেলে কাটাই নাই। আমি বাংলার মানুষের দাবী আদায় করতে চাই। পরে ইয়াহিয়া খান এলাে আর এক চাল নিয়ে কেননা এটা বন্ধ হয়ে গেছে ষড়যন্ত্র। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপ নেয়। আবার নতুন ষড়যন্ত্র আরম্ভ হলাে ইয়াহিয়া খানকে নিয়ে। নির্বাচন দিলেন। নির্বাচন দিতে বাধ্য হলেন। কোন নির্বাচন হয়ত হত না হলাে যদি তারা নির্বাচনে বাস্তব ফলাফল জানত। তাদের কাছে খবর ছিল এ ব্যাপারে যে তারা নির্বাচনে শতকরা ৬০টি আসনে মন্ত্রী হবে। আর যে দুই একটা আসন থাকবে সেগুলােকে বাধ্য করে নিয়ে তারা সরকার গঠন করবে, এই ছিল তাদের আশা। তা না হলে তারা নির্বাচন দিত না। এই তথ্যের উপর তারা নির্বাচন দেয়।
নির্বাচন দেবার পরে নির্বাচনের যে ফল হলাে, তা আপনারা জানেন। এটা জাতির এক অভ্যুত্থান। পৃথিবীর কোন নির্বাচনে এইরকম সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ করতে দেখা যায়নি। বাংলাদেশে মাত্র দুইটি আসন ছাড়া সব আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জয়লাভ করে এবং তদানীন্তন সমগ্র পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে।
সূত্র: দৈনিক বাংলা, ২৪ জুলাই ১৯৭৫
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৫ – অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেনু সম্পাদিত